স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দায়িত্ব দেশের স্বাস্থ্য খাতের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ। তবে যাদের জন্য এই সংস্থা- সেই নাগরিকদের চিকিৎসাব্যবস্থা বা স্বাস্থ্যের হাল যেমনই হোক না কেন, অধিদপ্তর ও এর আওতাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেকেরই ‘দুর্নীতির’ স্বাস্থ্য বেশ নাদুসনুদুস। স্বাস্থ্যের রস-মধু চুষে খেয়ে একেকজন রাতারাতি শূন্য থেকে কোটিপতি হয়ে গেছেন। করোনা ভাইরাস মহামারীর এ সময়ে স্বাস্থ্য খাতের যে বেহাল চিত্র ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ পাচ্ছে, এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উঠে আসছে এ খাতের অনেকের ভয়াবহ দুর্নীতির সব তথ্য।
গত বছরই দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন দিয়ে ২৫ দফা সুপারিশ করেছিলো। তবে দুর্নীতির উড়ন্ত পালে এতদিন আড়াল হয়ে ছিলো সেগুলো। অবৈধ সম্পদ অর্জনকারী স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও এর আওতাধীন প্রতিষ্ঠানের ৪৫ কর্মকর্তা-কর্মচারীকেও চিহ্নিত করে দুদক। এ ছাড়া মাস্ক ও পিপিই কেনায় দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত আছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) ১৫ জনের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ড্রাইভার আবদুল মালেকের মতো আরও অসংখ্য কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি করে বাড়ি-গাড়ি ও বিপুল বিত্তের মালিক বনে যাওয়ার তথ্য পাচ্ছেন দুদকের গোয়েন্দারা। নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য, ঘুষ-দুর্নীতি, নিয়ম ভেঙে ঠিকাদারি ব্যবসায় জড়ানোসহ নানা অবৈধ উপায়ে কোটি কোটি টাকার সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তারা। অবৈধ সম্পদ অর্জনকারী স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও এর আওতাধীন প্রতিষ্ঠানের ৪৫ কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে ২১ জন এবং তাদের স্ত্রী-সন্তানসহ ৪৩ জনের সম্পদের হিসাব চেয়েছে দুদক।
গত বছর দুদক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ১১টি খাতে দুর্নীতি ও অনিয়ম খুঁজে পায়। এর মধ্যে বেশি দুর্নীতি হয় কেনাকাটা, চিকিৎসাসেবা, চিকিৎসাসেবায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ব্যবহার এবং ওষুধ সরবরাহ খাতে। ‘সাদা চোখে দেখা’ দুর্নীতির বাইরে একটি অভিনব দুর্নীতির কথাও তখন জানিয়েছি দুদক। সেটি হলো, অর্থ আত্মসাতের জন্য অনেক অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনা। এমন যন্ত্রপাতি কেনা হয়, যা পরিচালনার জনবল নেই। এগুলো কখনই ব্যবহার করা হয় না। দুদক তখন এই দুর্নীতি প্রতিরোধে ২৫ দফা সুপারিশ করে বলে, দুর্নীতির কারণেই স্বাস্থ্য খাতের করুণ অবস্থা।
আর জাহিদ মালেক বলেছিলেন, প্রতিবেদনে স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতি উল্লেখ করা হয়েছে। তাই প্রতিবেদনটি বিস্তারিত পর্যালোচনা করা হবে। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি এক বছরেও। গত ৮ মার্চ দেশে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর শুরু হয় স্বাস্থ্য খাতে নানা ধরনের কেনাকাটা। এ ছাড়া করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় আরও নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। করোনায় মানুষ যখন প্রাণের ভয়ে তটস্থ তখনও স্বাস্থ্য খাতের কেনাকাটায় ব্যাপক দুর্নীতির চিত্র একে একে উঠে আসতে থাকে।
দুদকের প্রতিবেদনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে অফিস সহকারীসহ ২৮ ‘কোটিপতি’র তথ্য তুলে ধরা হয়। তালিকায় যাদের নাম রয়েছে তাদের মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালকের (বর্তমানে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক) গাড়িচালক আবদুল মালেক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রধান সহকারী সৈয়দ জালাল, জাহাঙ্গীর হোসেন হাওলাদার, জাকির হোসেন, ক্যাশিয়ার আতিকুল ইসলাম, প্রশাসনিক কর্মকর্তা কবির আহমেদ চৌধুরী, অফিস সহকারী ইকবাল হোসেন, এইডস শাখার প্রশাসনিক কর্মকর্তা জালাল উদ্দিন, স্টোনোগ্রাফার শাহজাহান ফকির, এমআইএস শাখার প্রোগ্রামার রুহুল আমিন, স্বাস্থ্যশিক্ষা ব্যুরোর ট্রেনিং অ্যান্ড ফিল্ড অফিসার আমিনুল ইসলাম এবং স্বাস্থ্যশিক্ষা ব্যুরোর হেলথ এডুকেটর জাকির হোসেন।
