রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ গবেষণা ইন্সটিটিউট (আইইডিসিআর)-এর একক কর্তৃত্বের কারণে সরকারি-বেসরকারি ৭টি ল্যাব করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা করতে পারছে না। আইইডিসিআর থেকে এসব ল্যাবে কোনো নমুনা (স্যাম্পল) পাঠানো হচ্ছে না।
সন্দেহভাজন রোগীদের নমুনা সংগ্রহের অনুমতিও দেয়া হচ্ছে না এসব প্রতিষ্ঠানকে। নমুনা সংগ্রহে কেন্দ্রীয়ভাবে পুলও তৈরি করা হচ্ছে না। ফলে আগের মতোই শুধু ঢাকায় দুটি ও চট্টগ্রামে একটি ল্যাবে চলছে পরীক্ষা। এতে প্রস্তুত সাতটি ল্যাব নিষ্ক্রিয় অবস্থায় পড়ে আছে। সূত্র: যুগান্তর
সুযোগ না দিয়ে আইসিডিডিআর, বি-কে নামমাত্র অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। স্বয়ংসম্পূর্ণ ল্যাব ও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত জনবল থাকা সত্ত্বেও সরকারি প্রতিষ্ঠান নিপসমকে কাজে লাগানো হচ্ছে না। পরীক্ষার জন্য অপেক্ষমাণদের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। এসব কারণে করোনাভাইরাসের পরীক্ষায় কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জিত হচ্ছে না। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন স্থানে মোট ১০টি ল্যাব এ ভাইরাস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত আছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা যুগান্তরকে বলেন, আমরা একটি পরিকল্পনা করে কাজ করছি। তাই অনেকগুলো ল্যাব প্রস্তুত রাখা হয়েছে। তাদের নমুনা সংগ্রহ বা পরীক্ষার অনুমতি দেয়া হয়নি, বিষয়টি সে অর্থে ঠিক নয়। আমরা মনে করি, যখন আইইডিসিআরের মাধ্যমে পরীক্ষা করা সম্ভব হবে না, তখন ওই ল্যাবগুলোর সহায়তা নেয়া হবে। সে ক্ষেত্রে আমরাই নমুনা সংগ্রহ করব এবং কোন ল্যাব পরীক্ষা করবে, সেটিও আমরাই নির্ধারণ করব।
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন- করোনাভাইরাসে সন্দেহভাজন সবাইকে পরীক্ষার আওতায় আনতে হবে। এর আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকেও একাধিকবার অধিকতর পরীক্ষা করার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সমন্বিত পুল করে নমুনা সংগ্রহে ব্যাপক জনবল অন্তর্ভুক্ত করা না হলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। সন্দেহভাজন অনেকেই থেকে যাবে পরীক্ষার বাইরে।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনাভাইরাসের লক্ষণ-উপসর্গ থাকায় সোমবার গণমাধ্যমের এক কর্মী পরীক্ষা করাতে স্বাস্থ্য অধিদফতরে যোগাযোগ করেন। অধিদফতরের এক কর্মকর্তা তাকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনাইউনিটে অবস্থান করতে বলেন। পাশেই শিশু হাসপাতালের ল্যাব থেকে তার নমুনা সংগ্রহের জন্য টেকনোলজিস্ট পাঠানো হবে।
কিন্তু প্রায় চার ঘণ্টা অপেক্ষার পরও নমুনা সংগ্রহে কেউ না এলে তিনি চলে যান। শিশু হাসপাতালের এক কর্মকর্তা জানান, আইইডিসিআরের অনুমতি না পাওয়ায় প্রথমে নমুনা সংগ্রহ করা হয়নি। পরে অন্য ব্যবস্থাপনায় ব্যক্তির নমুনা সংগ্রহ করা হয়।
পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজধানীর কুর্মিটোলা হাসপাতালের কয়েকজন স্বাস্থ্যকর্মী জানান, ওই হাসপাতালে করোনাভাইরাসের লক্ষণ-উপসর্গ নিয়ে ভর্তি হয়েছেন এমন তিন থেকে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু তাদের পরীক্ষার আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। হাসপাতালের পক্ষ থেকে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও আইইডিসিআর থেকে নমুনা সংগ্রহে কাউকে পাঠানো হয়নি। ফলে ওই রোগীরা কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত ছিলেন কি না, সেটিও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এতে হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসক, নার্সদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে।
