আল নাকবা দিবস কী? ইহুদিরা কেন ফের নাকবার হুমকি দিচ্ছে?

    0
    939

    দীর্ঘদিনের ষড়যন্ত্র আর কুটচেষ্ঠার পর ক্রুসেডার ব্রিটেনের সহযোগিতায় জায়নবাদী ইহুদিরা ফিলিস্তিনে তাদের দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ১৯৪৮ সালের ১৫ মে, দখলদার ইহুদিরা ইসরাইল নামক একটি অবৈধ রাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়। কিন্তু তখনো পুরো ফিলিস্তিন জুড়ে লাখ লাখ মুসলিমের বসবাস, যাদেরকে ফিলিস্তিনে রেখে অবৈধ রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ও স্থায়ীত্ব কোনটাই সম্ভব ছিল না। ফলে জায়নবাদী ইহুদিরা এ দিনই অর্থাৎ ১৫-ই মে ফিলিস্তিনি মুসলিমদের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে; শুরু করে ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ গণহত্যা।

    ইহুদিদের হামলার লক্ষবস্তুতে পরিণত হয় মুসলিম নারী-শিশুরা। গণহত্যা, গণধর্ষণে হতভম্ব মুসলিমরা জান-মাল নিয়ে পালিয়ে প্রতিবেশি রাষ্ট্রগুলোতে আশ্রয় নেয়। মাত্র কয়েকদিনের ব্যাবধানে ইহুদি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর বর্বরোচিত হামলায় হাজার হাজার ফিলিস্তিনি মুসলিম নিহত ও সাড়ে সাত লাখেরও বেশি মুসলিম ফিলিস্তিন ভূখণ্ড থেকে বিতাড়িত হয়।

    বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি মুসলিমরা ভেবেছিলেঙ, যুদ্ধ শেষ হলে তারা বাড়ি ফিরে আসতে পারবে। কিন্তু পশ্চিমা ক্রুসেডারদের মদদে দখলদার ইসরাইল তাদেরকে আর কখনোই বাড়িতে ফিরতে দেয়নি। সেই সময় থেকে এখন পর্যন্ত বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা শরনার্থী হয়েই রয়ে গেছেন। আর এভাবেই ইসরাইল নামক একটি অবৈধ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়।

    মাত্র কয়েকদিনের আগ্রাসনে ফিলিস্তিনি মুসলিমদের ওপর যে বিপর্যয় নেমে এসেছিল, তারা এটিকে আল-নাকাবা বা বিপর্যয়ের দিন হিসেবে উল্লেখ্য করে থাকেন। এবং প্রতি বছর এই দিনটিকে নাকাবা দিবস হিসেবে পালন করে থাকেন ফিলিস্তিনি মুসলিমরা।

    তবে নাকাবা বা বিপর্যয় শেষ হয়ে যায়নি, ১৯৪৮ সালে যে বিপর্যয় নেমে এসেছিল তা এখনো চলমান রয়েছে। সেই থেকে এখন পর্যন্ত প্রতিদিনই ফিলিস্তিনি মুসলিমদের কেউ না কেউ খুন হচ্ছে। ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘরে অভিযান চালিয়ে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে যাচ্ছে ইসরাইলিরা। অবৈধ ইহুদিরাই কিনা অবৈধ অযুহাতে ভূমিপুত্র ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর গুড়িয়ে দিচ্ছে। যা বিশ্ব ইতিহাসে বিরল ঘটনা।

    ফিলিস্তিনিদের সাথে আরব শাসকগোষ্ঠীর গাদ্দারি:

