কওমি মাদ্রাসার মানোন্নয়নে হাসিনাকে চিঠি কি ইসলামি শিক্ষা ধ্বংসের নতুন ষড়যন্ত্র?

    মুহাম্মাদ ইব্রাহীম

    1
    1922

    কওমি মাদ্রাসার মানোন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী বরাবর চিঠি লিখেছিল মাদ্রাসা পরিচালক গাজীপুরের দেওনার পীর অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান চৌধুরী। অবাক করা বিষয় হচ্ছে, এই ব্যক্তির চিঠি কোন গড়িমসি ছাড়াই আমলে নেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এবং করণীয় নির্ধারণে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পক্ষ থেকে কওমি আলেম-উলামাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে সভা ডাকা হয়। পরবর্তীতে আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি’আতিল কওমিয়া বাংলাদেশ এর পরিচালনা পরিষদের আলেম-উলামারা জরুরি বৈঠক করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আহ্বানে সভায় না যাবার সিদ্ধান্ত নেন।

    গত ২৫ জুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটি চিঠি দেয় অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান চৌধুরী। ‘কওমি ধারার দ্বীনি শিক্ষা ও শিক্ষকের মানোন্নয়নকল্পে সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ’ শীর্ষক চিঠিতে মিজানুর রহমান আটটি সুপারিশ করেছে।

    জানা যায়, পীর হিসেবে পরিচিত অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান চৌধুরী নিজে কোনো আলেম নন। এছাড়া কওমি মাদ্রাসার কোনো শিক্ষা বোর্ডেও নেই। শুধু গাজীপুরের দেওনা এলাকায় তার একটি মাদ্রাসা রয়েছে। অতীতে কওমি সনদের স্বীকৃতি বা এ জাতীয় কোনো কাজের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা ছিল না। এমন প্রেক্ষাপটে কওমি মাদ্রাসার মান উন্নয়ন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বরাবর তার চিঠি প্রেরণ এবং সে চিঠি আমলে নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ের বৈঠকের বিষয়টি কওমি আলেমদের বিস্মিত করেছে। এবং দায়িত্বশীল আলেমরা মনে করছেন, সরকারের অভ্যন্তরের কারো পরামর্শেই মিজানুর রহমান চৌধুরী এ প্রস্তাব দিয়েছেন।

    সুপারিশগুলো হচ্ছে :

    ১. কওমি ধারার দ্বীনি শিক্ষার মান উন্নয়নে আপনি (প্রধানমন্ত্রী) দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের মর্যাদা দিয়ে সনদের ব্যবস্থা করেছেন এবং এ বিষয়ে আইন প্রণয়নের জন্য জাতি আপনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবে। ওই আইনে কওমি শিক্ষার সূচনা অর্থাৎ প্রাথমিক স্তরের ভিত্তি উল্লেখ নেই, সাধারণ শিক্ষায় যেমনটি আছে। কওমি শিক্ষা আইনে এই বিষয়টি উল্লেখ না থাকায় কওমি শিক্ষা ব্যবস্থাটি ভবিষ্যতে অস্তিত্ব সংকটের সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমতাবস্থায় ‘আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি‘আতিল কওমিয়া বাংলাদেশের অধীন ‘কওমি মাদরাসা সমূহের দাওরায়ে হাদিসের (তাকর্মীল) সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রির (ইসলামিক স্টাডিস ও আরবি) সমমান প্রদান আইন, ২০১৮’এর ২(১) ধারায় ‘কওমি মাদরাসা’ এর সংজ্ঞায় বর্ণিত ‘কওমি মাদরাসা’ অর্থ আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা’আত ও দারুল উলূম দেওবন্দের আদর্শ, মুলনীতি ও মত-পথের অনুসরণে মুসলিম জনসাধারণের আর্থিক সহায়তার উলামায়ে কেরামের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত ইলমে ওহির শিক্ষাকেন্দ্র;’ উক্ত ধারার সঙ্গে ‘যেখানে মক্তব, নাজেরা, হেফজ থেকে শুরু করিয়া দাওরায়ে হাদিস পর্যন্ত এবং তৎপর ইফতা, উলুমুল হাদিস, তাফসিরসহ উচ্চতর শিক্ষা দেওয়া হয়’ সংযুক্ত করা আবশ্যক।

