ইসলামের তারকাগণ || পর্ব-২৪ || শামিল বাসায়েভ রাহিমাহুল্লাহ; আগ্রাসী রাশিয়ার ঘুম কেড়ে নেওয়া এক চেচেন বীর। (প্রথম কিস্তি)

3
680

❝আমার মুসলিম ভাইদের উদ্দেশ্যে বলছি: আল্লাহর অনুগ্রহে অচিরেই ইসলাম বিজয়ী হবে, এ বিজয়ে প্রত্যেক মুসলিম অংশগ্রহণ করতে পারবে, এজন্যে সবাইকে চেচনিয়া আসতে হবে না। প্রত্যেকেই আপন আপন জায়গা থেকে ইসলামের মাহাত্ম্যকে উঁচিয়ে ধরুন।
জিহাদের এই দুর্গম পথে যারা আমাদের সাহায্য করছেন, আল্লাহ তা’আলা আপনাদের সর্বোত্তম প্রতিদান দান করেন৷ বিশ্বের সকল অসহায় মুসলিমের সার্বিক সহযোগিতার উপলব্ধি আমাদের আছে পূর্ণমাত্রায়। আমরা এটা নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি যে, নির্যাতিত নিপীড়িত মুসলিমদের দোয়ার বদৌলতে আমরা অবশ্যই বিজয়ী হব-ইনশাআল্লাহ। আমাদের ভাইয়েরা আমাদের জন্য দোয়া করবে, তাদের থেকে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।❞শামিল বাসায়েভ।

ইসলামের জন্য নিবেদিত প্রাণ এই মর্দে মুজাহিদ নিজের সারাটা জীবন সঁপে দিয়েছেন রাশিয়ার শোষণ-পীড়ন থেকে চেচনিয়া, জর্জিয়া, আজারবাইজান, দাগিস্তান প্রভৃতি অঞ্চলের মুসলিমদের মুক্তির জন্যে। শের-ই-দাগিস্তান ইমাম শামিল রাহিমাহুল্লাহ-র (১) রেখে যাওয়া আযাদী আন্দোলনকে তিনি বেগবান করেছেন। নিরীহ মুসলিমদের যত পাওনা জমা হয়েছে আগ্রাসী রাশিয়ার খাতায়, তার কিছুটা তিনি আদায় করেছেন। তানজীমুল জিহাদ, জামাআত আল-কায়েদার যুদ্ধনীতি রপ্ত করেছেন। আফগানিস্তান এসে শাইখ উসামা বিন লাদেন রাহিমাহুল্লাহ থেকে দিক নির্দেশনা নিয়েছেন এবং আল-কায়েদার প্রশিক্ষণ শিবির থেকে যুদ্ধনীতি রপ্ত করেছেন।

জন্ম ও বংশ

১৪ জানুয়ারী ১৯৬৫ সালে দক্ষিণ-পূর্ব চেচনিয়ার দেশনি-ভেদেনো গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত ও সংগ্রামী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। এটি সেই ঐতিহাসিক গ্রাম, যেখান থেকে দাগিস্তানের সিংহ-খ্যাত ককেশাসের তৃতীয় ইমাম, ইমাম শামিল রাহিমাহুল্লাহ রুশ বিরোধী জিহাদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এই দুর্গটি এখনও অবিচল, মহিমান্বিত এবং ককেশাসে মুসলমানদের বীরত্বের সাক্ষীরূপে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে।

তাঁর সম্মানিত পিতা ও দাদার নাম যথাক্রমে সালমানোভিচ বাসায়েভ ও নূর বাসায়েভ। শামিল বাসায়েভের সম্মানিত পিতা ছেলের নাম শামিল রেখেছিলেন, দাগিস্তানের সিংহ ইমাম শামিল রাহিমাহুল্লাহ-র নামের বারাকাহ লাভের জন্য। আল্লাহর ইচ্ছায় তিনিও এ নামের যথাযথ সম্মান রক্ষা করেছেন। জানা যায়, শামিল বাসায়েভের প্রপিতামহ (দাদার পিতা) দাগিস্তানের ইমাম শামিলের অন্যতম সহকারী ছিলেন এবং তিনি জেনারেল ইয়ারমোলভের বিরুদ্ধে এক ভয়াবহ যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। এছাড়াও শামিল বাসায়েভের পিতামহ (তার পিতার পিতা) ১৯১৭ সালের যুদ্ধের সময় কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। সময়টি ছিল লেনিনের উত্থানকাল৷ উক্ত যুদ্ধে তিনি বন্দী হন। তাকে সাইবেরিয়াতে নির্বাসন দেওয়া হয়। সেখানে তিনি ক্ষুৎপিপাসায় ধুকে ধুকে একসময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তার মৃতদেহ দাফন না করে বরফের ওপর ফেলে রাখা হয়েছিল। সুতরাং, বীরত্ব ও সাহসিকতা তিনি পৈতৃক সূত্রেই লাভ করেছেন।

