
মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে দেশটির জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ)। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) গত ২৮ জুলাই প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, আরাকান আর্মি নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় রোহিঙ্গাদের চলাচলে কারফিউ আরোপ, বাড়ি-ঘর লুটপাট, খামারে জোরপূর্বক শ্রম, আটক ও নির্যাতন এবং জোরপূর্বক তাদের বাহিনীতে ভর্তি করানো হচ্ছে।
২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষের পর কয়েকটি এলাকা দখল করে আরাকান আর্মি। শুরুতে তারা অংশগ্রহণমূলক ও ন্যায় শাসনের প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে রোহিঙ্গারা আরও কঠোর নিপীড়নের শিকার হয়েছে বলে এইচআরডব্লিউ জানিয়েছে। সংস্থাটির এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক এলেইন পিয়ারসন বলেন, ‘আরাকান আর্মিও এখন মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মতোই বৈষম্যমূলক ও দমনমূলক নীতি অনুসরণ করছে।’
বুথিডং থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা জানান, তাদের অনুমতি ছাড়া মাছ ধরা, কৃষিকাজ বা বাড়ির বাইরে চলাচল নিষিদ্ধ ছিল। খাদ্য সংকট এত তীব্র ছিল যে, মানুষ একে অপরের কাছে ভিক্ষা করে জীবনযাপন করত।
সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের জমি, গবাদিপশু, মাছ ধরার সরঞ্জাম এবং কবরস্থানও দখল করেছে। একাধিক গ্রামবাসীর ভাষ্যে, ধানক্ষেতে দাফনের নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।
এক রোহিঙ্গা জনান, ‘গত এক বছরে স্ত্রী ও দুই সন্তানসহ পাঁচবার আশ্রয় বদলাতে হয়েছে। গ্রাম থেকে গ্রামে যাতায়াতের জন্য আরাকান আর্মির অনুমতিপত্র প্রয়োজন, যা খুবই কম দেওয়া হয়।’ রোহিঙ্গারা জানান, বুথিডংয়ের গ্রামগুলোর মধ্যে যাতায়াতের জন্য এক দিনের অনুমতির দাম প্রায় ৩,০০০ থেকে ৫,০০০ কিয়াট (১.৪০-২.৪০ মার্কিন ডলার) এবং অনুমতিপত্রে আরাকান সেনাবাহিনী বা তাদের রাজনৈতিক শাখার স্বাক্ষর প্রয়োজন হয়।
তারা আরও জানান, ‘আরাকান সেনাবাহিনী কারফিউ জারি করেছে। কারফিউ চলাকালে কাউকে বাড়ির বাইরে পেলে সঙ্গে সঙ্গে ধরে নিয়ে যায়, তারপর আর খোঁজ পাওয়া যায় না।’
এক রোহিঙ্গা শ্রমিক বলেন, ‘আমি আরাকান আর্মির দেওয়া যেকোনো কাজ করতাম। প্রথমে তারা অর্ধেক বেতন দিত, পরে একেবারেই বেতন দেয়া বন্ধ করে দেয়।’
তিনজন রোহিঙ্গা জানিয়েছেন, তারা তাদের সন্তানদের, যাদের মধ্যে শিশুরাও ছিল তাদেরকে আরাকান সেনাবাহিনীর জোরপূর্বক নিয়োগ থেকে রক্ষা করতে পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন।
৬২ বছর বয়সী এক রোহিঙ্গা বৃদ্ধ জানান, এপ্রিল মাসে কিন তাউং গ্রামের প্রশাসক তার ছেলেকে জোরপূর্বক আরাকান আর্মিতে নিয়োগের জন্য নির্বাচিত করে। তারা জোর করে যোগ দিতে বাধ্য করার চেষ্টা করছিল, আমি প্রতিনিয়ত ভয় পেতাম। ওরা দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের টার্গেট করে। আমার ছেলে ভয় পেয়ে ৪৫ দিন আগে গ্রাম ছেড়ে পালায়, তারপর থেকে সে নিখোঁজ।
আরাকান আর্মি ছেলেকে না পেয়ে তাকে গ্রেফতার করে এবং আরও দুজনের সঙ্গে ৩৫ দিন ধরে আটক রাখে। তিনি জানান, ‘তারা আমাকে নিয়মিত মারধর করত। শেষে আমি প্রতিশ্রুতি দেই যে, আমার ছেলেকে তাদের কাছে নিয়ে যাব, তখন তারা আমাকে মুক্তি দেয়। পরবর্তীতে আমি আত্মগোপনে চলে গেলে আরাকান আর্মি আমার বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। এ অবস্থায় বাংলাদেশে পালানো ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না।’
২০২৪ সালের মে মাসে নগা ইয়াত চাউং গ্রাম থেকে জোরপূর্বক শ্রমের জন্য অপহৃত এক ১৯ বছর বয়সী রোহিঙ্গা যুবক পাঁচ মাস আরাকান সেনাবাহিনীতে ছিলেন। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের প্রায়শই সামনের সারিতে ‘মানব ঢাল’ হিসেবে পাঠানো হতো। প্রতিবাদ করলে মারধর ও উপহাসের শিকার হতাম। আমরা কেন সমানভাবে আচরণ পাচ্ছি না জানতে চাইলে তারা ‘বাঙালি কালার’ বলে ডাকে, এই শব্দটি তারা মুসলিমদের গালি দেয়ার জন্য ব্যবহার করে।
এইচআরডব্লিউ জানায়, চলমান সংঘাতে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মি উভয়ই রোহিঙ্গাদের ওপর নির্বিচার সহিংসতা চালিয়েছে। ২০২৪ সালের মে থেকে কক্সবাজারে নতুন করে ১ লাখ ২০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী নিবন্ধিত হয়েছেন, যাদের অনেকেই সহায়তা থেকে বঞ্চিত।
সংস্থার মতে, বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের ওপর জোর দিলেও সেখানে নিরাপদ, সম্মানজনক ও টেকসই প্রত্যাবাসনের পরিবেশ এখনও তৈরি হয়নি।
তথ্যসূত্র:
1. Myanmar: Arakan Army Oppresses Rohingya Muslims
– https://tinyurl.com/4dzs9haa


