সম্প্রতি তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান(টিটিপি) দলটির সাবেক আমির হাকিমুল্লাহ্ মেহসুদ রহিমাহুল্লাহর বর্ণাঢ্য জিহাদি জীবন স্মরণ করে একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি প্রকাশ করেছে। চলতি মাসের শুরুর দিকে টিটিপির অফিসিয়াল উমার মিডিয়ার মাধ্যমে রিলিজ পেয়েছে ডকুমেন্টারিটি। ভিডিওটিতে হাকিমুল্লাহ্ মেহসুদের জিহাদি জীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরার পাশাপাশি তালিবান-আল-কায়েদাসহ অন্যান্য মুজাহিদ জামা’আতগুলোর সাথে তাঁর সম্পর্কের বিষয়েও দৃষ্টিপাত করা হয়েছে।
ডকুমেন্টারির শুরুতেই দেখানো হয় জিহাদের ময়দানে নেতৃত্ব দেওয়া বেশ কয়েকজন শহিদ মুজাহিদদের ফ্রেমেবন্দী ছবি; যাঁদের মধ্যে আছেন আল কায়েদার প্রতিষ্ঠাতা শাইখ উসামা বিন লাদেন ও শহিদ আব্দুল্লাহ্ আযযাম, তালিবানের প্রতিষ্ঠাতা আমিরুল মু’মিনিন মোল্লা মোহাম্মদ ওমর, হাক্কানি নেটওয়ার্কের সামরিক বিভাগের আমির সাঙ্গিন জাদরান, উজবেকিস্তান ইসলামি আন্দোলনের সাবেক আমির তাহির জুলদাশেভ, আল-কায়েদা আরব উপদ্বীপের দা’য়ি শহিদ আনওয়ার আল-আওলাকি, আল-কায়েদা ইরাক শাখার প্রতিষ্ঠাতা আবু মুস’আব আল-যারকাবি, ইসলামাবাদ লাল মাসজিদের সাবেক খতিব শহিদ আব্দুর রশিদ গাজি, জামিয়া দারুল উলুম ইসলামিয়া করাচির সাবেক পরিচালক নিজামুদ্দিন সামজাই রাহিমাহুমুল্লাহ্ প্রমুখ মুজাহিদ।
ভিডিওটিতে জিহাদের ময়দানে হাকিমুল্লাহ্ মেহসুদের বিভিন্ন আত্মত্যাগের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ফুটিয়ে তোলা হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ফ্রন্টে তাঁর বীরোচিত নেতৃত্ব এবং বেশ কিছু মোবারক হামলায় তাঁর অবদানের বিষয়ও। এছাড়াও তাঁর ক্ষুরধার নেতৃত্ব ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু বক্তব্যের দিকেও ফোকাস করা হয়েছে ভিডিওটিতে।
ডকুমেন্টারিতে বলা হয়, আফগান যুদ্ধে আমেরিকার বিপক্ষে শহিদ হাকিমুল্লাহ্ মেহসুদ রহ. তালিবান কমান্ডার মোল্লা দাউদ উল্লাহর সঙ্গে এককাতারে থেকে লড়াই করেছেন। টিটিপির তৎকালীন আমির বাইতুল্লাহ্ মেহসুদ তাঁকে তালিবানের হয়ে যুদ্ধ করার জন্য আফগানিস্তানের হেলমান্দে পাঠিয়েছিলেন। এর আগেও তিনি আফগান যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার চেষ্টা করেছিলেন, বয়স কম বিধায় আমিরুল মু’মিনিন মোল্লা ওমর রহিমাহুল্লাহ তাঁকে ফেরত পাঠান।
ভিডিওতে দেখানো হয়, হাকিমুল্লাহ্ মেহসুদ রহ. তাঁর প্রচেষ্টা, নিষ্ঠা, ব্যক্তিত্ব এবং কর্মস্পৃহার গুণে কীভাবে জিহাদের ময়দানে নেতৃত্বের আসনে উঠে আসেন।
২০০০ সালের দিকে পাকিস্তানে ইসলামি শরিয়াহ্ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সূত্রধরে ওই অঞ্চলে পাকিস্তান-তালিবান-আন্দোলনের গোড়াপত্তন হয়। শরিয়াহ প্রতিষ্ঠার এই সংগ্রামে হেলমান্দ, খোশত, পাকতিয়া, নানগারহারসহ বেশকিছু সীমান্তলাইনে আমেরিকার গোলাম মুরতাদ পাক-আর্মির সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন তালিবান ধারার পাকিস্তানী মুজাহিদরা। সেই আন্দোলনেও সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন শহিদ হাকিমুল্লাহ্ মেহসুদ।
