মালিতে সর্বাত্মক যুদ্ধের ঘোষণা আল-কায়েদার

ত্বহা আলী আদনান

1
1386

পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোতে একের পর এক ঘটছে সামরিক অভ্যূত্থান। ৯০ এর দশকের পর থেকে এই অঞ্চলে এখন পর্যন্ত মোট ২৭টি সামরিক অভ্যূত্থান দেখেছে বিশ্ব। বিগত বছর এই ঘটনা ঘটেছে মালি ও বুরকিনা ফাসোতে। এছাড়া, অতিসম্প্রতি এমন ঘটনার সাক্ষী হয়েছে পশ্চিম আফ্রিকার আরেক দেশ নাইজার (Niger)।

অভ্যূত্থানের ঘটনার সাথে যুক্ত এই দেশগুলো ছিলো ফ্রান্সের সাবেক উপনিবেশ। বিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে (১৯৫৭-১৯৭৪) এই অঞ্চলে উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলন জোরদার হলে ফ্রান্স কাগজে কলমে এখান থেকে উপনিবেশ তুলে নেয়; ১৯৭৪ সালের মধ্যেই পশ্চিম আফ্রিকার প্রায় সকল দেশ কাগজে-কলমে স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু বিভিন্ন হঠকারীতামূলক চুক্তির মাধ্যমে এখানে তারা অঘোষিত ঔপনিবেশিক শাসন জারি রাখে। এই চুক্তিগুলোর মাধ্যমে পশ্চিম আফ্রিকার পররাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি, সামরিক নীতি ও খনিজ সম্পদের উপর নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখে ফ্রান্স। আর এই অঘোষিত উপনিবেশ জিইয়ে রাখতে পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোতে নিজেদের পছন্দের লোককে ক্ষমতার মসনদে বসানো হয়। পাশাপাশি, ফ্রান্সের তাঁবেদার প্রশাসনগুলোর নিরাপত্তার জন্য মোতায়েন করা হয় ফরাসি সেনাবাহিনী।

বলা হয় যে, অতীতের সবগুলো সামরিক অভ্যূত্থানের পেছনে ভূমিকা রেখেছে ফ্রান্স। এসব অভ্যূত্থানের মাধ্যমে নিজেদের মতের ভিন্ন শাসকদেরকে ক্ষমতার মসনদ থেকে হটানো হয়েছে।

কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে মালি, বুরকিনা ফাসো ও সর্বশেষ নাইজারে ঘটা সামরিক অভ্যুত্থান ফ্রান্সের পুরনো কৌশলে পানি ঢেলে দিয়েছে। কেননা এই দেশগুলোর অভ্যুত্থানের পিছনের লোকগুলো পশ্চিমা ও ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তবে তাতেও মুক্তি মিলেনি সাধারণ মুসলিমদের। কেননা ক্ষমতার প্রতিযোগিতায় শাসকরা স্থান করে দিচ্ছে নতুন দখলদার শক্তিকে। তারা নতুন মিত্র হিসাবে রাশিয়া ও চীনের দিকে ঝুঁকছে। এই দুই দেশেরই রয়েছে নিজেদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলকে মুসলিমদের রক্তে রঞ্জিত করার কালো ইতিহাস।

এই অঞ্চলে ইতোমধ্যে নিয়ে আসা হয়েছে রাশিয়ার ওয়াগনার ভাড়াটে মিলিশিয়া বাহিনীকে। পূর্বের দখলদার শত্রুদের মতো এরাও এই অঞ্চলে গণহত্যা ও লুণ্ঠনের রাজত্ব কায়েম করছে। সুদান, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র এবং ডমিনিক রিপাবলিক অফ কঙ্গোতেও তারা একই কাজ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

ওয়াগনার ভাড়াটে বাহিনী এক নতুন বিপর্যয়:

একটু গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ৩টি দেশই তাদের নতুন মিত্র বাছাইয়ের ক্ষেত্রে মূলত নতুন মোড়কে পুরোনো ভুলেরই পুনরাবৃত্তি করেছে। তারা পশ্চিমা ও তাদের ইউরোপীয় মিত্রদের তাড়িয়ে এখানে নিয়ে এসেছে রাশিয়াকে। এই দেশটিও পশ্চিমা ও ইউরোপীয়দের চাইতে মুসলিম নিধন ও মুসলিম ভূমিতে লুটপাটের ক্ষেত্রে কোনো অংশেই কম নয়। অতিসাম্প্রতিক ইতিহাসে যার জ্বলন্ত প্রমাণ আফগানিস্তান ও সিরিয়া। তাছাড়া রাশিয়ার দখলে থাকা চেচনিয়া-দাগিস্তানের মতো মুসলিম ভূমিগুলো তো আছেই।

জাতিসংঘ এবং স্থানীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মালিতে রাশিয়ার ভাড়াটে ওয়াগনার বাহিনীর আগমনের সাথে সাথে দেশটিতে বেসামরিক গণহত্যা বেড়েছে। ওয়াগনার বাহিনী আসার প্রথম বছরেই দেশটিতে প্রায় ১ হাজার বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করা হয়েছে। অতিসম্প্রতি মালির উত্তর ও কেন্দ্রীয় অঞ্চলেও গণহত্যা চালিয়েছে ভাড়াটে এই মিলিশিয়া বাহিনীটি।

আয-যাল্লাকা ও তুয়াগের বিদ্রোহীদের দল আজওয়াদ সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, শুধু চলতি আগস্ট মাসের ১০ থেকে ১৮ তারিখের মধ্যে দেশের উত্তরাঞ্চলে ৭টি গণহত্যা চালিয়েছে ওয়াগনার বাহিনী। এতে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত প্রায় ৮০ জন বেসামরিক মুসলিম। এছাড়াও অজ্ঞাত স্থানে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে আরও ৬০ জনেরও বেশি বেসামরিক নাগরিককে।

আয-যাল্লাকার তথ্যমতে, গত ২০ আগস্ট তারিখেও মালির টিম্বাকটু রাজ্যের লিরা এবং গুন্ডাম এলাকায় দুটি গণহত্যা চালিয়েছে ওয়াগনার ও জান্তা সরকারি বাহিনী। এতে প্রাণ হারিয়েছেন আরও অন্তত ৬৭ জন মুসলিম।

এমন পরিস্থিতিতে আল-কায়েদা সংশ্লিষ্ট ইসলামি প্রতিরোধ বাহিনী “জামা’আত নুসরাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন” (জেএনআইএম) দেশটিতে ভাড়াটে ওয়াগনার ও মালির সামরিক জান্তা সরকার উভয়ের বিরুদ্ধে নতুন করে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।

এ বিষয়ে দুই পৃষ্ঠার লিখিত এক বিবৃতিতে জেএনআইএম বলেছে, “রাশিয়ার ভাড়াটে ওয়াগনার বাহিনী এই অঞ্চলের জন্য নতুন এক বিপর্যয়। তারা এই অঞ্চলের জনগণের বিরুদ্ধে অপরাধের নতুন মাত্রা উন্মোচন করেছে; নৃশংসতা এবং বিপর্যয়ের সমস্ত সীমা তারা অতিক্রম করেছে। এই বাহিনীর সদস্যরা এখানে বেসামরিকদের হত্যা ও জবাই করছে, তাদের শরীরে আগুন দিয়েছে এবং তাদের সম্মান পদদলিত ও লুণ্ঠন করেছে।

“মালির জান্তা ও প্রিগোজিনের ভাড়াটে সৈনিকরা নারী ও শিশুদের হত্যায় মেতে উঠেছে, এমনকি কোনো কোনো বাড়িতে তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি গর্ভধারিণী মায়েদের পেটের বাচ্চারাও। বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে, মালির সামরিক জান্তা সরকারের মিডিয়া এই বেদনাদায়ক ঘটনার প্রতিটি বিপর্যয়কে অফিসিয়াল বিবৃতির মাধ্যমে এই বলে বৈধতা দিচ্ছে যে, লক্ষ্যবস্তুকৃত ব্যক্তিরা সন্ত্রাসী বা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সমর্থক। আর তাদের এই যুক্তিতে নিরস্ত্র নারী এবং শিশুরাও সন্ত্রাসী- যাদেরকে কোনো প্রমাণ ছাড়াই হত্যা, জবাই এবং আগুনে পুড়ানো হয়েছে। তাদের বাজার, গ্রাম ও বাড়িঘর জ্বালিয়ে লুটপাট করা হয়েছে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তাদের এই কথিত লড়াই আজ নারী ও শিশুদের হত্যা এবং জনগণের গবাদি পশু ও তাদের সম্পদ লুণ্ঠনে পরিণত হয়েছে।”

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, “সম্প্রতি তারা জাতিগত গণহত্যা ও লুণ্ঠনকে বৈধতা দিতে উত্তরাঞ্চলে কথিত সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধার করার নামে আগ্রাসন চালানো শুরু করেছে। আর এই লক্ষ্যে তারা টিম্বাকটু রাজ্যের বিভিন্ন শহরে প্রতিদিনই নিরপরাধ বেসামরিক লোকদের হত্যা ও বন্দী করতে শুরু করছে। নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও যুবকদের হত্যা করছে, নারীদের ধর্ষণ করছে, শরণার্থী শিবিরে দেখা যাচ্ছে এতিম ও গৃহহীন মানুষের ছবি।

বিবৃতিতে আহবান জানিয়ে বলা হয়, “এমন পরিস্থিতিতে আমরা প্রত্যেক আত্মমর্যাদাবোধ ও মুক্ত-স্বাধীন ঐ সমস্ত মানুষকে আহ্বান জানাই, যারা তার ধর্ম, সম্মান এবং তার ভূমির প্রতি ঈর্ষান্বিত, তারা যেনো সংঘবদ্ধ হয়ে লড়াই করার জন্য প্রস্তুতি নেয়। আমরা মুসলমানদেরকে তাদের মুজাহিদীন (জেএনআইএম) ভাইদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রুশ ভাড়াটে এবং বামাকোতে শাসনকারী অপরাধী চক্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আহ্বান করছি।

আপনারা জেগে উঠুন! টিম্বাকটু, মাসিনা, আরিবান্দা, কিদাল, গাও এবং সর্বত্র আপনার মুজাহিদীন ভাইদের সমর্থন করুন এবং শত্রুদের প্রোপাগান্ডায় ও ডাকে কান দেবেন না।”

জেএনআইএম এর আহ্বানে সাধারণ জনগণের মাঝে কেমন প্রতিক্রিয়া হয় তা হয়তো সামনের দিনগুলোতে পরিষ্কার হয়ে যাবে। আল্লাহ তা’আলা পৃথিবীর সকল স্থানের মুসলিমদের পূর্ণ নিরাপত্তা দান করুন। আমিন।

১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধবহিরাগতদের হামলায় আহত কাশ্মীরি ১২ ছাত্র, একপক্ষকেই শুধু গ্রেফতার
পরবর্তী নিবন্ধশাবাবকে নির্মূলের ঘোষণা দিয়ে ৩ দিনে ৮ শহর হাতছাড়া সোমালি সরকারের