
সোমালিয়ায় পশ্চিমা সমর্থিত মোগাদিশু সরকার এখন নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংকটের মুখোমুখি। কেননা দেশটির জনপ্রিয় সশস্ত্র ইসলামি প্রতিরোধ বাহিনী হারাকাতুশ শাবাব আল-মুজাহিদিন রাজধানী মোগাদিশু থেকে মাত্র ছয় কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছে এবং অনেক শহর অবরোধ করে রেখেছে।
সোমালিয়ার হিরান রাজ্যের পূর্বাঞ্চল এক দশকেরও বেশি সময় ধরে নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন হারাকাতুশ শাবাব প্রশাসন। গত জানুয়ারি ২০২৫ থেকে শাবাব নিয়ন্ত্রিত এই অঞ্চলটি দখলের উদ্দেশ্যে সামরিক আগ্রাসন শুরু করে পশ্চিমা সমর্থিত মোগাদিশু সরকার। কিন্তু এখানে এসে শাবাবের তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়ে মোগাদিশু বাহিনী, হতাহত হয় অনেক সেনা। ফলে মোগাদিশু বাহিনী এই অঞ্চলে আরও সামরিক শক্তিবৃদ্ধি করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আশ-শাবাব মুজাহিদিনরাও ফেব্রুয়ারির ২০ তারিখ থেকে দক্ষিণ সোমালিয়ার মধ্য শাবেলির দিক থেকে পাল্টা আক্রমণ শুরু করেন। দক্ষিণাঞ্চলে শাবাবের নতুন এই আক্রমণ শুরুর ফলে মোগাদিশু বাহিনীর সকল কৌশল ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে শুরু করে। শাবাবের প্রথম ৩ দিনের অভিযানেই মধ্য শাবেলির ২৫০ কিলোমিটার এরও বেশি এলাকা মোগাদিশু বাহিনীর হাতছাড়া হয়ে পড়ে।
এরপর মোগাদিশু বাহিনী আন্তর্জাতিক জোট বাহিনীর বিমান সহায়তা নিয়ে শত চেষ্টা সত্ত্বেও শাবাবের অগ্রগতি আর ঠেকাতে পারে নি, যা আশ-শাবাবকে এখন রাজধানী মোগাদিশুর উপকন্ঠে নিয়ে এসেছে। এই দৃশ্যগুলো দেখার পর বিশ্লেষকগণ প্রশ্ন তুলছেন যে, “রাষ্ট্রপতি হাসান শেখ এতোদিন ধরে মিথ্যা প্রচার করে আসছে, কীভাবে সে আশ-শাবাবকে ধ্বংস করেছে এবং মোগাদিশু এখন এই অঞ্চলের অন্য যেকোনো শহরের মতোই নিরাপদ শহর”। আর সেই সুযোগে আশ-শাবাব নিজেদেরকে পুনর্গঠন, পুনঃপ্রশিক্ষিত এবং রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য পরিপক্ব করে তুলেছে, যা আশ-শাবাবকে আরও বৃহত্তর এবং আরও বড়ধরণের বিজয়ের জন্য আশাবাদী করে তুলেছে।
ফলে আমরা এখন দেখছি, আশ-শাবাব মুজাহিদিনরা রাজধানীর উত্তর দিক থেকে, তীব্র লড়াইয়ের মাধ্যমে মোগাদিশু বাহিনীর দীর্ঘ ৩ বছরের অবরোধ ভেঙে তাদের নিয়ন্ত্রিত উত্তরাঞ্চলীয় জালাজদুদ রাজ্যকে কেন্দ্রীয় অঞ্চলের সাথে একীভূত করেছেন। দুটি অঞ্চলের মাঝের প্রায় ১১ কিলোমিটারের এই এলাকা ২০২২ সালের যুদ্ধে মোগাদিশু বাহিনী দখল করতে সময় নিয়েছিল প্রায় ৫ মাস, অপরদিকে আশ-শাবাব এই এলাকা পুনরুদ্ধার করতে সময় নিয়েছেন মাত্র ২ দিনেরও কম।
