গুজরাট গণহত্যা : রক্তচোষা নতুন ভারতের আবির্ভাব

0
1719
গুজরাট গণহত্যা : রক্তচোষা নতুন ভারতের আবির্ভাব

গুজরাট গণহত্যা
ঘটনার সূত্রপাত : ২০০২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি সকালে অযোধ্যা থেকে আহমেদাবাদের গোদরা রেলস্টেশনের কাছে থামে একটি ট্রেন ‘সাবারমতি এক্সপ্রেস’। যাত্রীরা পূজা শেষে অযোধ্যা থেকে ফিরে আসছিল। রেলওয়ে প্ল্যাটফর্মে ট্রেনের যাত্রী এবং বিক্রেতাদের মধ্যে একটি তর্কের সৃষ্টি হয়। তর্কটি হিংস্র হয়ে ওঠে এবং অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে ট্রেনের চারটি কোচে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। বহু লোক ট্রেনের ভিতরে আটকে যায়। ফলস্বরূপ, ৫৯ জন লোক অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যায়।

মুসলিম বিরোধী প্রোপাগান্ডা :

মুসলিমরাই ট্রেনে আগুন দিয়েছিল এমন একটি প্রোপাগান্ডায় রাজ্যজুড়ে হিন্দু জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। পরে ট্রেনে হামলার অজুহাতে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি) রাজ্যব্যাপী ধর্মঘটের ডাক দেয়। জোরালো প্রচারণা চালানো হয় যে ট্রেনে হামলার পিছনে মুসলিমদেরই হাত রয়েছে। শুরু হয় মুসলিমদের বিরুদ্ধে মিথ্যে প্রোপাগান্ডা। সেসময়ে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিল নরেন্দ্র মােদি। ট্রেনে হামলার ঘটনায় রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে মুদি হাতে নেয় ইসলাম বিরোধী প্রোপাগান্ডা। মুদির সাথে যোগ দেয় বিজেপি সভাপতি রানা রাজেন্দ্রসিংহ। স্বতন্ত্র প্রতিবেদনে ইঙ্গিত দেওয়া হয় যে রাজ্য বিজেপি সভাপতি রানা রাজেন্দ্রসিংহ ও নরেন্দ্র মোদী এই ধর্মঘটের সমর্থন করেন। এবং রানা রাজেন্দ্রসিংহ ও নরেন্দ্র মোদী সরাসরি মুসলমদের জড়িয়ে উত্তেজক শব্দ ব্যবহার করে, যা পরিস্থিতি আরও খারাপ করে। নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা করে যে, ট্রেনে হামলা সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা নয়, বরং মুসলিম সন্ত্রাসবাদের কাজ ছিল এটি।

অন্যদিকে, স্থানীয় সংবাদপত্র এবং রাজ্য সরকারের সদস্যরা বিনা প্রমাণে দাবি করে মুসলিমরাই এ ঘটনা ঘটিয়েছে। মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহিংসতা উস্কে দেওয়ার জন্য একটি বিবৃতি ব্যবহার করা হয় যে ট্রেনে হামলাটি পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা করেছে এবং স্থানীয় মুসলিমরা তাদের সাথে রাজ্যের হিন্দুদের আক্রমণ করার ষড়যন্ত্রে যুক্ত। স্থানীয় সংবাদপত্রগুলি দ্বারাও মিথ্যা গল্প ছাপা হয়, যেগুলিতে দাবি করা হয় যে মুসলিমরা হিন্দু মহিলাদের অপহরণ করেছে এবং ধর্ষণ করেছে।

গোধরা-পরবর্তী গুজরাটে মুসলিম গণহত্যা :

