
রক্তাক্ত গাজার ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে যে প্রতিরোধের আগুন জ্বলছে, তা দিন দিন আরও প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠছে। আধুনিক অস্ত্র, বিমান হামলা, নিষ্ঠুর অবরোধ—কোনো কিছুই গাজার সাহসী যোদ্ধাদের দমিয়ে রাখতে পারেনি। দিনের পর দিন মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও তারা লড়ে চলেছে অসম এক যুদ্ধে, যেখানে ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোই একমাত্র অস্ত্র। অন্যদিকে, দখলদার ইসরায়েলি বাহিনীর মধ্যে দেখা দিচ্ছে গভীর বিভ্রান্তি, ক্লান্তি ও লক্ষ্যহীনতা।
যুদ্ধের শুরুতে যারা ঘোষণা করেছিল ‘সম্পূর্ণ বিজয়’, আজ তারাই নিজেরাই নিজেদের পরাজয়ের কথা বলছে। গাজার প্রতিরোধ এখন আর কেবল সামরিক নয় এটি হয়ে উঠেছে একটি আদর্শ, যা বিশ্বজুড়ে মানুষকে অনুপ্রাণিত করছে। বাস্তবতা বলছে, গাজা ধ্বংস হয়নি, বরং গড়ে তুলছে এক নতুন অধ্যায়ের ভিত্তি—অদম্য সাহসের, আত্মত্যাগের ও প্রতিরোধের।
সম্প্রতি প্রকাশিত একটি ভিডিও নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে। ভিডিওতে দেখা যায়, আল কাসসাম ব্রিগেডের একজন যোদ্ধা একটি সুড়ঙ্গপথ দিয়ে বের হয়ে একটি ইসরায়েলি মারকাভা ট্যাংকের নিচে বিস্ফোরক স্থাপন করে পুনরায় সুড়ঙ্গে ফিরে যান, তারপর একটি প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ট্যাংকটি ধ্বংস হয়।
مقاوم فلسطيني خرج فجأة من بين الأنقاض، وثبّت عبوة ناسفة على دبابة إسرائيلية من مسافة صفر، ثم عاد إلى مخبئه قبل أن تنفجر .
في غزة للصفر قيمة. pic.twitter.com/OvNwKZwago
— Tamer | تامر (@tamerqdh) ১০ জুন, ২০২৫
এ ধরণের ঘটনা আগেও দেখা গেছে, কিন্তু এবারের ভিডিওটি ব্যতিক্রম। কারণ এটি কোনো ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সংগঠন প্রকাশ করেনি। বরং, ভিডিওটি প্রকাশ করেছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী নিজেরাই।
এই ঘটনা নিয়ে উঠছে নানা প্রশ্ন: কেন দখলদার ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এমন একটি ভিডিও প্রকাশ করবে, যেখানে তাদের নিজস্ব সামরিক গর্ব মারকাভা ট্যাংকের ধ্বংস এবং একটি ফিলিস্তিনি যোদ্ধার সাহসিকতা তুলে ধরা হয়েছে?
বিশ্লেষকরা বলছেন, এর উত্তর লুকিয়ে আছে সন্ত্রাসী ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর ক্রমবর্ধমান হতাশায়। প্রায় আট মাস ধরে গাজা ধ্বংসস্তুপে পরিণত হলেও, ‘বিজয়’ এখনো অধরা।
এই বাস্তবতা এখন ইসরায়েলিদের মাঝেও প্রতিফলিত হচ্ছে। এক সময় ‘সম্পূর্ণ বিজয়’-এর প্রত্যাশা প্রচার করলেও, এখন ইসরায়েলি গণমাধ্যমেই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ‘সম্পূর্ণ পরাজয়’-এর সুর।
ইসরায়েলের প্রভাবশালী পত্রিকা Maariv-এ অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ইৎজাক ব্রিক লিখেছে, “আমরা সম্মিলিত আত্মহত্যার পথে যাচ্ছি। আমাদের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বই আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় বিপদ। আমরা এমন এক জায়গায় চলে এসেছি, যেখান থেকে ফিরে আসার পথ হয়তো আর নেই। এখন শুধু অলৌকিক কোনো ঘটনার অপেক্ষায় আছি।”
ব্রিকের বক্তব্যকে আর অবাস্তব বা অতিরঞ্জিত বলা যাচ্ছে না। সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে থাকা সেনারাও একই অনুভূতি প্রকাশ করছে। ইসরায়েলের আরেকটি প্রধান পত্রিকা Yedioth Ahronoth ১০ জুন, মঙ্গলবার প্রকাশ করেছে এক সেনার সাক্ষাৎকার, যেখানে সে বলেছে, “সবাই ক্লান্ত, বিভ্রান্ত। কেউ জানে না যুদ্ধের লক্ষ্য কী। আমরা আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষায় চলে এসেছি।”
মধ্যপ্রাচ্যের চলমান সংঘাত যেন এক মনোবলের লড়াইয়ে রূপ নিয়েছে, যেখানে টিকে আছে সেই পক্ষই যার হৃদয়ে রয়েছে ন্যায়ের দাবিতে আত্মত্যাগের দৃঢ় সংকল্প। গাজার প্রতিরোধ যোদ্ধারা প্রতিনিয়ত প্রমাণ করে চলেছেন, সাহস, একতা ও কৌশলের মাধ্যমে কীভাবে আধুনিক সামরিক শক্তিকে পেছনে ফেলা যায়। বছরের পর বছর অবরুদ্ধ থেকেও তারা আজ সেই সেনাবাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করছেন, যারা এক সময় নিজেদের ‘অজেয়’ দাবি করত। অন্যদিকে, ইসরায়েলি বাহিনীর ভেতরেই আজ প্রশ্ন উঠছে—কেন এই যুদ্ধ, কার জন্য, আর কতদিন? বিভ্রান্ত সেনারা এখন নিজেরাই জানে না যুদ্ধের লক্ষ্য কী। এই দৃশ্যপট শুধু গাজার নয়, এটি জুলুম আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে চলমান এক চিরন্তন সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি।
তথ্যসূত্র:
1. A Video Like No Other – Why the Israeli Army Has Revealed Its Own Failure
– https://tinyurl.com/ytajyecx