সোমালিয়ায় উদয়ের পথে নিকটবর্তী বিজয়ের নতুন সূর্যোদয় ||তৃতীয় কিস্তি|| আশ-শাবাবের গঠন ও শায়েখ ওসামা’র (রাহি.) প্রভাব

    2
    2515

    সোমালিয়ায় আশ-শাবাবের গঠন প্রণালী

    ৮০’র দশকের শুরুর দিকে সোমালিয়ায় ক্ষমতা লোভী সেক্যূলার দলগুলোর মাঝে ক্ষমতায় লড়াই ও গৃহযুদ্ধ যখন তীব্র আকার ধারণ করে, তখন ১৯৮৩ সালে উপরোক্ত ৪টি ইসলামি দল নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ের উপর ঐক্যমতে পৌঁছায়। যার ভিত্তিতে ঐবছর ওয়াহদা আশ-শাবাব আল-ইসলামিয়ার মধ্যস্থতায় দলগুলো পৃথক পৃথকভাবে নিজেদের সাংগঠনিক কার্যক্রম বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়। সেই সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কার্যক্রম পরিচালনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

    সেই লক্ষ্যে দলগুলো তাদের পূর্বের সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে ‘আল-ইত্তিহাদুল ইসলামিয়া’ নামে নতুন করে ঐক্যবদ্ধ হয়। এবং ৯০ দশকের শুরু পর্যন্ত এই দলটি দেশে সংস্কার এবং সমাজ সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে। পাশাপাশি যুবকদেরকে দ্বীনের পথে দাওয়াহ্ দিতে থাকে এবং ইদাদের কার্যক্রম চালিয়ে যায়। বলা যায়, সবকিছু চলছিল অনেকটা মোল্লা মুহাম্মদ ওমর মুজাহিদ রহিমাহুল্লাহ্ এর আফগান সংস্কার আন্দোলনের মতোই।

    শায়েখ উসামা বিন লাদেনের আগমন ও ‘আইসিইউ’ প্রতিষ্ঠা:

    অতপর নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে (১৯৯০ সালে) শাইখ উসামা বিন লাদেন রাহিমাহুল্লাহ তাঁর মুজাহিদ ভাইদেরকে সঙ্গে নিয়ে সুদানের দিকে যাত্রা করেন। পরে পূর্ব আফ্রিকার দিকে মনোনিবেশ করেন। এবং ‘আল-ইত্তিহাদুল ইসলামিয়া’র শীর্ষস্থানীয় নেতা শাইখ হাসান হিরসি (রহ.) সহ আরো অনেক মুজাহিদ নেতার সঙ্গে সাক্ষাত করেন। এসময় তিনি তাদের সাথে ইসলামি আন্দোলনের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন এবং তাদেরকে পরামর্শ, অস্ত্র সহায়তা ও আর্থিকভাবে সহায়তা করার আশ্বাস দেন।

    শাইখ উসামা বিন লাদেন শুধু এটুকুতেই ক্ষান্ত থাকেননি। বরং তিনি তাঁর ঘনিষ্ঠ সাথী শাইখ আবু উবাইদাহ আল-বানশিরী ও শাইখ আবু হাফস আল-কায়েদ রাহিমাহুমাল্লাহ সহ আরো অনেক সংখ্যক মুজাহিদকে কেনিয়া ও ইথিওপিয়ার নিয়ন্ত্রিত ওগাদেনে এবং সোমালিয়ায় প্রেরণ করেন। ফলে এই অঞ্চলে নতুন করে ইসলামী দাওয়াহ্ ও জিহাদী আন্দোলনের তরঙ্গ বইতে শুরু করে।

    এই পক্রিয়ায় আল-ইত্তেহাদুল ইসলামিয়া নববী মানহায অনুসারে সোমালিয়ায় জিহাদী কার্যক্রম শুরু করে। তবে এসময় জোটের অংশীদার দলগুলোর মাঝে চিন্তাধারা ও কর্মপদ্ধতি নিয়ে মতপার্থক্য দেখা দেয়। পরে কোন সমাধানে পৌঁছাতে না পারায় এই জোট ভেঙে যায়।

    এদিকে ওয়াহদা আশ-শাবাব আল-ইসলামী তার মূল লক্ষ্যে অনড় থেকে কার্যক্রম চালিয়ে যায়। সেই সাথে শাইখ উসামা রহিমাহুল্লাহ্ এর সাথে গোপনে সম্পর্ক বজায় রাখে। দলটি তখন আঞ্চলিক ছোট ছোট ৬টি প্রতিরোধ বাহিনী নিয়ে ইউনিয়ন অব ইসলামিক কোর্টস (ICU) গঠন করে। যা ২০০০ সাল পর্যন্ত গোপন রাখা হয়। এই সময়ে দলটি সিদ্ধান্ত নেয় যে, দেশের বিভিন্ন স্থানে শরিয়াহ্ আদালত গড়ে তুলবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দলটি ১৯৯২ সাল থেকে বিভিন্ন স্থানে শরিয়াহ্ আদালত গড়ে তুলতে শুরু করে। এমনকি শাইখ ‘আলী ধের’ নামে একজন আলেমের নেতৃত্বে রাজধানী মোগাদিশুর সবচেয়ে সমস্যাযুক্ত অঞ্চলগুলির একটিতেও নতুন একটি শরিয়াহ্ আদালত প্রতিষ্ঠিত করা হয়।  এই আদালতে চুরি এবং চাঁদাবাজির মতো অপরাধের শাস্তি দেওয়া হত। সেই সাথে অন্তত স্থানীয় পরিবেশে বিরোধ নিষ্পত্তি এবং জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হত।