২৮ ফেব্রুয়ারি (ট্রেনের আগুনের পরদিন) থেকে শুরু হয় মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর একযোগে হামলা। হাজার হাজার উন্মাদ হিন্দুরা হামালায় অংশ নেয়। হামলাকারীরা বাছাই করে করে হিন্দুদের বাড়ি অক্ষত রেখে মুসলিমদের বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে পুড়িয়ে দেয়। যদিও ক্ষতিগ্রস্থদের থেকে পুলিশে বহু বার ফোন করা হয়, পুলিশ তাদের জানিয়েছিল যে ‘আপনাদের বাঁচানোর কোনও আদেশ আমাদের নেই।’ উল্টো, পুলিশ আত্মরক্ষার চেষ্টা করা মুসলিমদের উপর গুলি চালিয়েছিল। ফলে অসংখ্য মুসলিম পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। পুলিশের গুলিতেই নিহত হয়েছিল প্রায় অর্ধশতাধিক মুসলিম।

হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীরা মুসলিম নারীদের ধর্ষণ করে, আগুনে পুড়িয়ে মারতে শুরু করে। সপ্তাহব্যাপী স্থায়ী হয় এই রক্তপাত। শত শত বালিকা ও মহিলাদের গণধর্ষণ করা হয় এবং পরে তাদের পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। বাচ্চাদের জোর করে পেট্রল খাওয়ানো হয় এবং তারপরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। গর্ভবতী মহিলাদের আগুনে পুড়ানো হয়েছিল। মহিলাদের পেটে অনাগত সন্তানের পোড়া দেহ দেখা যাচ্ছিল। নানদা পটিয়া গণকবরে ৯৬ টি দেহের মৃতদেহ ছিল, যার মধ্যে ৪৬ টি জন ছিলেন মহিলা। উগ্র হিন্দুরা তাদের বাড়ি ঘেরাও করে এবং ঘরের পুরো পরিবারকে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করে। মহিলাদের উলঙ্গ করে ছিনিয়ে নেওয়া খাবারের মত ধর্ষণ করেছিল এবং হত্যা করেছিল। মহিলাদের পেট ফেরে বাচ্চা বের করে আনন্দ মিছিল করেছিল হিন্দুরা। পিতার সম্মুখে তার সন্তানকে হত্যা আর মায়ের সম্মুখে তার মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে মুসলিমদের।

নির্বাচনে মােদির অন্যতম প্রতিপক্ষ এহসান জাফরির বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল কিছু মুসলিম। সেখানে প্রায় বিশ হাজার উন্মত্ত হিন্দু তার বাড়ি ঘেরাও করে। আর শেষমেশ এহসান জাফরি নেমে এলে তার হাত-পা দু’টো কেটে মৃতদেহ টেনে হিঁচড়ে নিয়ে বেড়ায়। শেষে মৃতদেহ আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। বলাই বাহুল্য, তার ঘরে আশ্রয় নেওয়া প্রায় সব মুসলিম পুরুষদের নির্মমভাবে কুপিয়ে ও আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। নারীদের ধর্ষণ শেষে হত্যা করা হয়। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপাের্টেও এসেছিল এসব তথ্য। এছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি গণহত্যার কথা উল্লেখ করেছিল হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, এদের মধ্যে অন্যতম ‘গুলবার্গ গনহত্যা’। সেখানে একসাথে ৯০ জন মুসলিমকে হত্যা করা হয়েছিল।

প্রায় ২০০০ এর বেশি মুসলিমকে মাত্র কয়েকদিনে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আহত হয় আরও অনেক। কিন্তু অফিসিয়াল ডাটায় দেখানাে হয় মাত্র ৭৯০ জন মুসলিম নিহতের কথা! গুজরাট থেকে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যায় ৯৮,০০০ মুসলিম। রাতের ব্যবধানেই এতগুলাে মুসলিম বাস্তুহারা হয়ে পড়ে। কোনাে কোনাে হিসেব মতে সেই সংখ্যা আসলে দেড় লক্ষেরও অধিক। অর্থনৈতিক হিসেবে মুসলিমদের কত পরিমাণ সম্পদ লুটপাট ও ধ্বংস করেছে তার কোন হিসেব নেই।