তখন আল-জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে টিটিপির প্রতিষ্ঠাকালীন আমির বাইতুল্লাহ মেহসুদ রহ. বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের জিহাদ হলো আত্মরক্ষামূলক। পাকিস্তানী বাহিনী আমাদের উপর হামলা করছে, আর আমরা প্রতিহত করছি। নারীশিক্ষা একটা মামুলি বিষয়, এটাতে সংস্কার আনা হবে ইনশাআল্লাহ। একটা সময় আসবে যখন আমরা পাকিস্তানের পুরো সিস্টেমটাই পরিবর্তন করে ফেলবো ইনশাআল্লাহ; আর সবকিছু পরিচালিত হবে ইসলামি শরিয়াহ অনুযায়ী। ইসলামি শরিয়াহতে কোনটি পরিত্যাজ্য, আর কোনটি অনুমোদিত—এটাই হবে আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি। নারী শিক্ষার ক্ষেত্রেও বিষয়টি এমনই, এ ক্ষেত্রেও আমাদের মানদণ্ড হবে শরিয়াহ। মোটকথা, শরিয়াহতে কোনো কিছু অনুমোদন দেওয়া হলে আমরা সেটির অনুমোদন দিবো। আর শরিয়াতে কোনো কিছু পরিত্যাজ্য হলে আমরা সেটা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করবো।’
অন্যদিকে বিবিসিকে ফোনের মাধ্যমে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে হাকিমুল্লাহ মেহসুদ বলেন, নিরপরাধ মানুষ আমাদের টার্গেট নয়; বরং আমাদের টার্গেট তো পাকিস্তান সরকারের ওইসকল কর্মকর্তা, যারা পাকিস্তানের ইসলাম-বিরোধী কুফুরি শাসনব্যবস্থার প্রতিরক্ষায় মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত; এমনকি আমেরিকাকে খুশি করার জন্য তারা নিরপরাধ আদিবাসী লোকদেরকে পর্যন্ত হত্যা ও বাস্তুচ্যুত করতে পিছপা হয়নি। আমরা পাকিস্তানের জনগণকে ভালোবাসি, আর আমরা নিজেরাও তো পাকিস্তানী।
এসব বক্তব্য থেকেই তেহরিক-ই-তালিবানের মূল লক্ষ্য ও কর্মপদ্ধতি স্পষ্ট হয়ে যায়। কেননা পরবর্তীতে পাকিস্তানে সংগ্রামরত তালিবান ধারার এইসকল মুজাহিদ গ্রুপ একত্রিত হয়েই তেহরিক-ই-তালিবান-পাকিস্তান নামে জিহাদি জামা’আতটি প্রতিষ্ঠা করেন। যেটির প্রতিষ্ঠাকালীন আমির ছিলেন বাইতু্ল্লাহ্ মেহসুদ রহ.। তখন বাইতুল্লাহ্ মেহসুদের মুখপাত্র ছিলেন হাকিমুল্লাহ্ মেহসুদ রহ.। পরবর্তীতে বাইতুল্লাহ্ মেহসুদের শাহাদাতের পর তিনি টিটিপির আমির নিযুক্ত হন।
টিটিপির আমির হিসেবে হাকিমুল্লাহ্ মেহসুদ শুধু পাকিস্তান অঞ্চলেই মুজাহিদদের শক্তিমত্তা বৃদ্ধির চেষ্টা করেননি, বরং একটি বৈশ্বিক জিহাদের প্ল্যাটফর্ম তৈরিতে কাজ করেছেন নিরন্তর। এরই অংশ হিসেবে তিনি আল-কায়েদার মুজাহিদিনকে তাঁর অঞ্চলে আশ্রয় দেয়াসহ দলটির বড়বড় হামলাগুলোতে মৌলিক ভূমিকা রেখেছেন। তিনি ‘আমেরিকার অন্তরে আঘাত করার’ নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই অল্প সময়ের ব্যবধানেই পাকিস্তান সরকারের ‘মোস্ট-ওয়ান্টেড’ তালিকায় উঠে আসে তাঁর নাম। তাঁর ব্যাপারে কেউ কোনো তথ্য দিতে পারলে তথ্যদাতার জন্য পাঁচ কোটি পাকিস্তানী রুপি পুরষ্কারও ঘোষণা করে মুরতাদ পাক-সরকার।
ডকুমেন্টারিতে বলা হয়, এতোসব হুমকিধামকি সত্ত্বেও এই বীর মুজাহিদ থেমে থাকেননি, বরং উপর্যুপরি হামলা চালিয়ে গেছেন আমেরিকা এবং এর গোলাম পাক-সরকারের বিভিন্ন শক্তিশালী ঘাঁটিতে।
২০০৯ সালের ৩০শে ডিসেম্বর আফগানিস্তানের খোশতে অবস্থিত সিআইয়ের অপারেশন সেন্টার ‘ক্যাম্প চ্যাপম্যান’-এ একটি তীব্রমাত্রার হামলা চালানো হয়। আমির হাকিমুল্লাহ মেহসুদের পৃষ্ঠপোষকতায় এই হামলাটি চালান জর্ডানের ডা. আবু দুজানা আল-খোরাসানি রহিমাহুল্লাহ। হামলার পূর্বে আবু দুজানা আল-খোরাসানিকে সঙ্গে নিয়ে একটি ভিডিও বার্তা দিয়েছিলেন হাকিমুল্লাহ মেহসুদ। ‘ক্যাম্প চ্যাপম্যান’-এ চালানো ওই হামলায় সিআইএয়ের বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নিহত হয়েছিলো, এছাড়াও ৪ ব্ল্যাক-ওয়াটার সন্ত্রাসীসহ নিহত হয়েছিলো জর্ডানের কাউন্টার-টেরোরিজম বিভাগের প্রধান।