এদিকে হারাকাতুশ শাবাব যোদ্ধারা দক্ষিণ দিক থেকে, তুর্কি সামরিক শিবিরগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেওয়া ও বুরুন্ডিয়ান বাহিনীকে অবরুদ্ধ করে রাখার মাধ্যমে ২০১৯ সালের যুদ্ধে মোগাদিশু বাহিনীর দখল করা এলাকাগুলো মাত্র ৮ দিনের মধ্যে পুনরুদ্ধার করেছেন। একই এলাকা দখল করতে মোগাদিশু বাহিনী ৮ মাস সময় নিয়েছিল। আশ-শাবাব মুজাহিদিন এই অগ্রগতির মাধ্যমে রাজধানী মোগাদিশুর সাথে সংযোগকারী ৪টি সেতুর মধ্যে ৩টির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন এবং অন্যটির দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। এমনিভাবে মুজাহিদিনরা দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় বালদাউইন শহরকে ৩দিন থেকে ঘিরে ধারার মাধ্যমে ইথিওপিয়ান বাহিনীকে এই অঞ্চলে আটকে রেখেছেন। একইভাবে দক্ষিণের কারিউলী জেলা ও বুলুমারির শহরকে অবরোধের মাধ্যমে মুজাহিদিনরা এই অঞ্চলে মোগাদিশু বাহিনীর ১০ হাজার সৈন্য এবং উগান্ডার ১ হাজার সৈন্যকে অবরুদ্ধ করে রেখেছেন, যাদের পালানোর কোনো পথ নেই।
আর শাবাব মুজাহিদিন অবরুদ্ধ এসকল এলাকায় আটকা পড়া মোগাদিশু বাহিনীকে যুদ্ধের ময়দান ত্যাগ করা এবং আত্মসমর্পণের শর্তে সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে সোমালি ন্যাশনাল আর্মির (মোগাদিশু বাহিনী) বিপুল সংখ্যক সৈন্য সামরিক বাহিনী ত্যাগ করতে শুরু করেছে। ফলে মোগাদিশু সরকারের রাষ্ট্রপতি হাসান শেখ মোহাম্মদ যুদ্ধের ময়দানের জন্য অপ্রশিক্ষিত পুলিশ, সামরিক বাহিনীর মহিলা সদস্য এবং কারাক্ষীদের ফ্রন্টলাইনের সামনের সারিতে পাঠাচ্ছে, আর হাসান শেখ শাবাবের ভয়ে লুকোচুরি খেলছে। যেমনটা দেখা গেছে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের ফটকে হাসান শেখের গাড়ি বহরে শাবাবের হামলার পর, নিরাপত্তার জন্য রাজধানী থেকে ২৩০ কিলোমিটার দূরের শহরে আশ্রয় নেওয়ার সময়।
রাষ্ট্রপতি হাসান শেখ হয়তো এখনো তার সরকারের ভাগ্য ঝুলিয়ে রেখেছেন এই আশায় যে, কোনও সহানুভূতিশীল বিদেশী শক্তি তাকে উদ্ধার করতে আসতে পারে। কিন্তু এমন কোনো লক্ষণ এখনো চোখে পড়ছে না, কেননা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় আসা ট্রাম্প প্রশাসন সোমালিয়ায় নিরাপত্তা সহায়তা স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছে। আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যারা দীর্ঘদিন ধরে মোগাদিশু সরকারকে নিরাপত্তা সহায়তা দিয়ে আসছিল, তারা এখন ইউক্রেনের প্রতিরক্ষার জন্য অর্থ খুঁজে বের করতে ব্যস্ত। এমন পরিস্থিতিতে মোগাদিশু সরকারের পরম মিত্র ইথিওপিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে বিমান সহায়তার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে দেখা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে কিছুটা আগ্রহী ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে তুরস্ককে, দেশটি শাবাবকে প্রতিহত করতে মোগাদিশু বাহিনীকে প্রশিক্ষণ, বিমান সহায়তা, ড্রোন হামলা এবং সর্বশেষ কার্গো বিমানে করে অস্ত্র সহায়তা করেছে।