এ ছাড়া ঢাকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ইপিআই ভবনের অফিস সহকারী তোফায়েল আহমেদ, কমিউনিটি ক্লিনিক শাখার উচ্চমান সহকারী আনোয়ার হোসেন, নিকেতনের ফাইল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল প্রকল্পের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবদুল্লাহ হেল কাফী, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ সচিব আনোয়ার হোসেন, জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মাহামুদুজ্জামান, স্টোর কর্মকর্তা দোলোয়ার হোসেন।
খুলনার শেখ আবু নাসের হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ওয়াহিদুজ্জামান, সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন অফিসের প্রধান সহকারী আশিক নেওয়াজ, ফরিদপুর সিভিল সার্জন অফিসের প্রশাসনিক কর্মকর্তা জালাল মোল্লাহ, গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দিন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের স্টোর অফিসার নাজিম উদ্দিন, বিভাগীয় পরিচালক (রাজশাহী) অফিসের প্রধান সহকারী হেলাল উদ্দিন, কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের স্টোর কিপার সাফায়াত হোসেন ফয়েজ, বিভাগীয় পরিচালক (খুলনা) অফিসের স্টোনোগ্রাফার ফরিদ উদ্দিন ও প্রধান সহকারী মাহাকাব হোসেন এবং বিভাগীয় পরিচালক (ঢাকা) অফিসের প্রশাসনিক কর্মকর্তা দিপক কান্তি।
প্রতিবেদনে গাড়িচালক আবদুল মালেক সম্পর্কে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মচারী ইউনিয়নের স্বঘোষিত সভাপতি হয়ে ২০১০ সালে ৫০০ জনের নিয়োগ বাণিজ্য করে উত্তরার কামারপাড়ায় দুটি সাততলা বাড়িসহ নামে-বেনামে অনেক সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রধান সহকারী জাকির হোসেন সম্পর্কে বলা হয়েছে, তিনি গাড়িচালক মালেকের সহযোগিতায় কর্মচারী সমিতির সাধারণ সম্পাদকের পদ বাগিয়ে নিয়ে সারাদেশে প্রতিনিধি বানিয়ে প্রভাব বিস্তার করে অর্থ কামাচ্ছেন। তিনি সাভারে আলিশান বাড়ি করেছেন।
ঢাকার নিকেতনে ফাইল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল প্রকল্পের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবদুল্লাহ হেল কাফী মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ৫০০ কোটি টাকার কাজ করেছেন। তিনি বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় দুটি প্লট ও ঢাকায় একাধিক ফ্ল্যাট কিনেছেন। তিনি ভারতেও বাড়ি কিনেছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অফিস সহকারী ইকবাল হোসেন মহাপরিচালকের একান্ত ভাজন হওয়ায় বিলবোর্ড সরবরাহ করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। প্রয়োজন ছাড়াই বিলবোর্ড বানিয়ে কোটি কোটি টাকা লুটপাট করেছেন।
জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মাহামুদুজ্জামান ক্ষমতাশালী কর্মচারী। তিনি বাসা বরাদ্দ, নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্যসহ সব ধরনের কাজ করে বিপুল পরিমাণ সম্পদ করেছেন। তার সম্পদের হিসাব তিনি নিজেই জানেন না। একই প্রতিষ্ঠানের স্টোর কর্মকর্তা দোলোয়ার হোসেন স্টোরের মালামাল বুঝে না নিয়ে ঠিকাদারদের বিল প্রদানের কাগজপত্র প্রস্তুত করার কাজ করতেন। গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দিন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের স্টোর অফিসার নাজিম উদ্দিন সম্পর্কে বলা হয়েছে, তিনি ঠিকাদার মিঠু ও আফতাব উদ্দিন সিন্ডিকেটের সঙ্গে সমানতালে কাজ করেন। তার গাজীপুরে অনেক ফ্ল্যাট-প্লটসহ ১০টি গাড়ি রয়েছে। আমাদের সময়