    ইতিহাসের কিছু চরিত্র সময়ের পাতায় শঠতার চিহ্ন রেখে যায়। সময়ান্তে বদলে যায় চরিত্রগুলোর অবস্থান। কখনো কখনো তা একেবারেই বিপরীতে অবস্থান করে। ফিলিস্তিনকে ঘিরে কিছু গাদ্দার আরব দেশের অবস্থান ঠিক এই চরিত্রগুলোর মতোই। ১৯৪৮ সালে আরবদেশগুলো একজোট হয়েছিল ইসরাইলের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে। কিন্তু অবাক করা বিষয় হচ্ছে, ৭২ বছর পর সেই আরব দেশগুলোই আবার একজোট হচ্ছে ইসরাইলের দখলদারিত্বের পক্ষে।

    আরব শাসকদের চারিত্রিক শঠতা ও গাদ্দারি অনুধাবন করা সহজ কাজ নয়। নাকবার শুরুর দিকে আরব রাষ্ট্রগুলো প্রতিরোধের চেষ্টা করেছিল, এটা সত্য। কিন্তু এসব যুদ্ধ ইসরায়েলকে আরও শক্তিমান করেছে। নতুনভাবে বিস্তৃত হওয়ার সুযোগ দিয়েছে। তাই যুদ্ধগুলো আসলেই ইসরাইলের বিপক্ষে ছিল না পক্ষে, তা ঠাওর করা মুশকিল।

    মূলত শুরু থেকে আরব দেশগুলো ইসরাইলের পক্ষেই ছিল। কেননা উসমানীদের পতনে গাদ্দার আরব নেতা ও শাসকদের সহযোগিতা ও ভূমিকাও ছিল উল্লেখযোগ্য। উসমানী সাম্রাজ্য ভেঙে দেওয়ার জন্য ইউরোপীয়রা দীর্ঘদিন ধরেই চেষ্টা করছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ইউরোপীয়দের সামনে সেই সুযোগ এনে দেয়। গাদ্দার আরব শাসকরা সেই সময় অটোমানদের বিরুদ্ধে ইউরোপকে সাহায্য করে। আর অটোমানদের পরাজয়ের ফলে পরবর্তীতে ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিন মসলিমদের হাতছাড়া হয়ে যায়।

    বর্তমানে ফিলিস্তিনের বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ- গাদ্দার আরব শাসকগোষ্ঠী ইসরাইল বিরোধী অবস্থান থেকে ধীরে ধীরে সরে এসে এখন প্রকাশ্যে ইসরাইলের পক্ষে অবস্থান নিতে শুরু করেছে। আরব দেশগুলো কার্যত ইসরাইলের আঞ্চলিক নেতৃত্ব মেনে নিয়েছে। এক্ষেত্রে অগ্রবর্তী ভূমিকা পালন করছে প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে ইসরাইলের বিশ্বস্ত বন্ধু সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। পরে এর সঙ্গে যুক্ত হয় মিসর ও অন্যান্য উপসাগরীয় দেশগুলো।

    বিশ্বাসঘাতকতার এক মূর্তপ্রতীক হচ্ছে আরবের গাদ্দার শাসকরা। এতদিন পর্দার আড়ালে কথাবার্তা হলেও এখন পুরোপুরি ঘোমটা ফেলে ইসরায়েলের দখলদারিত্ব, উচ্ছেদ, নির্যাতন, খুনকে বৈধতা দিয়ে যাচ্ছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই আরব শাসকেরা জায়নবাদীদের পক্ষেই কাজ করছে। ফিলিস্তিনে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রথম এবং প্রধান কাজ ছিল অটোমানদের পতন ঘটানো। এছাড়া ইসরাইল রাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব ছিল না। এর জন্য প্রয়োজন ছিল আরব নেতাদের পাশে পাওয়া। আরব নেতারা অটোমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে ইউরোপ ও জায়নবাদীরা যা প্রত্যাশা করছিল, ঠিক সেই কাজটিই করে দেয়। তাই ইসরাইলের সঙ্গে আরব শাসকদের সম্পর্কের উষ্ণতা বৃদ্ধিতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। বরং ধাপে ধাপে তাদের সম্পর্ক আরও পরিষ্কার হচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এই উষ্ণতা চূড়ান্ত নাকবার দিকে নিয়ে যাচ্ছে ফিলিস্তিনকে।

