গাজা থেকে মুসলিম বিশ্বকে এক সাংবাদিকের ঈদের চিঠি

0
382

চিঠিটি আবু বকর আবিদের পক্ষ থেকে, যিনি গাজার একজন সাংবাদিক। আল ফিরদাউসের পাঠকের জন্য আবু বকর আবিদের চিঠিটির অনুবাদ উপস্থাপন করা হল

প্রিয় মুসলিম ভাই ও বোনেরা,
ইসরায়েলিদের সাথে রুটি ভাগ করে খেয়োনা। গাজার জন্য যেন তোমাদের বিচারের সম্মুখীন না হতে হয় (আল্লাহর নিকট)। মুসলিম বিশ্বের বধির হয়ে যাওয়া কান এবং গাজার প্রতি তাদের উদাসীনতার কারণে যেন তোমাদের বিচারের সম্মুখীন না হতে হয় (আল্লাহর নিকট)। মুসলিমদের গাজা বেশি প্রয়োজন, গাজার মুসলিমদের প্রয়োজন নেই।

আমি আবু বকর আবিদ, চিঠিটি লেখার সময় আমি অপুষ্টিতে ভুগছি, কারণ গত ২০ দিন ধরে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে আমার মুসলিম ভাই ও বোনেরা গাজায় এক বোতল পানি পর্যন্ত পাঠাতে পারেননি—৫৩৮ দিন ধরে। আমি ভুলবশত বিশ্বাস করেছিলাম যে মুসলিম বিশ্ব আমাদের এই সংকটে সাহায্য করবে। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে তাদের কাছ থেকে আমরা কিছুই পাইনি, পেয়েছি শুধু গভীর হতাশা।

প্রায় কোন বিক্ষোভই হয়নি, অধিকাংশ মানুষ চুপ করে ছিল— হয়তো চাকরি বা ক্যারিয়ার হারানোর ভয়ে। হয়তো তাদের ক্যারিয়ার একজন গাজার শিশুর জীবনের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, যে জন্মের মাত্র তিন দিন পরে ইসরায়েলের হাতে নিহত হয়েছে— অন্তত ১৫,৫০০ অন্যান্য শিশুর মতো, যাদের গত ১৭ মাসে ইসরায়েল হত্যা করেছে।

প্রিয় মুসলিম উম্মাহ, আমরা কখনোই তোমাদের পানির বোতল বা খাবারের প্যাকেট দিয়ে আমাদের কষ্ট লাঘব করতে বলেনি। তোমরা ইসলামকে ভুল বুঝেছ যখন এই পথ বেছে নিয়েছ। দুঃখের বিষয়, তোমরা শুধু ইসরায়েলের অনুমতি নিয়েই কাজ করেছ (ইসরায়েলকে সন্তুষ্ট করে নিজেদের কাজ করছো), কারণ গাজায় ২০ দিন ধরে চলা ইসরায়েলি অবরোধ তুলতেও তোমরা ব্যর্থ হয়েছ।

তোমাদের উচিত ছিল আমাদের সাথে অন্যায় ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, নিষ্ক্রিয়ভাবে বসে থাকা নয়। ইসলাম ও কুরআন আমাদের এই বিষয়টিই শেখায়। শুধু শুভেচ্ছা জানিয়ে যেও না যখন আমরা গণহারে হত্যার শিকার হচ্ছি।

আলহামদুলিল্লাহ, আমি মুসলিম এবং কুরআনের অর্ধেক হিফজ করেছি। শারিয়াহ ও ইসলামিক স্টাডিজের ছাত্র হিসেবে গত আট বছর ধরে আমি শিখেছি যে, মুসলিমদের অবশ্যই চরম সংকটে একত্রে দাঁড়াতে হবে, যেকোনো মুসলিমের ব্যথা ভাগ করে নিতে হবে— সে যেই হোক, যেখানেই থাকুক।

সূরা নিসার ৭৫ নং আয়াত জিজ্ঞাসা করে:

“তোমরা কেন আল্লাহর পথে লড়াই করো না সেই দুর্বল পুরুষ, নারী ও শিশুদের জন্য যারা সাহায্যের জন্য কাতর?

