উইঘুর মুসলিমদের আর্তনাদ || পর্ব-৪ || বাকিতালি নুর, এক নিরীহ সবজি বিক্রেতার গল্প

    0
    480

    বাকিতালি নুর, পেশায় একজন সবজি বিক্রেতা। তার জন্ম পূর্ব তুর্কীস্তানের ইলি কাজাখ জেলার চ্যাপচল শহরের সেককিজ সুমুন গ্রামে। ২০১৭ সালের নভেম্বরে নুর তার ব্যবসার কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরছিলেন। ঠিক তখনই দখলদার চাইনিজ প্রশাসনের হাতে গ্রেপ্তার হন তিনি।

    গ্রেপ্তারের সময় নুরকে তার স্ত্রী ও সন্তানদের সামনেই হাতকড়া পরিয়ে ধাক্কা দিয়ে গাড়িতে তোলে দখলদার চাইনিজরা। এরপর তার স্ত্রী ও সন্তানদেরকে তোলে অরেকটি গাড়িতে। নুর তার গ্রেপ্তার হবার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তারা তাকে বলে, “এখন না, আগে আমরা জায়গামতো পৌঁছে নেই।”

    নুর তার অসুস্থ আত্মীয়কে দেখতে কাজাখস্তানে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এমনকি কাজাখস্তানে যাবার জন্য তিনি পাসপোর্টও পেয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু নুর জানতেন না যে, কোন উইঘুর মুসলিমের কাছে পাসপোর্ট থাকার অর্থ ‘সে একজন অপরাধী’।

    গ্রেপ্তারের পর তারা নুরকে কাজাখস্তান যাবার কারণ জিজ্ঞাসা করে। কারণ তাদের মতে কাজাখস্তান হলো কথিত ‘তালিকাভুক্ত’ সন্ত্রাসী দেশগুলোর একটি।

    নুর তাদের বোঝানোর চেষ্টা করে যে, সে পরিপূর্ণ নিয়ম মেনে সকল বৈধ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই তার পাসপোর্টটি হাতে পেয়েছে। কাজাখস্তানে সে তার অসুস্থ আত্মীয়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে। কিন্তু তার সকল চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। বর্বর চাইনিজরা নুরের কথা মানতে নারাজ। তারা নুরের ওপর অপবাদ দেয় যে, কাজাখস্তানে সে সন্ত্রাসীদের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে।

    বন্দী শিবিরে নেবার পর দখলদাররা ব্যাপক নির্যাতন চালায় নুরের ওপর। নুর বলেন, “তারা আমাকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় অনেক মারধর করতো। আমার হাত-পা ‘টাইগার চেয়ারের’ (এক ধরণের বিশেষ চেয়ার যা উইঘুরদের নির্যাতনের জন্য ব্যবহৃত হয়) সাথে বেঁধে রাখতো। আমাকে জোরপূর্বক স্বীকার করানোর চেষ্টা করতো যে কাজাখস্তানে আমি ‘সন্ত্রাসীদের’ সাথে দেখা করতে যাচ্ছিলাম।”

    নুর তাদের কথায় অস্বীকৃতি জানালে তাকে বেশ কয়েকটি অপরাধে অভিযুক্ত করে একটি কাগজে জোরপূর্বক তার আঙ্গুলের ছাপ নেয়। তারা নুরকে এমন সব অপরাধে অভিযুক্ত করেছিলো যা সে কখনো করেই নি।

    নুর বলেন, “আমাকে যেই সেলে রাখা হয়েছিলো তার সমস্ত জানালা বন্ধ ছিল। সেই সেলে ঢোকার জন্য খুব ছোট একটি জায়গা ছিল। আমাদের হামাগুড়ি দিয়ে সে জায়গা দিয়ে প্রবেশ করতে হতো। দরকার ছাড়া তারা কখনোই সেলের দরজা খুলত না। সেলগুলো ছিলো ঠিক পাখির খাঁচার মতো।”

    বন্দীশিবিরে নুরের মতো বাকী উইঘুর মুসলিমদের পাহাড়া দিতে দখলদার বাহিনী সবসময় অস্ত্র হাতে প্রস্তুত থাকতো। তাদের কারো কারো কাছে মেশিনগানও থাকতো। এছাড়া ওয়াচ টাওয়ার এবং সময়ে সময়ে টহল তো ছিলই। নুররা যখন খেতে যেতেন তখনও তারা অস্ত্র হাতে নজরদারি করতো। এমনকি তারা উইঘুর মুসলিমদের ভয়ে নিজেদের সাথে কুকুরও রাখতো।