হামলার পরবর্তীতে দাতা সংস্থাগুলো মানবিক সহায়তা দিতে চাইলে ভারত সরকার বিভিন্নভাবে বাধা সৃষ্টি করে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো সংস্থাগুলি সহিংসতার সময় ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নেয়া ক্ষতিগ্রস্থদের মানবিক অবস্থার সমাধান করতে ব্যর্থতার জন্য ভারত সরকার এবং গুজরাটে রাজ্য প্রশাসনের সমালোচনা করে।

মার্কিন প্রভাবশালী গণমাধ্যম ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ এক প্রতিবেদনে জানায়, ২০০২ সালের নির্মম গুজরাট দাঙ্গার পর পোস্টের কাছে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মোদীকে মোটেও মর্মাহত হতে দেখা যায়নি। যার রাজ্যের দুই সহস্রাধিক মুসলিমকে হত্যা করা হলো, সেই মোদীর চেহারায় পরিতাপের কোন চিহ্ন পর্যন্ত ছিল না। গুজরাট কাণ্ডে ওয়াশিংটন পোস্টকে দেয়া সাক্ষাৎকারে মোদী বলেছিল, ‘আমি কোন ভুল করিনি। আমি মানবাধিকার রক্ষার প্রতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ’। মোদী তখন কোন মানবাধিকারের কথা বলেছেন তা সেই সাংবাদিক বা কোন বিবেচকের মাথায় তা ঢুকেনি।

গুজরাটের সিনিয়র ইন্টেলিজেন্স কর্মকর্তা সঞ্জিব ভাট পরবর্তীতে আদালতের জবানবন্দিতে জানায় এক গােপন সত্য। সেই সময় কাজের কারণেই নানারকম স্পর্শকাতর তথ্য তার জানা ছিল। আদালতে সে জানায়, ‘দাঙ্গা শুরু হবার আগের রাতে মােদি অফিসিয়ালদের নিয়ে এক মিটিংয়ে
বসেছিল। সেই মিটিংয়ে মােদি সবার উদ্দেশ্যে বলেছিল যে তীর্থযাত্রীদের হত্যার প্রতিশােধস্বরূপ মুসলিমদের এক উচিত শিক্ষা দিতে হবে।’ আর দাঙ্গা শেষ হবার পর মােদিকে জিজ্ঞেস করা হলে সে বলেছিল গুজরাটের ব্যাপারে তার কোনােই অপরাধবােধ নেই। এসমস্ত কারণে নরেন্দ্র মােদিকে এখনও ডাকা হয় ‘গুজরাটের কসাই’ নামে।

হিন্দুত্ববাদী চরমপন্থার উত্থান :

গুজরাট গণহত্যার ভয়ঙ্কর বাস্তবতার কারণে ভারতীয় কিছু অ্যাক্টিভিস্টরাই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মােদিকে চায়নি। সেসময় গুজরাটের ঘটনা অনেক বেশি ফোকাস করে মােদিকে ভােট না দেয়ার অনেক প্রচারণা চালানাে হয়। কিন্তু সেখানকার সাধারণ মুশরিক হিন্দুত্ববাদীরা এই রক্তচোষা মােদিকেই ১৪ তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত করেছিল। আর এরই মাধ্যমে চরম হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসনে রায় দেয় ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীরা। ফলশ্রুতিতে ভারতে অবস্থানরত মুসলিমদের জন্য দেশটি হয়ে উঠে অগ্নিগর্ভ। নিতান্তই তুচ্ছ ঘটনায় পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে মুসলিমদের। গুজরাটে গনহত্যা পরবর্তীতে দেশটির মুশরিকরা সপ্ন দেখতে থাকে এক নতুন রাষ্ট্র রামরাজত্বের।

সূত্র : দ্য গার্ডিয়ান (১৪ মার্চ ২০১২)

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধকসাই মোদির অপরাধনামা! (শেষ পর্ব)
পরবর্তী নিবন্ধকাবুল সরকারের মিথ্যা প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি