আল্লাহ তাআলার নিকট আরবি ১২ টি মাসের মধ্যে চারটি মাস অত্যন্ত সম্মানিত। মুহাররম মাস হচ্ছে সে চারটি মাসের মধ্যে অন্যতম এবং প্রথম মাস। কুরআন মাজীদে ও হাদিস শরীফে এ মাসকে অত্যন্ত ফযীলতপূর্ণ মাস হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ মাসে অন্যান্য আমলের পাশাপাশি রোযা রাখার প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মুহাররম মাসের ১০ তারিখকে আরবিতে আশুরা বলা হয়। মুহাররম মাসের দশ তারিখের রোজা রাখাকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,
ما رأيت النبي صلى الله عليه وسلم يتحرى صيام يوم فضله على غيره إلا هذا اليوم يوم عاشوراء وهذا الشهر يعني رمضان
‘আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রমযান ও আশুরায় যেরূপ গুরুত্বের সঙ্গে রোযা রাখতে দেখেছি অন্য সময় তা দেখিনি।’
-সহীহ বুখারী ১/২১৮
হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু কে এক ব্যক্তি প্রশ্ন করেছিল, রমযানের পর আর কোন মাস আছে, যাতে আপনি আমাকে রোযা রাখার আদেশ করেন? তিনি বললেন, এই প্রশ্ন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট জনৈক সাহাবী করেছিলেন, তখন আমি তাঁর খেদমতে উপস্থিত ছিলাম। উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘রমযানের পর যদি তুমি রোযা রাখতে চাও, তবে মুহাররম মাসে রাখ। কারণ, এটি আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একটি দিন আছে, যে দিনে আল্লাহ তাআলা একটি জাতির তওবা কবুল করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অন্যান্য জাতির তওবা কবুল করবেন।’-জামে তিরমিযী ১/১৫৭
অন্য হাদিসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
صيام يوم عاشوراء أحتسب على الله أن يكفر السنة التي قبله
‘আমি আশাবাদী যে, আশুরার রোযার কারণে আল্লাহ তাআলা অতীতের এক বছরের (সগীরা) গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন।’
-সহীহ মুসলিম ১/৩৬৭; জামে তিরমিযী ১/১৫৮
আশুরার দিন সম্পর্কে এক হাদীসে আছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
صوموا عاشوراء وخالفوا فيه اليهود، صوموا قبله يوما أو بعده يوما
‘তোমরা আশুরার রোযা রাখ এবং ইহুদীদের সাদৃশ্য পরিত্যাগ করো; আশুরার আগে বা পরে আরো একদিন রোযা রাখ।’
-মুসনাদে আহমদ ১/২৪১
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘আমি যদি আগামী বছর বেঁচে থাকি তাহলে ৯ তারিখেও অবশ্যই রোযা রাখব।’-সহীহ মুসলিম ১/৩৫৯
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত এক হাদিসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, أفضل الصيام بعد رمضان شهر الله المحرم
‘রমযানের পর আল্লাহর মাস মুহাররমের রোযা হল সর্বশ্রেষ্ঠ।’
-সহীহ মুসলিম ২/৩৬৮; জামে তিরমিযী ১/১৫৭
আশুরা দিনের ঐতিহাসিক ঘটনা
মহররম মাসে পৃথিবীর বহু ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এদিনে আল্লাহ তাআলা বনি ইসরাইলের জন্য সমুদ্রে রাস্তা বের করে দিয়েছেন এবং তাদেরকে নিরাপদে পার করে দিয়েছেন। আর একই রাস্তা দিয়ে ফেরাউন ও তার অনুসারীদেরকে ডুবিয়ে মেরেছেন।-সহীহ বুখারী ১/৪৮১
আশুরা দিনের কিছু বাড়াবাড়ি যা অবশ্য বর্জনীয়
এ দিনের গুরুত্ব প্রকাশ করতে গিয়ে অনেকে নানা ভিত্তিহীন কথাও বলে থাকেন। যেমন, এদিন হযরত ইউসুফ আলাইহিসসালাম জেল থেকে মুক্তি পেয়েছেন। হযরত ইয়াকুব আলাইহিসসালাম চোখের জ্যোতি ফিরে পেয়েছেন। হযরত ইউনুস আলাইহিসসালাম মাছের পেট থেকে মুক্তি পেয়েছেন। হযরত ইদরীস আলাইহিসসালামকে আসমানে উঠিয়ে নেওয়া হয়। অনেকে বলে, এদিনেই কিয়ামত সংঘটিত হবে। এসব কথার কোনো ভিত্তি নেই। -আল আসারুল মারফূআ, আবদুল হাই লাখনেবী ৬৪-১০০; মা ছাবাহা বিসসুন্নাহ ফী আয়্যামিস সানাহ ২৫৩-২৫৭
এ মাসের একটি ঘটনা হল হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর শাহাদাত। এ উম্মতের জন্য এই শোক সহজ নয়। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এরই তো শিক্ষা; ‘নিশ্চয়ই চোখ অশ্রুসজল হয়, হৃদয় ব্যথিত হয়, তবে আমরা মুখে এমন কিছু উচ্চারণ করি না যা আমাদের রবের কাছে অপছন্দনীয়।’
অন্য হাদীসে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই যারা মুখ চাপরায়, কাপড় ছিড়ে এবং জাহেলী যুগের কথাবার্তা বলে।’
অতএব হুসাইন রাদিয়াল্লাহুর শাহাদাতকে কেন্দ্র করে কোনো ধরনের অনৈসলামিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত না হওয়া এবং সব ধরনের জাহেলী রসম-রেওয়াজ থেকে দূরে থাকা প্রত্যেক মুসলিমের অবশ্য কর্তব্য।
এ মাসে যেসব অনৈসলামিক কাজকর্ম ঘটতে দেখা যায় তার মধ্যে তাজিয়া, শোকগাঁথা পাঠ, শোক পালন, মিছিল ও র্যালি বের করা, শোক প্রকাশার্থে শরীরকে রক্তাক্ত করা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। এসব রসম-রেওয়াজের কারণে এ মাসটিকেই অশুভ মাস মনে করার একটা প্রবণতা অনেক মুসলমানের মধ্যেও লক্ষ করা যায়।
এজন্য অনেকে এ মাসে বিয়ে-শাদী থেকেও বিরত থাকে। সুতরাং অনৈসলামিক এসকল ধারণা ও কুসংস্কার থেকে বিরত থাকা উচিত।