    বন্দীশিবিরে উইঘুর মুসলিমদেরকে জোরপূর্বক চীনা সংস্কৃতি শিখতে বাধ্য করে দখলদার চাইনিজরা। সেখানে তারা উইঘুর মুসলিমদের ‘লাল গান’ (চীনের সমাজতন্ত্রের প্রশংসামূলক গান) গাইতে বাধ্য করে। নুর বলেন, “সেখানে লাল গান গাওয়া ছাড়া আমরা আর কিছুই করতাম না।”

    বন্দীশিবিরে উইঘুর মুসলিমদের মাত্র তিনবার টয়লেটে যাবার অনুমতি দিত দখলদাররা। সেখানে একই টয়লেটে একসাথে পাঁচজনকে নিজেদের প্রয়োজন সারতে হতো। তাদের প্রত্যেকের জন্য বেঁধে দেওয়া সময় ছিলো মাত্র দুই মিনিট!

    নুরকে যেই বন্দী সেলে রাখা হতো সেখানে প্রায় ৮ জন উইঘুর মুসলিম বন্দী ছিলেন। নুর বলেন, “সেখানে কিছু সেলে ২০ জন, কিছু সেলে ৪০ জন, আবার কিছু সেলে ছিলো ১২ জন।”

    বন্দীশিবিরে উইঘুর মুসলিমদের যা খেতে দেওয়া হয় তা এক কথায় খাবার অযোগ্য। বর্বর চাইনিজরা ইচ্ছা করেই উইঘুরদের মনোবল ভেঙে দিতে তাদের ইসলামে নিষিদ্ধ খাবারগুলিই খেতে দেয়। আর এগুলোর পাশাপাশি উইঘুরদের ওপর নির্যাতন তো ছিলোই।

    বন্দী থাকার সময় নুর তার এক পরিচিত ব্যক্তির ছেলেকে দেখতে পান। তিনি নুরের সেলেই বন্দী ছিলেন। তার নাম ছিলো আবলিমিত। একদিন কারারক্ষীরা আবলিমিতকে ধরে নিয়ে যায় এবং চারদিন পর তাকে সেলে পাঠিয়ে দেয়। সেলে আসার পর থেকে আবলিমিত তার হাত দিয়ে আর কোন কিছুই করতে পারতেন না। নুর তখন তাকে সাহায্য করেন।

    নুরের সাথে কথাবার্তায় আবলিমিত তার উপর চালানো নির্যাতনের কথা খুলে বলে। তিনি নুরকে বলেন যে, বর্বর চানিজরা তাকে টানা চারদিন দুই হাত বেঁধে শূন্যে ঝুলিয়ে রেখেছিলো। সেসময় তাকে ব্যাপক মারধর করা হয়। তাকে দোষ স্বীকার করে নিতে চাপ দেয়া হয়। এমনকি নির্যাতনের কারণে যেন তিনি মারা না যান সেজন্যে তার মুখে রুটি গুজে দিয়ে এরপর পানি ঢেলে দেওয়া হয়। এভাবেই টানা চারদিন ঝুলে থেকে নির্যাতিত হন আবলিমিত।

    তার কিছুদিন পর আবারও আবলিমিতকে সেল থেকে নিয়ে যায় দখলদাররা। তারপর থেকে আর কখনও তাকে দেখতে পায় নি নুর। নুর বলেন, “এভাবে প্রায়ই সেল থেকে বন্দীদের নিয়ে যায় কারা রক্ষীরা। পরে তাদের সাথে কী হয় তা আর কখনও জানা যায় না।”

    বন্দী শিবিরে বর্বর চাইনিজদের নির্যাতনে উইঘুর মুসলিমদের মৃত্যুবরণ একটি নিয়মিত ব্যাপার। নুর বলেন, “সেখানে তারা পিটিয়ে মানুষদের খুন করতো। আজ যাকে দেখলাম পরের দিনই আর তাকে খুঁজে পাওয়া যেত না। এভাবে করে তাদের অত্যাচারে বহু মানুষ সেখানে মারা গেছে।”

    বন্দী শিবিরে উইঘুর মুসলিমদের ওপর বিভিন্ন ধরণের পরীক্ষা চালায় বর্বর চাইনিজরা। বন্দী থাকার সময় নুরকে তারা একটি ইঞ্জেকশন দেয়।

    নুর বলেন, “তারা নীল রঙের এক ধরণের ড্রাগ আমার শরীরে ইঞ্জেকশন দিয়ে ঢুকিয়ে দেয়। আমি নিষেধ করা সত্ত্বেও তারা জোর করে আমাকে ইঞ্জেকশন দেয়।”