এর আগে সন্দেহভাজন এক রোগীর চিকিৎসা দিতে গিয়ে রাজধানীর ডেল্টা হাসপাতালের প্রায় ১০ জন চিকিৎসক ও নার্স কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হন। পরে কোয়ারেন্টিনে যেতে হয় হাসপাতালের সব কর্মীকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রের (আইসিডিডিআর’বি) এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, তাদের গবেষণাগারে আটটি পিসিআর মেশিন রয়েছে। নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষার জন্য রয়েছে উচ্চপ্রশিক্ষিত জনগোষ্ঠী। যারা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সব গবেষণা পরিচালনা করে থাকে। কিন্তু দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও এই ল্যাব ও জনগোষ্ঠী কাজে লাগাতে আইইডিসিআর অনীহা প্রকাশ করেছে। শেষ পর্যন্ত আইইডিসিআর ল্যাব কাজে লাগানোর কথা বলা হলেও নিজস্ব ব্যবস্থায় নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষার অনুমতি মেলেনি। এমনকি আইইডিসিআরের পক্ষ থেকে করোনা পরীক্ষার কিট দেয়া হয়েছে মাত্র ১০০টি।
করোনাভাইরাস একটি বৈশ্বিক মহামারীতে পরিণত হয়েছে। সারা বিশ্বে এই মহামারী মোকাবেলায় জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের কাজে লাগানো হয়েছে। কিন্তু দেশের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব প্রিভেন্টিভ অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিনকে (নিপসম) অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
প্রতিষ্ঠানের পরিচালক অধ্যাপক ডা. বায়েজিদ খুরশীদ রিয়াজ জানান, প্রতিবছর নিপসম থেকে দেড়শ’জনের বেশি শিক্ষার্থী জনস্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে এমপিএইচ ও এমফিল ডিগ্রি অর্জন করে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞে পরিণত হচ্ছেন। কিন্তু চলমান করোনা পরিস্থিতিতে এদের কাজে লাগানোর কোনো ব্যবস্থা আজ পর্যন্ত করা যায়নি।
তিনি বলেন, কোভিড-১৯-এর মতো জুনোটিক (প্রাণীবাহিত রোগ) রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তাছাড়া নিপসমে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ল্যাব রয়েছে। শুধু বায়োসেফটি নিশ্চিত করার মাধ্যমে এই ল্যাবেই করোনা পরীক্ষা করা সম্ভব। তাছাড়া নিপসমের রয়েছে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত জনবল। কিন্তু আইইডিসিআরের পাশেই অবস্থিত এই প্রতিষ্ঠানকে কেন কাজে লাগানো হচ্ছে না, তা বোধগাম্য নয়।
এদিকে আইইডিসিআরের হটলাইনে সারা দেশে থেকে প্রচুর ফোন আসছে। তাই সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকছে হটলাইন। অনেকে ফোন দিয়েও হটলাইনে প্রবেশ করতে পারছে না।
গত বুধবার আইইডিসিআরের হটলাইন নাম্বারে ফোন দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী। ওই শিক্ষার্থী একাধিকবার চেষ্টা করেও প্রবেশ করতে পারেননি।
ঢাকার বাইরের একটি জেলা থেকে ফোন দেন একজন নারী। তার চাচী গত এক সপ্তাহ ধরে গলাব্যাথা, ঠান্ডা জ্বরে ভুগছেন। হট লাইনে থাকা চিকিৎসক তাকে জানান, যেহেতু আপনার চাচীর মেয়ে জামাই গত একমাস আগে দেশের বাইরে থেকে এসেছেন। এবং সে গত চারদিন ধরে ঠাণ্ডাজনিত সমস্যায় ভুগছেন। ১৪ দিন পরে মানবদেহে এই ভাইরাসটি থাকতে পারে না। কাজেই তার মেয়ের জামাই আসার ১৪ দিনের মাঝে শ্বাসকষ্টের সমস্যা থাকলে তখন তার করোনা ভাইরাস পরীক্ষা করার দরকার ছিল। পরে ঐ মহিলার নমুনা সংগ্রহ না করেই বলে দেওয়া হয়েছে এগুলো করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত সমস্যা না।
হটলাইন সম্পর্কে এক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেন, খুব বেশি ফোন আসায় অনেক সময় লাইন বিজি থাকায় অনেকেই ফোন দিয়ে পান না। খবর- মানবজমিন