এই হামলায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকার সবচেয়ে বড় সামরিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানায় আমেরিকার এক সিনিয়র অফিসার। তার মতে, হামলায় নিহতরা ১৫ হাজার সাধারণ সেনা থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলো।
এছাড়াও ২০১০ সালে আমেরিকার অভ্যন্তরে চালানো এ্যাটাক ‘টাইম স্কয়ার বোম্বিং স্লটে’ও হাকিমুল্লাহ মেহসুদ অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখেন; যদিও হামলাটি যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে ব্যর্থ হয়।
ভিডিওর একটি ক্লিপে হাকিমুল্লাহ মেহসুদকে উজবেকিস্থান ইসলামি আন্দোলনের সাবেক আমির তাহির জুলদাশেভের সাথে একটি ভবন হতে বের হতে দেখা যায়।
এছাড়াও ডকুমেন্টারির শেষের দিকে এসে মেহসুদ রহ. কে আফগান তালিবানের অপর দুই প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব মোল্লা সাঙ্গিন জাদরান এবং সিরাজুদ্দিন হাক্কানির সাথে ঘনিষ্ঠ আলাপরত অবস্থায় দেখা যায়। এর মাধ্যমে বুঝা যায়, আফগান তালিবানের সাথে তাঁর সম্পর্কের মাত্রা কতোটা গভীর ছিলো। সিরাজুদ্দিন হাক্কানি বর্তমানে হাক্কানি নেটওয়ার্কের আমির এবং আফগান তালিবানের নায়েবে-আমির হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
হাকিমুল্লাহ-সিরাজুদ্দিন সম্পর্ক পাক-আফগান আঞ্চলিক ও ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জিহাদি দৃষ্টিকোণ থেকে খুবই তাৎপর্য বহন করে; কেননা হক্কানি নেটওয়ার্ক প্রথম পর্যায়ে পাকিস্তান অঞ্চলে এদের কার্যক্রম বিস্তৃত করলেও পাক আর্মির ষড়যন্ত্র ও তীব্র বাধার ফলে পরবর্তীতে কেবল আফগান অঞ্চলেই নিজেদেরকে সীমাবদ্ধ রাখতে বাধ্য হয়। কিন্তু হাকিমুল্লাহ-সিরাজি সম্পর্ক এই সীমাবদ্ধতাকে জয় করে নেয়। হক্কানি নেটওয়ার্কের পরামর্শ ও হস্তক্ষেপে মুরতাদ পাক আর্মির উপর টিটিপির বেশ কয়েকটি হামলা প্রমাণ করেছে যে হক্কানি নেটওয়ার্ক পাকিস্তানের অভ্যন্তরে না থেকেও যেকোনো হামলায় ভূমিকা রাখতে সক্ষম।
হাকিমুল্লাহ মেহসুদ রহিমাহুল্লাহর বিচক্ষণ নেতৃত্ব ও বিভিন্ন জিহাদি জামাআতগুলোর সাথে তাঁর সুসম্পর্কের ফলশ্রুতিতে পাক-আর্মি ক্রমান্বয়েই কোণঠাসা হয়ে যেতে থাকে ওই অঞ্চলে। টিটিপির একের পর এক সফল হামলায় আতঙ্ক নেমে আসে পাক-সেনা শিবিরে। পরিণতির ভয়াবহতা আঁচ করতে পেরে অবশেষে এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের ফাঁদ পাতে মুরতাদ পাক গোয়েন্দা সংস্থা। দ্বিপাক্ষিক আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে একটি ডিজিটাল কার্ড পাঠানো হয় আমির হাকিমুল্লাহ মেহসুদের নিকট; যে কার্ডের পেছনে যুক্ত করা ছিলো ড্রোনের সিগন্যাল প্রেরক ইলেক্ট্রিক চিপ। আর এভাবেই ২০১৩ সালের ১লা নভেম্বর পাকিস্তান আর্মির ড্রোন হামলায় শাহাদাত বরণ করেন এই মর্দে মুজাহিদ। আল্লাহ তা’আলা তাঁর শাহাদাতকে কবুল করুন। তেহরিক-ই-তালিবানের মুজাহিদিনের সাথে হাকিমুল্লাহ মেহসুদ রহিমাহুল্লাহর আনন্দঘন কিছু মুহূর্তের দৃশ্যায়নের মাধ্যমেই শেষ করা হয় ডকুমেন্টারিটি।
মূলত, পুরো ডকুমেন্টারিজুড়ে জিহাদের ময়দানে শহিদ হাকিমুল্লাহ মেহসুদ রহ. এর আত্মত্যাগ এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক জিহাদি জামাআতগুলোর সাথে তাঁর সম্পর্কের মাত্রা তুলে ধরা হয়েছে, পাশাপাশি তুলে ধরা হয়েছে আমেরিকার গোলাম পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে তেহরিক-ই-তালিবানের যুদ্ধ করার কারণ।