    চাইনিজদের বন্দীশিবিরে উইঘুর মুসলিমদের কোন মানবাধিকার নেই। সেখানে উইঘুরদের সাথে এক প্রকার জানোয়ারের মতো আচরণ করে বর্বর চাইনিজরা। চাইনিজদের এই বর্বরতা সহ্য করতে না পেরে অনেক মুসলিম সেখানে প্যারালাইজড হয়ে গেছে। নুর বলেন, “আমি সেখানে এমন কাউকে দেখিনি যে পরিপূর্ণ সুস্থ ছিলো।”

    ২০১৮ সালের ১৬ই অক্টোবর অসুস্থতার কারণে তারা আমাকে মুক্তি দেয়। তখন আমার পায়ের অবস্থা এতটাই খারাপ ছিলো যে আমি ঠিকমতো হাঁটতেও পারতাম না। আমি প্রতিদিন রক্ত বমি করতাম।

    নুর বলেন, “মুক্তির সময় তারা আমাকে হুমকি দেয় যে, বন্দী শিবিরে আমার সাথে যা যা হয়েছে এবং আমি যা যা দেখেছি তা যদি কাউকে বলি তাহলে আবার আমাকে এখানে ফিরিয়ে আনা হবে। মুখ বন্ধ রাখার শর্তে তারা জোরপূর্বক আমার থেকে কাগজে সই আদায় করে।”

    ২০১৯ সালের ১৫ই আগস্ট নুরকে তার পাসপোর্ট ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এর তিন মাস পর তার স্ত্রী-সন্তানকেও মুক্তি দেওয়া হয়। নুর বলেন, “আমি যদি সেখান থেকে বের না হতে পারতাম তাহলে হয়তো অনেক আগেই মারা যেতাম।”

    নুরের মতো এমন অসংখ্য নিরপরাধ উইঘুর মুসলিমকে এভাবেই বন্দীশিবিরে আটকে রেখে দিনের পর দিন নির্যাতন করছে দখলদার চীন। পুরো বিশ্বের কাছে তথ্যপ্রমাণ, সাক্ষী সবকিছু থাকার পরও দখলদার চীনের বিরুদ্ধে কিছু লোক দেখানো নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে মানবতার লেকচার দানকারীরা। অবশ্য সেই লোক দেখানো নিষেধাজ্ঞা তারা জারি করেছে নিজেদেরই ফায়দার জন্য।

    অন্যদিকে এখনও অনেক উইঘুর মুসলিম মনে করছেন যে, এই কথিত মানবতার প্রতিনিধিত্বকারীরাই পূর্ব তুর্কীস্তানকে দখলদার চীন থেকে মুক্ত করে তা উইঘুরদেরকে দিয়ে দিবে। কিন্তু এই উইঘুর মুসলিমরা এখনও এই সত্যকে উপলব্ধি করতে পারছে না যে, দখলদারদের থেকে নিজেদের স্বাধীনতাকে তাদের নিজেদেরই অর্জন করতে হবে। এবং এই অর্জনের মূল্য হচ্ছে তাদের রক্ত।


    তথ্যসূত্রঃ

    ১। Uyghur Tribunal: Horrific New Testimonies From Concentration Camp Survivors – https://tinyurl.com/yxvcpps2

    ২। Uyghur Tribunal Statements – https://tinyurl.com/yz8vxtbc


    অনুবাদক: ওবায়দুল ইসলাম


    আগের পর্বগুলো পড়ুনঃ

    ১। উইঘুর মুসলিমদের আর্তনাদ || পর্ব-১ || মুসলিম নারীদের জোরপূর্বক গর্ভপাত – https://alfirdaws.org/2022/09/01/58896/

    ২। উইঘুর মুসলিমদের আর্তনাদ || পর্ব-২ || কল্পকথা নয় – হাইতিওয়াজির গল্প – https://alfirdaws.org/2022/09/07/59028/

    ৩। উইঘুর মুসলিমদের আর্তনাদ || পর্ব-৩ || এক কাজাখ মুসলিমের আত্মকথা – https://alfirdaws.org/2022/09/17/59323/

    মন্তব্য করুন

    দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
    দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

    পূর্ববর্তী নিবন্ধহিন্দুত্ববাদীদের স্বরূপ উদঘাটন করে বই লেখায় মুসলিম লেখক আটক
    পরবর্তী নিবন্ধহুদুদ বিরোধীদের কড়া জবাব দিলো ইমারতে ইসলামিয়া আফগানিস্তান