দক্ষিণ এশিয়ায় এখনো করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) বিস্তার হার কম। তবে অনেকে বলছেন যে এর কারণ হলো অপ্রতুল পরীক্ষা ও সত্য আড়াল করা। বলা হচ্ছে, ভারতসহ সব দেশই ‘তথ্য গোপনকারী’ এবং এসব দেশের মহামারীটি মোকাবিলা করার সামর্থ্য নেই। সত্য আড়াল করা প্রয়োজনীয় বিষয় নয়। কারণ পাশ্চাত্যে যে ধরনের মানসম্পন্ন তথ্য সহজলভ্য, এখানকার ব্যবস্থায় তা নেই। অনেকে বলছেন, চীনই পরিকল্পিতভাবে গোপন করার কাজটি করছে। বর্তমানে দেশটি বিপদমুক্ত।
বিষয়টি কেবল স্বাস্থ্যগত নয়। পাশ্চাত্যের বিশেষজ্ঞরা ইতোমধ্যেই ইঙ্গিত দিয়েছেন যে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার কারণেই চীন যেভাবে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছে, তারা তেমনভাবে করতে সক্ষম নয়। সমাজকে প্রস্তুত ও সঙ্ঘবদ্ধ করার সক্ষমতা চরমভাবে সংকল্পবদ্ধ করে এবং চীনা নিয়ন্ত্রণের জন্য এটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। বলা হয়ে থাকে যে এমন কাজ করা কেবল চীনের পক্ষেই সম্ভব এবং ইউরোপের পরিস্থিতি প্রমাণ করেছে যে এই দেশগুলো মহামারী ভালোভাবে মোকাবিলা করতে পারে না।
মূল কথা হলো, ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ সক্ষমতা সহজাতভাবে সবার মধ্যে থাকে না, তা তারা যত উন্নতই হোক না কেন। এই সক্ষমতা চীনের আছে, পাশ্চাত্যের নেই। বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনা করলে প্রশ্ন জাগবে, মহামারীর পর পরবর্তী সঙ্কট তথা অর্থনৈতিক, সামরিক বা ভাইরাস-সংশ্লিষ্ট সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো কোন মডেলের দিকে নজর দেবে?
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, স্প্যানিশ ফ্লুর (এতে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ আক্রান্ত হয়েছিল বলে জানা যায়) পর এমন ধরনের আর কিছুই আসেনি। মৃত্যু হার প্রায় ২.৫ ভাগ, গড় ফ্লু প্রাদুর্ভাব হার ১ ভাগ। বর্তমানে করোনাভাইরাসের হার প্রায় ১.৫ ভাগ। খবরঃ সাউথ এশিয়ান মনিটর
বিশ্বায়ন ও দক্ষিণ এশিয়া
বিশ্বায়ন বলতে বৈশ্বিক উদ্বেগ ও সহযোগিতা উভয়টিই বোঝায়। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এটা অনেকটাই ছিল ইতিবাচক। কিন্তু ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখিয়েছে যে এর অপর দিকটিও প্রাণঘাতী হতে পারে। একসময় যুদ্ধ ছিল মামুলি বৈশ্বিক ঘটনা। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মহামারী ও দুর্ভিক্ষও হানা দিয়েছিল। বর্তমানে লোকজন ও পরিষেবার চলাচলের ফলে অরক্ষণীয় পরিবেশের সৃষ্টি করেছ, কারণ কোনো দেশই আর নিঃসঙ্গ নয় বা অর্থনৈতিকভাবে কেউ স্বাধীন নয়। চিকিৎসা আবিষ্কার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কিন্তু সরকারি গণস্বাস্থ্য কিভাবে সামাল দেয়া হবে, সেটাও বিবেচনা করতে হবে।
দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ও বাইরের লোকজন এখনো সর্বোচ্চ অবস্থাটি দেখেনি। ফলে পরিস্থিতি অস্পষ্ট। তবে ব্যবস্থাপনার প্রাথমিক অবস্থা দুর্বল নিয়ন্ত্রণের ইঙ্গিত দিচ্ছে। পাকিস্তান ভালো করছে না। এর কারণ প্রতিবেশী ইরানের অবস্থা খুবই খারাপ, আর চীনের সাথে রয়েছে তার সীমান্ত। সমালোচকেরা বলছেন, মহামারী ব্যবস্থাপনার চেয়ে রাজনৈতিক অগ্রাধিকারই অনেক নীতিতে প্রাধান্য বিস্তার করছে। তবে পাকিস্তানের মধ্যে সিন্ধুর দক্ষতা প্রশংসনীয়। তারা প্রমাণ করেছে যে শান্তভাবে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করলে ক্ষতি কমানো যায়।
স্বাস্থ্য কাঠামো ও নজরদারি ব্যবস্থায় স্বল্প বিনিয়োগ-সংবলিত প্রবাসী আয়ের ওপর নির্ভরশীল দেশের জন্য ভয়াবহভাবে আক্রান্ত দেশগুলো, বিশেষ করে ইউরোপ থেকে আগত অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছে আওয়ামী সরকার। কোয়ারেন্টাইন নিয়ে প্রতিবাদ হয়েছে, ফিরে আসা অনেকে প্রকাশ্যেই হোম কোয়ারেন্টাইনের প্রতি তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করেছে। এর ফলে সামাজিক পর্যায়ে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
করোনা+ডেঙ্গু
এখন পর্যন্ত সংক্রমণ শনাক্তের হার বেশ কম। কিন্তু অনেকে মনে করছে, শনাক্তহীন ঘটনা অনেক বেশি। বিধিনিষেধ আরোপ করার আগেই চীনসহ আক্রান্ত দেশ থেকে অনেক অভিবাসী এসে পড়েছিল। এ ধরনের গণস্বাস্থ্যগত ইস্যু ব্যবস্থাপনায় দুর্বল রেকর্ডের অধিকারী একটি দেশের জন্য ডেঙ্গু মওসুম বোঝার ওপর শাকের আটি হিসেবে দেখা দেবে। ইতোমধ্যেই ডেঙ্গুর উচ্চ হার দেখা গেছে, একই সময়ে গত বছরের তুলনায় এবারের হারটি অনেক বেশি। এটি ইতোমধ্যেই নাজুক হয়ে ওঠা স্বাস্থ্য কাঠামোকে গুঁড়িয়ে দিতে পারে।
ফলে সামনের পথটি ভালো মনে হচ্ছে না, ভরসা স্থাপন করা যেতে পারে আবহাওয়ার ওপর। গরম ও আর্দ্র আবহাওয়া ভাইরাসটির জন্য অনুকূল নয় বলে বলা হলেও বিজ্ঞান কিন্তু এ ব্যাপারে নাজুক। গড়ে প্রত্যাবর্তন হার বেশ ভালো হলেও অনেকেই এর পরিণাম বুঝতে পারছে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কোয়ারেন্টাইনে থাকা সত্ত্বেও এক বিদেশফেরত শ্রমিক বিয়ে করেছেন। কর্তৃপক্ষ বউভাত অনুষ্ঠান বাতিল করলেও মূল সমস্যাটি এতে প্রকট হয়ে পড়েছে। বড় ধরনের ক্ষতি ছাড়াই মহামারীটি কার্যকরভাবে সামাল দেয়ার মতো ব্যবস্থা নেই।
বেশির ভাগ লোকই অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে ইতোমধ্যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সঙ্কট মোকাবিলায় বিশ্বব্যাংকের ১০০ মিলিয়ন ডলারের তহবিলটির সাথে আরো অনেক মিলিয়ন ডলার যোগ হবে মহামারীটির প্রকোপ কমা মাত্র অর্থনীতি পুনর্গঠনে।
এখন সবাই দম বন্ধ করে আছেন এই আশায় যে কোনো না কোনো কারণে, কেউ অবশ্যই নিশ্চিত নয়, প্রত্যেকে যেমনটা আশঙ্কা করছে, পরিস্থিতি তেমন নাও হতে পারে।