লাল-হলুদ ফুল ছোপের জ্যাকেটের হাতা কনুই পর্যন্ত গোটানো। কপালে বাঁধা কালো ফিতায় ‘নো এনআরসি, নো সিএএ’। ছোট্ট চেহারাটায় প্রচণ্ড তেজ। একহাতে মাইকটা শক্ত করে চেপে ধরা। মুঠো করা আরেক হাত উপরে তুলে শরীরটা ঝাঁকিয়ে স্লোগান তুলছে ‘হাম ক্যায়া চাহতে…’।
ভিড় থেকে গলা মিলিয়ে উত্তর আসছে, ‘আজাদি-আজাদি’। বুধবার ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত ১২টা। কিন্তু ছোট্ট একরত্তি শিশুটি এতটুকু ক্লান্ত নয়। ‘আজাদি আজাদি’র স্লোগানে ঝড় তুলে চলেছে সে। বড়রা বললেও হাত থেকে মাইক্রোফোন ছাড়তে নারাজ ৬ বছরের আইসান আলী।
দ্বিতীয় শ্রেণির ওই বালক রোজই মা শামা পারভিনের হাত ধরে চলে আসে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতার রাজাবাজারের ধরনা মঞ্চে। রাত বাড়লেও চোখে ঘুম নেই ছোট ছেলেটির।
বরং বড়রা যখন স্লোগান দেয়া থেকে বিরত থাকেন, তখন আইসান নিজেই ‘আজাদি’ কিংবা ‘হাল্লা বোল’ স্লোগান তুলে আলোড়ন সৃষ্টি করে। তাকে সঙ্গ দেয় অন্যান্য খুদেরা। খবর এনডিটিভির ও দ্য কুইন্টের।
ভারতজুড়ে প্রায় ২ মাস ধরে অব্যাহত রয়েছে বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) ও নাগরিক তালিকা (এনআরসি) বিরোধী বিক্ষোভ। তবে সবচেয়ে বড় বিক্ষোভগুলো হচ্ছে রাজধানী নয়াদিল্লির জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, উত্তরপ্রদেশের শাহিনবাগ, পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায়, কেরালা, সিলামপুর ও পাঞ্জাবের অমৃতসরে।
এমনকি ভারতের বাইরে বিশ্বের নানা প্রান্তেই এ বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। এ বিক্ষোভে ধর্ম-বর্ণ-জাত নির্বিশেষে সমাজের সব স্তরের মানুষ অংশ নিয়েছেন। মুসলিমবিরোধী নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতায় ছেলের গলায় ‘আজাদি’ স্লোগান শুনে উচ্ছ্বসিত তার মা শামাও।
বললেন, ‘দেখুন, একটা বাচ্চা মন থেকে আজাদির কথা বলছে। কিন্তু মোদি তা শুনতে পাচ্ছেন না। আসলে এসব শুনলে যে মোদিই গদি থেকে পড়ে যাবে। ছেলের জন্য আমি গর্বিত।’ ছোট্ট আইসানের উৎসাহের প্রশংসা করছেন স্থানীয় বাসিন্দারাও। ধরনায় শামিল তরুণী সাহিনা জাভেদ বলছেন, ‘এ লড়াই তো আমাদের সবার।
বাড়িতে গিয়ে শিশুরাও শুনছে তাদের বাবা-মা এবং অন্যদের লড়াইয়ের কথা। ধরনা মঞ্চে এসে নিজের চোখে দেখছে। তা থেকেই শিশুরাও শিখে গিয়েছে আজাদির স্লোগান।’ রাজাবাজার মোড়ে এপিসি রোডের উপরেই তেরঙা কাপড় ঘিরে তৈরি করা হয়েছে নাগরিকত্ববিরোধী সভার মঞ্চ।
সেখানে ঢোকার মুখেই এক পাশে টাঙানো বিশাল জাতীয় পতাকা। শীতের হিমেল হাওয়া, শিশির উপেক্ষা করে রাস্তায় বসেই এনআরসি ও সিএএর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে বসেছে প্রবীণ থেকে তরুণ প্রজন্ম। রাত বাড়লেও খামতি ছিল না তাদের উৎসাহে।
তাই তো একরত্তি শিশুকে চাদরে মুড়ে নেয়ার ফাঁকেই মঞ্চ থেকে ভেসে আসা স্লোগানে তাল মিলিয়ে গৃহবধূ নাসিমা বললেন, ‘কাগজ দেখাব না।’
ঠাণ্ডা লাগুক। যেভাবে হোক বাঁচাতে হবে দেশের মাটি। এটাই এখন সবার একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত বলে মনে করেন বৃদ্ধা মুন্নি বেগম। তার কথায়, ‘সব কষ্ট সহ্য করা যায়। দেশ ভাগের ক্ষত যে প্রতি মুহূর্তে যন্ত্রণা দেয়। তাই সেটা বাচ্চা-বড় সবাইকে একজোট হয়ে আটকাতেই হবে।’