শৈশব-কৈশোর ও শিক্ষা জীবন:

শামিল বাসায়েভ নিজের শৈশব-কৈশোর নিজ গ্রামেই অতিবাহিত করেছেন। প্রাথমিক শিক্ষা-দীক্ষাও তিনি নিজ গ্রাম থেকেই লাভ করেছেন। নিজ বাবা-মায়ের মুখে ককেশাসের মুসলিমদের উপর বয়ে যাওয়া রুশ আগ্রাসনের হৃদয়বিদারক ঘটনাবলী শুনতে শুনতেই তিনি নিজের শৈশব কৈশোর পার করেছেন। রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নিজের পূর্বপুরুষদের ত্যাগ ও আত্মোৎসর্গের চেতনা সঞ্চারক ইতিহাসও তিনি শুনেছেন বাবার থেকে। শৈশবের অবুঝ মনেই তিনি রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আমরণ সংগ্রামের একটা প্রত্যয় সুদৃঢ় করে ফেলেছেন।

শামিল বাসায়েভ নিজ গ্রাম ভেদেনো থেকে ১৯৮২ সালে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। এসময় তার বয়স হয়েছিল ১৭ বছর। এরপর তিনি দুই বছর ফায়ার সার্ভিসে কাজ করেছেন৷ পরবর্তী চার বছর পর্যন্ত তিনি দক্ষিণ রাশিয়ার ভলগোগ্রাদ অঞ্চলের আকসাইস্কি রাজ্যের একটি খামারে কাজ করেছেন। অতঃপর তিনি রাশিয়ার রাজধানী মস্কো অভিমুখে রওনা হন উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে। মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগে ভর্তির চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু সফল হতে পারেননি৷ ১৯৮৭ সালে মস্কো ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট অফ ল্যান্ড ম্যানেজমেন্টে (কৃষি প্রকৌশল অনুষদ) ভর্তি হন। ১৯৯০ সালে সেখান থেকে স্নাতক হন। এছাড়া ইস্তাম্বুলের ইসলামিক ইনস্টিটিউটেও তিনি পড়াশোনা করেছেন। এভাবেই তিনি নিজের গৌরবময় শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করেন।

সংগ্রামী জীবনে পদার্পণ:

১৯৯১ সালের অক্টোবরে চেচেন নেতা জোখার দুদায়েভ রাশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন চেচনিয়া প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। তাই রাশিয়ান রাষ্ট্রপতি ইয়েলৎসিন রাশিয়ায় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে এবং দুদায়েভের স্বাধীনতা আন্দোলনকে দমিয়ে দিতে চেচনিয়ার সীমান্তে অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করার কঠোর নির্দেশ জারি করে। বিপরীতে চেচেন সরকার রাশিয়ার আক্রমণের বিরুদ্ধে চেচনিয়াকে রক্ষা করার জন্য ৬০ হাজার মুজাহিদকে মোকাবিলায় দাঁড় করানোর ঘোষণা দেন।

সে বছর (১৯৯১ সাল) শামিল বাসায়েভ চেচনিয়ায় ফিরে আসেন এবং উত্তর ককেশাস কনফেডারেশন বাহিনীতে যোগদান করেন। ককেশাসের মুসলিম জনগণ এবং শামিল বাসায়েভ এই সংগঠনের সামরিক ইউনিটে ছিলেন। এভাবেই শামিল বাসায়েভ সংগ্রামী জীবনে পদার্পণ করেন। জড়িয়ে পড়েন রুশ-বিরোধী সশস্ত্র জিহাদে। রাশিয়ার ঘুম হারাম করে ছেড়েছেন তিনি। ইতিহাস তাকে স্মরণ করে “রাশিয়ার উসামা বিন লাদেন” নামে।

রাশিয়ার বিরুদ্ধে কেবল সশস্ত্র সংগ্রাম করে বিজয় অর্জন করা একরকম অসম্ভব ব্যাপার ছিল। তাই তিনি চেচনিয়া ইস্যুতে বিশ্বের অপর মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর দৃষ্টি ফেরানোর প্রাণপণ চেষ্টা করেন। সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে ১৯৯১ সালের ৯ নভেম্বর শামিল বাসায়েভ এবং মুজাহিদদের একটি জামাত একটি রাশিয়ান বিমানকে তুরস্কের দিকে ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।

আজারবাইজান ও আবখাজিয়ার রণাঙ্গনে শামিল বাসায়েভ

১৯৯২ সালে তিনি উত্তর ককেশাস কনফেডারেশনের সামরিক ইউনিটের কমান্ডার নিযুক্ত হন। নাগোর্নো-কারাবাখ অঞ্চল নিয়ে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মাঝে যুদ্ধ শুরু হলে শামিল বাসায়েভ কনফেডারেশনের সামরিক ইউনিট নিয়ে আজারবাইজানের পাশে দাঁড়ান। তাদের প্রতি সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তিনি বুঝতে পারলেন, যে লড়াইকে তিনি ইসলামের জিহাদ মনে করছেন তা আর ইসলামের স্বার্থে থাকেনি; বরং তা ইতোমধ্যে জাতীয়তাবাদের সংগ্রামে পরিণত হয়েছে। তখন তিনি স্বীয় সেনা প্রত্যাহার করে চলে আসেন। এই যুদ্ধে তিনি আরব যোদ্ধা খাত্তাবের সঙ্গে পরিচিত হন।