    এছাড়াও সাম্প্রতিক দখলদার ইহুদিরা পুনরায় নাকাবা বা ফের গণহত্যা চালানোর হুমকি দিচ্ছে। দখলদার ইহুদিদের ভাষায়, ‘অপেক্ষা করো আবারও শীঘ্রই নাকাবা ফিরে আসবে। আরব জাতি কুকুর ও বেশ্যার সন্তান (নাউযুবিল্লাহ)। সব ভালো আরবরা মরে গেছে। আরবের বেশিরভাগ শাসকরা আমাদের পক্ষে। তোমরা (ফিলিস্তিনিরা) থাইল্যান্ড চলে যাও। আরবদের মৃত্যু হোক, আরবদের মৃত্যু হোক।’ সন্ত্রাসী ইহুদিরা জেরুজালেম ও আল-আকসা মসজিদের আশপাশে মিছিল করে এই ধরনের স্লোগান এখন নিত্যনৈমত্তিক ঘটনা।

    নাকবার হত্যাকাণ্ড নিয়ে জায়নবাদী ইহুদিদের আস্ফালন ও বড়ত্বও কম না। একজন জায়নবাদী ইহুদি, যে কিনা নাকবার সময় শত শত ফিলিস্তিনি শিশুদের হত্যা করেছিল, বর্তমানে সে ৯০ বছরের বৃদ্ধা। এই বয়সে এসেও শিশু হত্যার মতো জঘন্য সন্ত্রাসী কাজে জড়িত থাকার পরও নিজের কাজের জন্য কোন অনুশোচনা নেই তার। এক ইহুদি সাংবাদিককে দেয়া সাক্ষাৎকারে উল্টো তাকে নিজের সন্ত্রাসী কাজের জন্য গর্ববোধ করতে দেখা গেছে।

    এছাড়াও বর্তমানে ফিলিস্তিনিদের ওপর দখলদার ইসরাইল বর্বরোচিত আগ্রাসন চালানোর পরও বিশ্ববাসী একদম দর্শকের ভূমিকায়। এ থেকে এতাই প্রতিয়মান হয় যে ইহুদিরা যদি ফের নাকবা বা ফিলিস্তিনে গণহত্যা শুরু করে তাহলে আরব অনারব কেউই এগিয়ে আসবে না।

    এজন্য মুসলিম উম্মাহকে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় নিজেরাই ভূমিকা পালন করার নববী পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। নতুবা শুধু ফিলিস্তিনই নয় গোটা পৃথিবীটাই মুসলিমদের জন্য নাকবা হয়ে যাবে। এজন্য মুসলিম উম্মাহকে এখনই সময় নিজদের অস্তিত্ব রক্ষায় ঘুরে দাঁড়ানোর।



    লিখেছেন :  ইউসুফ আল-হাসান



    তথ্যসূত্র :

    1. Nakba Day: For Palestinians, not just an historical event
    https://tinyurl.com/56ynnt24
    2. How did the Nakba happen? | Al Jazeera English
    https://tinyurl.com/bdh4akwh
    3. নাকবা নিয়ে ইহুদিদের আস্বফালন
    https://tinyurl.com/43ffnj67
    4. নাকবা আসবেই, ইহুদিদের হুমকি
    https://tinyurl.com/y33y37uj

    মন্তব্য করুন

    দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
    দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

    পূর্ববর্তী নিবন্ধকাশ্মীরে বেকারত্ব বাড়িয়ে চলেছে হিন্দুত্ববাদীরা: মাসের ব্যবধানে বৃদ্ধি দেড় শতাংশ
    পরবর্তী নিবন্ধকাশ্মীরে দখলদার হিন্দুত্ববাদীদের অপরাধনামা || পর্ব-১১ || এক মুসলিম যুবকের করুণ পরিণতি