তাহলে তোমরা কেন এত মাস পরও সাড়া দাওনি? এটি কুরআনের অনেক আয়াতের মধ্যে একটি, যা তোমাদেরকে ভাইবোনদের কষ্ট লাঘব করতে লড়াই করতে বলে। কিন্তু তোমরা ক্ষুদ্রতম পদক্ষেপও নাও নি। যে বিষয়টি আমাকে সবচেয়ে বেশি ব্যথিত করে তা হলো তোমরা তোমাদের সরকারগুলোকে আমাদের হত্যা ও নির্যাতনকে সমর্থন করতে দিয়েছ। তোমাদের সরকারগুলো ইসরায়েলের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে, সর্বদা তাদের সামরিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক শক্তিশালী করতে আগ্রহী— যা আমাদের হত্যা ও ধ্বংসকে ত্বরান্বিত করছে তোমাদের চোখের সামনেই।

তোমরা কখনোই সত্যিকার অর্থে তোমাদের সরকারগুলোর বিরুদ্ধে দাঁড়াওনি, কিংবা ইসরায়েলের সাথে বাণিজ্য ও সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য চাপ প্রয়ােগ করো নি। আমরা এখন যা দেখছি তা হলো একটি সুপরিকল্পিত স্বাভাবিকীকরণ প্রচেষ্টা, যা মুসলিম বিশ্বের ঐক্য ও পরিচয় মুছে ফেলার লক্ষ্যে পরিচালিত হচ্ছে।

মুসলিমদের গাজা প্রয়োজন, কিন্তু গাজার মুসলিমদের প্রয়োজন নেই।

পবিত্র রমজান মাসে, আমরা দেখেছি সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব ও অন্যান্য দেশের তথাকথিত মুসলিম নেতারা মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের সাথে এক টেবিলে বসে রুটি ভাগ করে খাচ্ছে। অন্যদিকে, আমার পরিবার এবং আমি রোজা ভাঙার জন্য কিছু খুঁজে পাই না। আমি হাজার হাজার মানুষকে সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের দৈনিক খাবারের ছবি পোস্ট করতে দেখেছি।

রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কি তোমাদের অন্যদের সাথে খাবার ভাগ করে খেতে শেখান নি? অথবা অন্তত চুপচাপ খেতে, যাতে যাদের খাবার নেই তাদের মনে কষ্ট না হয়?

তোমাদের তথাকথিত মুসলিম নেতারা সূরা তাওবার শেষ আয়াতটি পড়েন, যেখানে বলা হয়েছে:

“যারা আল্লাহ ও শেষ দিনে বিশ্বাস করে, তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের শত্রুদের সাথে বন্ধুত্ব করবে না, এমনকি যদি তারা তাদের নিকটতম আত্মীয়ও হয়।”

তোমরা দিনের পর দিন দেখেছ শত শত মানুষকে নিজেদের রক্তে ডুবে মরতে, হাজার হাজার পরিবারকে ভাঙাচোরা তাবুতে খাদ্য ও পানির জন্য আহাজারি করতে। আর দেখেছো শত শত খালিপায়ের, আতঙ্কিত শিশুকে আবর্জনা ভরা রাস্তায় ভয়ে, শীতে ও ক্ষুধায় কাঁপতে।

তোমরা তাদের জন্য সত্যিকার অর্থে কী করেছ?

আমরা চাইনি যে বিশ্বের সামনে আমাদের মর্যাদা হ্রাস করে আমাদের মৌলিক মানবাধিকার চাইতে হবে, কিন্তু আমরা বাধ্য হয়েছি— কারণ তোমরা ও বিশ্ব আমাদের অবর্ণনীয় কষ্টকে মেনে নিয়েছ।

৬০,০০০ এর বেশি মানুষ নিহত হয়েছে এবং ১১০,০০০ এর বেশি আহত হয়েছে। তোমরা কি এই সংখ্যা দ্বিগুণ বা তিনগুণ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছ?

এই জুলুম বন্ধ করার জন্য আর কতকিছু দেখানোর প্রয়োজন তোমাদেরকে?

সূরা নিসার ৭৬ নং আয়াতে, আল্লাহ আমাদেরকে অন্যায়ের শিকার মানুষের পক্ষে লড়াই করতে বলেছেন। কিন্তু তোমরা নামায, যাকাত ও রোজায় বেশি জোর দিচ্ছো।

তাহলে যখন তোমরা মসজিদে যাও এবং কাতারে দাঁড়াও, তখন গাজার কথা মনে হলে কেমন অনুভব হয়? (যদি মনে হয়!) আমি জানি অনেকেই মনে রাখো না।

আমাদের একসাথে হাতে হাত রেখে অধিকৃত ফিলিস্তিন ও তার পবিত্র ধর্মীয় স্থানগুলো মুক্ত করার কথা ছিল। কিন্তু তোমরা যুদ্ধাপরাধীদের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছ, আমাদের বেশিরভাগ জমি ছেড়ে দিয়েছ এবং গাজায় গণহত্যাকে উৎসাহিত করেছ।

মাঠে কিছুই অর্জন হয়নি (তোমাদের কোনো প্রচেষ্টাই কাজে আসেনি)। বরং আমরা পেয়েছি ফাঁকা বুলি ও অপমানজনক অনুরোধ।