এছাড়া দেশটিতে অবস্থান নেওয়া জাতিসংঘের নেতৃত্বাধীন আফ্রিকান জোট (AUSSOM) বাহিনীর সদস্যভুক্ত ৭টি দেশের সেনাবাহিনীর অধিকাংশ সামরিক ঘাঁটিই ইতিমধ্যে শাবাবের নিয়ন্ত্রিত এলাকার বেড়াজালে কঠিন অবরোধের মধ্যে পড়ে গিয়েছে। ফলে তারাও স্থল পথে মোগাদিশু বাহিনীকে সহায়তায় সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারছে না।
আর সপ্তাহান্তে, আশ-শাবাব যোদ্ধাদের একটি বড় দলকে সোমালিয়ার রাজধানী মোগাদিশুর উপকন্ঠে অগ্রসর হতে দেখা গেছে। শাবাবের ইস্তেশহাদী ব্রিগেডের ১ হাজার সদস্যসহ এই দলের সদস্য সংখ্যা ১৭ হাজার পর্যন্ত ধারণা করা হচ্ছে, যারা রাজধানীতে প্রবেশের জন্য কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সবুজ সংকেতের অপেক্ষায় আছেন।
বর্তমানে শাবাব মুজাহিদিনরা রাজধানীর উত্তরের বালাদ, দক্ষিণের আদান-ইয়াবাল এবং উপকূলীয় আফগোয়ে ফ্রন্ট থেকে শহরের কেন্দ্রের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। এই দলটির মুজাহিদিনরা রাজধানীর দিকে প্রবেশের ৩টি গুরুত্বপূর্ণ ফটক নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার মাধ্যমে মোগাদিশু সরকারের ৯০% সৈন্যকেই শহর থেকে বিচ্ছিন্ন করার কৌশল নিয়ে অগ্রসর হচ্ছেন। এতে করে বিচ্ছিন্ন এসকল সৈন্যরা হয়তো যুদ্ধের ময়দান ত্যাগ করবে নয়তো আত্মসমর্পণ করবে। যেমনটি দেখা গেছে রাজধানী মোগাদিশুর দক্ষিণের গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশপথে অবস্থিত “বারিরী” শহরে। এই শহরটি শাবাব মুজাহিদিনরা ৩দিক থেকে অবরোধ করলে, শহরের ভিতর থাকা মোগাদিশু বাহিনীর প্রায় ১,৪০০ সেনা মুজাহিদদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পরিবর্তে পিছু হটা বেছে নেয়। অথচ শহরটি অবরোধে শাবাবের মাত্র ২০০ এরও কম যোদ্ধা অংশ নিয়েছিল। মোগাদিশু সৈন্যদের “লড়াই করতে অস্বীকৃতি জানানোর” এই ধরণটি অনেক ফ্রন্টেই পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে, মোগাদিশুতে আশ-শাবাবের ক্রমবর্ধমান কঠোর অবরোধ ভাঙার জন্য মোগাদিশু সরকারের কাছে খুব কম বিকল্পই অবশিষ্ট আছে বলে মনে হচ্ছে। ফলে আশ-শাবাব মুজাহিদিনরা কেন্দ্রীয় অঞ্চলের উপকন্ঠে ও শহর বসবাসরত জনসাধারণকে আশ্বস্ত করতে শুরু করেছেন যে “শহুরে অঞ্চলে বড়ধরণের সংঘাত শুরু করার এবং বেসামরিক লোকদের ক্ষতি করার” ইচ্ছা তাদের নেই। বরং “মুজাহিদদের লক্ষ্য হল মোগাদিশুর নিয়ন্ত্রণ নেওয়া এবং ইসলামী শরিয়া ভিত্তিক একটি ন্যায়সঙ্গত ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।”