জর্জিয়ান সরকারের আক্রমণের বিরুদ্ধে সেখানকার মুসলমানদের সাহায্য করতে একই বছরের শেষের দিকে তিনি আবখাজিয়া চলে যান। কেননা, তখন সংখ্যাগরিষ্ঠ জর্জিয়ানরা সংখ্যালঘু আবখাজিয়ানদের জাতিগত নির্মূল অভিযান পরিচালনা করছিল।

তারপর শামিল বাসায়েভ অল-ককেশীয় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর কমান্ডার নিযুক্ত হন। ১৯৯৩ সালের অক্টোবরে বাসায়েভ গাগ্রাতে জর্জিয়ান সরকারকে একটি সিদ্ধান্তমূলক সামরিক পরাজয় ঘটাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।

আফগানিস্তানে শামিল বাসায়েভ

সেখান থেকে শামিল বাসায়েভ, খাত্তাব, আবু আল-ওয়ালিদ এবং শত শত চেচেন যোদ্ধা আফগানিস্তানের খোস্ত প্রদেশে চলে আসেন। সেখানে তিনি আফগান মুজাহিদদের অবস্থার সাথে পরিচিত হন। অচিরেই তাঁকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে এক ভয়াবহ যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হবে— ধ্রুব এই সত্যটি অনুভব করতে পেরে রাশিয়ার আগ্রাসনকে রুখে দেওয়া আফগান মুজাহিদদের যুদ্ধাবস্থার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার এই উদ্যোগ তাঁর অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার স্পষ্ট প্রমাণ বহন করে। আফগানিস্তানে তিনি ১৯৯৪ সালের এপ্রিল ও মে- এ দুই মাস অবস্থান করেছেন। এরপর চেচনিয়ায় অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে রাষ্ট্রপতি জোখার দুদায়েভের আহ্বানে পুনরায় চেচনিয়ায় ফিরে আসেন এবং রাশিয়ার প্রতি অনুগত সশস্ত্র দলগুলিকে লক্ষ্য করে অভিযান শুরু করেন।

চলবে ইনশাআল্লাহ…


নোট:
(১) শেরে দাগিস্তান, ইমাম শামিল রাহিমাহুল্লাহ-র বিস্তারিত জীবনী জানতে আগ্রহী পাঠক ইসলামের তারকাগণ সিরিজের ১৯-২৩ পর্বগুলো পড়তে পারেন।


তথ্যসূত্র:
(১) https://tinyurl.com/3hp747yz
(২) https://tinyurl.com/yckv8tpv
(৩) https://tinyurl.com/4584hmcd
(৪) https://tinyurl.com/mr4j74he

3 মন্তব্যসমূহ

  1. ১৯৯৪ সালে তো শাইখ উসামা বিন লাদেন (রাহিমাতুল্লাহ্) সুদানে ছিলেন, তাহলে শামিল বাসায়েভ (রাহিমাতুল্লাহ্) কিভাবে ১৯৯৪ সালে আফগানিস্তানে এসে শাইখ উসামার কাছ থেকে পরামর্শ নেন?

    • মুহতারাম ভাই, আপনার প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। আল্লাহ তা’আলা আপনাকে উত্তম প্রতিদান দান করেন। জাযাকাল্লাহ!!

      এখানে একটা মিস্টেক হয়েছে। শামিল বাসায়েভ মূলত দুইবার আফগানিস্তান এসেছিলেন। একবার ১৯৯৪ সালে। আরেকবার (মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দাবি অনুযায়ী) ২০০১ সালে। আল-কায়েদার প্রশিক্ষণ শিবির থেকে আল-কায়েদার যুদ্ধনীতি রপ্ত করা ও শাইখ উসামার সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়টি ২০০১ সালের ঘটনা, যা ভুলক্রমে প্রথমবারের ঘটনায় (১৯৯৪ সাল) চলে এসেছে। আমরা এডিট করে দিয়েছি। তবে ১৯৯৪ সালে তিনি আফগানিস্তানের খোস্ত প্রদেশে এসেছেন, সেখানে দুই মাস অবস্থান করেছেন এবং আফগানীদের যুদ্ধাবস্থা পর্যবেক্ষণ করেছেন, এটুকু ঠিক আছে।

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধআল-ফিরদাউস সংবাদ সমগ্র || এপ্রিল, ২০২৩ঈসায়ী ||
পরবর্তী নিবন্ধআল-ফিরদাউস নিউজ বুলেটিন || মে ১ম সপ্তাহ, ২০২৩ঈসায়ী