আল্লাহর রহমত তাদের (ইসরায়েলিদের) রহমতের চেয়ে বড়, কিন্তু তোমরা তাদের (ইসরায়েলের) অধীনস্ত হওয়াকে বেছে নিয়েছ। তিনি (আল্লাহ) প্রতিদিন তোমাদের উপর তাঁর অনুগ্রহ ও রহমত বর্ষণ করেন, কিন্তু তোমরা তা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছ।

আমি সরল-মনে ভেবেছিলাম যে আমি আমার পরিবারের সাথে শান্তি ও আরামে রমজান কাটাব। কিন্তু ইসরায়েল যা করছে— তারা আমাদের বিরুদ্ধে একটি দুর্ভিক্ষের-কৌশল বাস্তবায়ন করেছে এবং সীমান্ত বন্ধ করেছে দুই দিন পরে।

ইসরায়েলের জন্য এটি খুব সহজ ছিল, কারণ তোমরা কিছুই করোনি। এখন আমাদের জীবন আবারও ধ্বংস হয়ে গেছে। এটি কোন দুর্ঘটনা নয়— এটি একটি পরিকল্পিত গণহত্যা।

যখন আজ সন্ধ্যায় তোমরা রোজা ভাঙবে, তখন মনে রেখো— গাজা একদিন এই বিভীষিকা থেকে মুক্তি পাবে। আমরা আমাদের স্বাধীনতা, জীবনযাপনের অধিকার এবং যারা আমাদের উপর অত্যাচার করেছে তাদের বিচার ফিরে পাব।

আর যখন সে দিন আসবে, তখন তোমাদের গাজার প্রয়োজন হবে সবথেকে বেশি— যাতে পরকালে সবচেয়ে বড় প্রশ্নের মুখোমুখি না হতে হয়, অথবা অন্তত তোমাদের মানবতা বাঁচাতে পারো।

তোমরা এখন উভয়টিই (দুনিয়া ও আখেরাত) হারাচ্ছো, এবং আগামীকাল কেউ তোমাদের জন্য হস্তক্ষেপ করবে না (সাহায্যের হাত বাড়াবে না)— কারণ আজ যখন তোমাদের প্রয়োজন ছিল, তখন তোমরা হস্তক্ষেপ করোনি (সাহায্যের হাত বাড়াও নি)।

এটি তোমাদের প্রতিদিন স্মরণ করা উচিত (সব সময় মনে রাখা উচিত)।

ঈদের দিনে, আমি অবাক হই— তোমরা কীভাবে উদযাপন করবে? যখন আমাদের জীবনে প্রায় দুই বছর ধরে উদযাপনের কোন অর্থই নেই।

তোমরা কীভাবে তোমাদের সেরা পোশাক পরবে, যখন আমরা কাফনে মোড়া?

তোমরা কীভাবে মিষ্টি খাবে, যখন আমার পাড়ার শিশুরা বালিতে খাবারের ছবি আঁকে?

তোমরা কীভাবে মসজিদে যাবে, যখন গাজায় প্রায় ১,০০০ মসজিদ ধ্বংস ও অপবিত্র করা হয়েছে?

তোমরা কীভাবে তোমাদের প্রিয়জনদের সাথে দেখা করবে এবং ঘরে আনন্দ করবে, যখন আমরা আমাদের পরিবার ও প্রিয়জনদের কবরের পাশে শোকে দাঁড়িয়ে?

আমার মনে অনেক প্রশ্ন, কিন্তু ঈদ এমন একটি সময় যখন সব মুসলিম একসাথে উদযাপন করে। যদি এই বাস্তবতা (গাজার করুণ অবস্থা) তোমার মনে না আসে, তবে এটি সত্যিকারের ঈদ নয়— এটি শুধু ক্ষণস্থায়ী, স্বার্থপর আনন্দ যা ইসলামিক ও মানবিক উভয় মূল্যবোধ থেকে বঞ্চিত।

বিষয়টি এমন যে— তোমার বাবা মারা যাওয়ার দিনে তোমার প্রতিবেশী একটি পার্টি করছে।

আমি জানি না কিভাবে আমার মধ্যে এই অবিরাম যন্ত্রণাকে থামাব। আমার হৃদয়ে আর ব্যথার জন্য জায়গা নেই, কিন্তু তোমাদের কর্মকাণ্ড আমার কষ্টকে আরও গভীর করে তুলছে।

তোমাদের ভাই,
আবু বকর আবিদ

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধআফগানিস্তানের কাবুলে একটি নতুন যাত্রী পরিবহন টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পের উদ্বোধন
পরবর্তী নিবন্ধগাজায় দখলদার ইসরায়েলের অবিরাম বোমাবর্ষণ, নিহত আরও অর্ধশতাধিক ফিলিস্তিনি