    সোমালিয়ার জনগণ সময়ের সাথে সাথে এই আদালতগুলিকে ঘিরে একত্রিত হতে শুরু করে। এমনকি অনেক আলেম স্থানীয় জনগণের সাথে উদ্যোগী হয়ে অনুরূপ আদালত প্রতিষ্ঠা করে। এবং ICU এর সাথে সম্পর্ক তৈরী করতে থাকে। ICU এর প্রতিষ্ঠিত আদালত যে শরয়ী বিধি প্রয়োগ করতো এবং চোর ও খুনিদের শাস্তি দিতো, তা স্থানীয় মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সময়ের সাথে সাথে ইসলামী আদালতের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় অপরাধের হার ব্যাপকভাবে হ্রাস পেতে শুরু করে।

    ১৯৯৮ সাল নাগাদ বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত ইসলামিক আদালতগুলি একসঙ্গে কাজ শুরু করে তাদের ক্ষমতা সুসংহত করে। অতপর ইউনিয়ন অব ইসলামিক কোর্টস তাঁর গোপন সশস্ত্র বাহিনীকে নিয়ে ১৯৯৯ সালে প্রথমবারের মতো একটি রাজনৈতিক কাঠামোয় রূপ নিতে শুরু করে।

    এপ্রিল ১৯৯৯ সালে মোগাদিশুতে ব্যাকারেট মার্কেট (বর্তমানে দেশের বৃহত্তম খোলা বাজার) ইসলামিক আদালতের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসে। এরপর ২০০০ সাল থেকে বিভিন্ন যুদ্ধবাজ গ্রুপগুলোকে রাজধানী মোগাদিশু এবং এর আশেপাশ থেকে যুদ্ধের মাধ্যমে নির্বাসিত করতে শুরু করে ‘আইসিইউ’ যোদ্ধারা। আর ঐ বছরই ইসলামিক কোর্টস ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়।

    ইউনিয়ন অব ইসলামিক কোর্টস তখন সোমালিয়া জুড়ে ব্যাপক জিহাদি কার্যক্রম শুরু করে। সেই সাথে জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ক্ষমতালোভী বিভিন্ন গোষ্ঠী ও সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোকে শায়েস্তা করতে থাকে। এবং নিজদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলোতে শরিয়াহ্ আদালত প্রতিষ্ঠা করতে থাকে। দলটি দিন দিন যতই শক্তিশালী হতে থাকে, দেশে ততই রাজনৈতিক অস্থিরতা কমতে থাকে। মানুষ নিরাপত্তা বোধ করতে থাকে। ফলে ICU এর জনপ্রিয়তাও বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে আইসিইউর নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলের সীমানাও। প্রতিরোধ যোদ্ধারা ২০০৬ সালের আগেই দেশের সিংহভাগ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেন। যেখানে কয়েক বছর ধরেই ইসলামি শরিয়াহ্ ভিত্তিক শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করেন মুজাহিদগণ। আর ২০০৬ সালের জুনে রাজধানী মোগাদিশুতে পৌঁছে যান মুজাহিদগণ।

    চলবে ইনশাআল্লাহ…



     লেখক :  ত্বহা আলী আদনান



    আগের কিস্তিসমূহ পড়ুন
    ——————————-

    ১। সোমালিয়ায় উদয়ের পথে নিকটবর্তী বিজয়ের নতুন সূর্যোদয়
    https://alfirdaws.org/2022/07/17/58043/
    ২। সোমালিয়ায় উদয়ের পথে নিকটবর্তী বিজয়ের নতুন সূর্যোদয় ||দ্বিতীয় কিস্তি|| বৃহত্তর সোমালিয়ায় আশ-শাবাবের ঐতিহাসিক উত্থান ও পটভূমি
    https://alfirdaws.org/2022/07/25/58162/

    2 মন্তব্যসমূহ

    Leave a Reply to মোহাম্মদ বিন কাসিম প্রতিউত্তর বাতিল করুন

    দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
    দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

    পূর্ববর্তী নিবন্ধমধ্যপ্রদেশে স্কুল পাঠ্যক্রম থেকে মুঘল শাসকদের ইতিহাস বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত
    পরবর্তী নিবন্ধসন্ত্রাসী মার্কিন পুলিশের বর্বরতায় মুসলিম যুবকের মর্মান্তিক মৃত্যু