সার্কাসিয়ান গণহত্যা হলো সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়ার সার্কাস মুসলিমদের উপর চালানো কৌশলগত গণহত্যা, জাতিগত নির্মূল অভিযান, জোড়পূর্বক বিতাড়িতকরণ ও নির্বাসিতকরণ। উনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে রুশ-সার্কাস যুদ্ধের পর ইতিহাসের নিকৃষ্টতম এই গণহত্যা সংগঠিত হয়।
সার্ক্যাসিয়ানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠী, যারা সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়ান শাসক কর্তৃক নিজ মাতৃভূমিতে জাতিগত নির্মূলের শিকার হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। কৃষ্ণ সাগরের তীরবর্তী উত্তর ককেশাস থেকে ১৫ লক্ষ সার্ক্যাসিয়ান মুসলিমকে দখলদার রাশিয়ান শাসকরা জোড়পূর্বক নির্বাসিত করে।
১৮৬৪ সালের কৃষ্ণসাগরের বন্দর নগরী সোচির নিকট প্রতিরোধ যুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়ার নিকট সার্ক্যাসিয়ানদের পরাজয় ঘটে; ফলে পূর্ব কৃষ্ণসাগর থেকে ক্যাস্পিয়ান সাগর পর্যন্ত ককেশিয়ার বিস্তৃত অঞ্চল রাশিয়ান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।
ক্রিমিয়ান তাতারদের মতো দুর্দশার ফলে ১৮৬৪ সালে ১৫ লক্ষ সার্ক্যাসিয়ান কৃষ্ণসাগরের পূর্ব তীর থেকে ক্রুসেডার রাশিয়া কর্তৃক জোড়পূর্বক বিতাড়িত হয়। তখন নির্বাসিত সার্কাসিয়ানদের বেশিরভাগই তৎকালীন উসমানী সাম্রাজ্যে অধীনে আশ্রয় নেন। অত্যাচারী রুশ সৈন্যরা সার্কাসিয়ানদের জোড়পূর্বক জাহাজে করে উসমানী সাম্রাজ্যে পাঠিয়ে দিতো। রুশ দখলদারদের আগ্রাসনে প্রায় ৮ লক্ষ সার্ক্যাসিয়ান মারা যান।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, তৎকালীন সময়ে রুশ ও কস্যাক সৈন্যরা নিজেদের বিনোদনের খোরাক যোগাতে বিভিন্ন নৃশংস পন্থা অবলম্বন করতো। যেমনঃ গর্ভবতী মহিলাদের পেট ছিড়ে ভিতরের বাচ্চা অপসারণ করে কুকুরকে খাওয়ানো।
গ্রিগরি জাসের মতো রাশিয়ান জেনারেল সার্কাসিয়ানদের “নোংরা উপমানব” হিসেবে অভিহিত করে তাদের হত্যা ও বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ব্যবহারের পক্ষে যুক্তি দিয়েছিল।
রাশিয়া কর্তৃক প্রতিরোধ যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর জাতিগত নিধন থেকে বাঁচতে জনসংখ্যার বৃহৎ অংশ উসমানী সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশে আশ্রয় নেয়।
গণহত্যা আর নির্বাসনের ফলে মোট জনগোষ্ঠীর ৭৫% সার্কাসিয়ানই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। নির্বাসনে ব্যর্থ লোকেরা জলাবদ্ধ স্থান ও পাহাড়ের গুহায় আত্মগোপন করে গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়ার প্রয়াস চালায়।
১৮৬৪ সালের যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগে অনেক সার্কাসিয়ান রাশিয়ার নির্যাতনের ভয়ে দেশত্যাগ করেন এবং ১৮৬৭ সালের পূর্বে এই নির্বাসন প্রক্রিয়া সমাপ্ত হয়। যারা নির্বাসিত হননি বা আত্মসমর্পণ করেননি তাদেরকে বর্বরভাবে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছিল।
নির্বাসনকালীন সময়েই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সার্ক্যাসিয়ান মারা যান। প্রস্থানের জন্য অপেক্ষমান ভীড়ে কিংবা উসমানীয় কৃষ্ণ সাগরের বন্দরে মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে সার্ক্যাস জাতিগোষ্ঠীর বিরাট অংশই প্রাণ হারায়। অন্যরা ঝড়ে জাহাজ ডুবে মারা গিয়েছিলেন। রাশিয়ান সরকারের সংরক্ষিত তথ্য অনুযায়ী ৮০-৯৭% সার্ক্যাসিয়ান জাতিগোষ্ঠীর নিশ্চিহ্নকরণ এভাবেই হয়েছে।
২০২১ সালে এসে একমাত্র জর্জিয়া সার্ক্যাসিয়ান গণহত্যার স্বীকৃতি দেয়। চেচনিয়া ও জর্ডানের রাষ্ট্র নেতারা সার্ক্যাস গণহত্যার নিন্দা জানিয়েছেন।
তবে সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়া বরাবরই সার্ক্যাস গণহত্যার দায় অস্বীকার করে এসেছে। সার্কাস জাতিগোষ্ঠীর বিতাড়িতকরণকে “অনুন্নত বর্বর লোকদের সাধারণ দেশান্তর” বলে নিজের অন্যায়কে চেপে রাখার প্রপাগাণ্ডা চালিয়েছে ।
ককেশাস অঞ্চলে দখলদার রাশিয়ান জাতীয়তাবাদীরা প্রতিবছর ২১ শে মে দিনিটিতে “পবিত্র বিজয় দিবস” হিসাবে পালন করে থাকে, যেদিন থেকে রাশিয়া কর্তৃক ককেশাস অঞ্চল থেকে সার্কাস জনগোষ্ঠীর উপর ইতিহাসের জঘন্যতম নিশ্চিহ্নকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয় করা হয়। অন্যদিকে সার্ক্যাসিয়ানরা গণহত্যার স্মরণে প্রতিবছর দিনটিকে শোক দিবস হিসাবে পালন করে থাকেন। সারা বিশ্বের নির্বাসিত সার্ক্যাসিয়ানরা এই দিনে রাস্তায় নেমে দখলদার রাশিয়ান সরকারের প্রতিবাদ জানান।
বর্তমান মধ্যপ্রাচ্যের তুরস্ক, সিরিয়া, জর্ডান, মিশর, ফিলিস্তিন ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে নির্বাসিত সার্ক্যাসিয়ানরা বসতি গড়েছেন। কিছু সার্কাসিয়ান কুবান ও লুবা নদীর তীরবর্তী কাজাখ গ্রামে এখনো বসবাস করেন।
অত্যাচারী রুশ শাসক কর্তৃক সার্কাসিয়ানদের উপর চালানো জাতিগত নির্মূলাভিযান একবিংশ শতাব্দীতেও মনুষ্যত্বের ভিত নাড়িয়ে দেয়!
পরিশেষে, আমাদের সার্ক্যাসিয়ান ভাইদের মাতৃভূমি থেকে নিশ্চিহ্নকরণে হৃদয়ের গভীর থেকে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করি, যারা প্রাণ হারিয়েছেন তাদের জন্য আল্লাহর রহমত কামনা করি।
فالذين هاجروا وأخرجوا من ديارهم وأوذوا في سبيلي وقاتلوا وقتلوا لأكفرن عنهم سيآتهم ولأدخلنهم جنات تجري من تحتها الأنهار، ثوابا من عند الله، والله عنده حسن الثواب