    ২. কওমি ধারার শিক্ষা একটি বিশেষায়িত শিক্ষা ব্যবস্থা। উহার শিক্ষক ও শিক্ষার মান উন্নয়নে প্রতিটি শিক্ষকের বিষয় ভিত্তিক প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা। জাতীয়ভাবে বা ব্যক্তি উদ্যোগে ‘কওমি মাদরাসা শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠা করা খুবই প্রয়োজন।

    ৩. যেহেতু কওমি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো জনগণের আর্থিক সাহায্য সহযোগিতার মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে থাকে, সেকারণে মাদরাসার সকল প্রকার দান আয়কর মুক্ত থাকা দরকার। এই বিষয়ে পরিপত্র জারি করলে দাতারা উৎসাহের সঙ্গে কওমি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দান করতে স্বাচ্ছ্যন্দবোধ করবেন।

    ৪. মাদ্রাসার নিজস্ব আয় থেকে শিক্ষক কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ড গঠন, স্বল্প আয়ের শিক্ষকদের মাসিক বেতন নিয়মিত পরিশোধ করা, মেধাবি, এতিম, দরিদ্র শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান করা।

    ৫. কোনও সরকার প্রধানের উদ্যোগে একই সঙ্গে ৪৬০টি উপজেলায় মডেল মসজিদ নির্মাণ একটি বিশ্ব রেকর্ড বটে। উক্ত মসজিদ সমূহে ইমাম ও খতিব নিয়োগের ক্ষেত্রে কওমি মাদরাসা থেকে পাস করা মেধাবি আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের আকিদার অনুসারিদের ইমাম খতিব নিয়োগ প্রদানে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং নিয়োগ বোর্ডে স্থানীয় কওমি মাদ্রাসা থেকে বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করা যেন ভিন্ন মতাদর্শীরা নিয়োগ পেতে না পারে। তাহলে সরকারের প্রদত্ত স্বীকৃতি বাস্তবে আরও প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে।

    ৬. কওমি শিক্ষাঙ্গন এবং সংশ্লিষ্ট ছাত্র শিক্ষক, কর্মচারীদের সকল প্রকার প্রচলিত রাজনীতি থেকে মুক্ত রাখার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

    ৭. সকল কওমি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেফাক ও হাইয়াতুল উলইয়া-র আওতাভুক্ত করে তার নীতিমালার আলোকে পরিচালনার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা; যাতে ছাত্রদের পড়ালেখার মান নিশ্চিত করা যায়।

    ৮. মুহাম্মদ মিজানুর রহমান চৌধুরী মনে করেন, তার দাবি বাস্তবায়িত হলে এবং প্রতিটি কওমি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সক্রিয় ও দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখলে ব্যক্তি ও জাতি গঠনে কওমি মাদরাসাগুলো অনেক বেশি অবদান রাখতে পারবে। পাশাপাশি জঙ্গিবাদ, উগ্রবাদ, মাদক নির্মূল ও সামাজিক অবক্ষয় রোধে তৃণমূল পর্যায়ে মাদরাসাগুলোর উলামায়ে কেরামের সম্পৃক্ততা অনেক বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে।

    জানা যায়, কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা উন্নয়ন বিষয়ে এ চিঠি চালাচালি ও বৈঠকের আয়োজন হলেও এ ব্যাপারে অবগত ছিলেন না কওমি মাদ্রাসা সংশ্লিষ্ট কোনো শিক্ষা বোর্ডই। সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে, তারা বলেছেন, এ চিঠির বিষয়বস্তু ও বৈঠকের বিষয়ে কিছুই জানতেন না।  কওমি মাদ্রাসার কোন বোর্ডকে বিষয়টি জানানোর প্রয়োজনও মনে করেননি সুপারিশকারী গাজীপুরের এ পীর।

    উপমহাদেশে ইসলামি শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে কওমি মাদ্রাসা। অন্যদিকে ইসলামের শত্রুরা সব সময় সু্যোগ সন্ধানী। বর্তমানে দেশের অধিকাংশ আলেম-উলামা ভারতের দালাল হাসিনার কারাগারে আটক রয়েছে। এই সুযোগে দেশের ইসলামি শিক্ষাকে পরিবর্তন করে ভারতের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতেই জাতির গাদ্দারদের ব্যবহার করছে বলে মনে করছেন ইসলামি চিন্তাবীদগণ।

    হিন্দুত্ববাদী হাসিনা সরকার সব সময় ইসলাম ও মুসলিমদের শিক্ষার বিরোধিতা করেছে। হাজার হাজার আলেমদের বন্দী রেখেছে, ফাঁসি দিয়েছে অনেককে, হত্যা ও গুম করেছে। খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম কওমি মাদ্রাসাকে ব্যাঙের ছাতার সাতে তুলনা করে বলেছিল, ‘সমাজকে রক্ষা করতে হলে তাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার হতে হবে।’ প্রধানমন্ত্রীর পুত্র ও তার তথ্য-প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় বলেছিল, ‘পঁচাত্তরের পর দেশে স্কুল তৈরি বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। এর ফলে প্রতি তিনজন স্কুলছাত্রের বিপরীতে এখন একজন মাদরাসার ছাত্র তৈরি হয়েছে। এটা কমিয়ে দিতে আমরা ইতােমধ্যে আন্দোলন শুরু করে দিয়েছি।’ মাদ্রাসা শিক্ষাকে কমিয়ে দিতে চাওয়া লোকেরাই এখন মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় উন্নয়ন চাচ্ছে, বিষয়টিকে ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের অংশ মনে করছেন উলামায়ে কেরাম।

    ইসলামি বিশ্লেষকরা বলছেন, হিন্দুত্ববাদী ভারত সরকার উপমহাদেশ থেকে ইসলাম ও মুসলিমদের ধ্বংস করে রাম রাজত্বে কায়েম করতে চাচ্ছে। এরই লক্ষ্যে তারা ভারতে মসজিদ-মাদ্রাসা ধ্বংস করতে কাজ করছে। এ দেশেও তাদের দালালদের দ্বারা ইসলামি  শিক্ষায় হস্তক্ষেপ করতে চাইছে। মাদ্রাসা শিক্ষাকে ক্রমান্বয়ে পশ্চিমা ধাঁচে নিয়ে যেতে চাচ্ছে। এজন্য এদেশের আলেম-উলামাগণ বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করে মুসলিম জাতিকে হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসন থেকে রক্ষা করার কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে বলে মনে করছেন তারা।



    লেখক : মুহাম্মাদ ইব্রাহীম



     

    তথ্যসূত্র :
    ১। প্রধানমন্ত্রীর কাছে হেফাজত নেতার চিঠি নিয়ে তোলপাড়
    https://tinyurl.com/3wh4yxys
    ২। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ‘অপারগতা’ জানালো কওমি শিক্ষা বোর্ডগুলো
    https://tinyurl.com/2p98wdrb 

    ১টি মন্তব্য

    Leave a Reply to Khan Jahan Ali প্রতিউত্তর বাতিল করুন

    দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
    দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

    পূর্ববর্তী নিবন্ধআফগানিস্তানে মার্কিন আগ্রাসন ব্যর্থতায় পূর্ণ : সাবেক সিআইএ প্রধান
    পরবর্তী নিবন্ধমুসলিম তরুণীকে ভারতে পাচার এক হিন্দুর : সহযোগিতায় হিন্দু এসআই