ইউক্রেন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাওয়া শরনার্থীদের ইউরোপীয় ইউনিয়ন উষ্ণ অভ্যর্থনা দিয়ে গ্রহণ করতে দেখা যাচ্ছে।
যে ইউরোপ ইউক্রেনের মানুষকে অভ্যর্থনা দিয়ে গ্রহণ করতে দেখা গেছে, এরাই ২০১৫ সিরিয়া থেকে পালিয়ে যাওয়া শরনার্থীদের লাথি মেরে তাড়িয়ে দিতে চেয়েছিল।
২০১৮ সালে হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান বলেছিল, ‘আমরা এই লােকগুলােকে মুসলিম উদ্বাস্ত হিসেবে দেখি না, আমরা তাদেরকে আক্রমণকারী মুসলিম হিসেবে দেখি….’।
কিছুদিন আগেও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সীমান্তে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম শরণার্থীদেরকে না খেয়ে আর ঠাণ্ডায় জমে মারা যেতে দেখা গিয়েছে। কিন্তু বর্বর ইউরোপীয়দের মন গলেনি; আর কোন দেশ ঐ মুমূর্ষু মুসলিমদের জন্য সীমান্তও খুলে দেয়নি আবার ত্রান বা অন্য কোন সহায়তাও দেয়নি।
আর ভূমধ্য সাগরে তো মুসলিম শরণার্থী বোঝাই নৌকা গুলি করে দুবিয়ে দেওয়ার ঘটনাও প্রায় সময়ই ঘটাচ্ছে বর্বর রোমানদের উত্তরসূরি এই অসভ্য ইউরোপিয়ানরা। কিন্তু নিজেদের জাতিভাই ইউক্রেনিয়ানদের জন্য তারা সাহায্যের হাত ঠিকই বাড়িয়ে দিয়েছে, খুলে দিয়েছে সীমান্তও। অস্ত্র-অর্থ দিয়ে সাহায্য করছে তাদের।
অন্যদিকে, সম্প্রতি ইউক্রেন ইস্যুতে হলুদ মিডিয়ার ইসলাম বিরোধী মনোভাব আরও জঘন্য হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। একের পর এক মুসলিম বিদ্বেষী বক্তব্য আর ঘৃণা ছড়াচ্ছে তারা।
উইক্রেনের শরনার্থীদের সম্পর্কে আমেরিকান টিভি চ্যানেল ‘এনবিসি নিউজের’ এক সাংবাদিককে বলতে দেখা যায় যে, ‘এসব মানুষ হচ্ছে সভ্য, নীল চোখওয়ালা, তারা সিরিয়া থেকে আসা উদ্বাস্তু না, তারা ইউক্রেন থেকে আসা উদ্বাস্তু, তারা সাদা, তারা খ্রিস্টান।’
রাশিয়া ও ইউক্রেনের চলমান যুদ্ধ থেকে মুসলিম বিশ্বের জন্য অনেকগুলো বিষয় স্পষ্ট হচ্ছে। প্রত্যেক মুসলিমের জন্য এই বিষয়গুলো ভাল করে বুঝে নেয়া উচিত।
১। ঔপনিবেশিক আমল থেকে ইউরোপ মুসলিম বিশ্বকে নীচু, অসভ্য ও শাসিত হওয়ার জন্যই জন্মগ্রহণকারী অমানুষ বলে প্রচার করে আসছে৷ তাদের এই ধারণা আজও একটুও বদলায়নি। যেটা ইউক্রেনের পক্ষ অবলম্বন করতে গিয়ে তথাকথিত আন্তর্জাতিক অনেক সংবাদকর্মী, মানধিকারকর্মী ও রাজনীতিবিদরা বলে বেড়াচ্ছে। এরা ইউক্রেনের জন্য যুদ্ধকে অস্বাভাবিক মনে করলেও ঠিক একই পরিণতি সিরিয়া, ইরাক, ফিলিস্তিন, আফগান, ইয়েমেনের জন্য স্বাভাবিক ও জরুরি মনে করে। এরা বলছে, যুদ্ধ মারামারি এসব তো ইউক্রেনের মত সভ্য একটা দেশের উপর চাপিয়ে দেয়া যায় না। এগুলো তো সিরিয়া, ইরাক, আফ্রিকার মত রাষ্ট্রগুলোতে মানায়।
২। পশ্চিমাদের হিউম্যান রাইটস, জাতিসংঘ, মানবতাবাদ এসব কিছুই মুসলিমদের জন্য না। কারণ মুসলিমরা তাদের কাছে ‘হিউম্যান বিয়িং’ তথা বিশেষ চিন্তার মানুষ না। এগুলো কেবল ইউক্রেন ও পশ্চিমা ‘বিশেষ সত্ত্বা ধারণকারী’ হিউম্যানদের জন্য। ফলে এগুলোর পিছনে ঘুরে ঘুরে মুসলিম বিশ্বের কোন মূল্য নেই।
৩। প্রচলিত মিডিয়া সিস্টেম কখনোই মুসলিমদের পক্ষে না। ইউক্রেনের দুয়েকটা শিশুর কান্নাকাটির ছবি নিয়ে হলুদ মিডিয়া ও পশ্চিমারা- একই সাথে মুসলিম বিশ্বের কথিত সুশীল শ্রেণি যে মায়াকান্না দেখাচ্ছে তার একভাগও ইরাক, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, আফ্রিকা, ইয়েমেন, আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। অথচ এসব রাষ্ট্রে পশ্চিমা বিশ্ব এবং রাশিয়ার (সিরিয়াতে বিশেষ করে) হাতে শিশু সহ লক্ষ্য লক্ষ্য মুসলিম নিহত হয়েছে। এখনো ক্ষুধায় ঘাস খাওয়া শিশু পাওয়া যায় সেখানে। আজকে যখন ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধ চলছে ঠিক সেই সময়েও ইহুদি সন্ত্রাসীরা ফিলিস্তিনের শিশুদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে আকসার প্রাঙ্গণ থেকে। তাদের বাড়িঘর জবরদখল করছে। কিন্তু ইয়াহুদিবাদী ইউক্রেনের জন্য তাদের সকল মায়াকান্নার অশ্রু ঝরলেও, দশকের পর দশক মুসলিম বিশ্বের এই অবস্থাতে তারা আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে আসছে।
ভারতের অবস্থাই ধরা যাক। সেখানে মুসলিমরা নিয়মিত নির্যাতিত ও বঞ্চিত হচ্ছে। তারা একটা জেনোসাইড বা গণগত্যার দুঃস্বপ্নে জীবনপার করছে। সেটা নিয়ে কোন মিডিয়া কিংবা বিশ্বমোড়লদের খুব একটা হা-হুতাশ নেই। এমনকি মুসলিম দেশগুলোর দালাল শাসকগোষ্ঠীরও নূন্যতম কোন মন্তব্য নেই এটা নিয়ে। অথচ তারাও ইউক্রেন নিয়ে খুব মাতোয়ারা।
আমেরিকা যে আফগানের পুরো ফরেন রিজার্ভ ডাকাতি করে নিয়ে নিল- সেটা নিয়ে কিন্তু কথিত সুশীল বিশ্বের লোকেদের তেমন একটা শব্দ করতে দেখবেন না।
অধিকন্তু, ইউরোপীয় রাষ্ট্রের জনগণকে এইসব বিষয় নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করতেও দেখবেন না খুব একটা। তাদের ভাবখানা যেন এমন যে, এগুলো ঠিকই আছে। মুসলিম বিশ্বের জন্য এটাই পাওনা।
৪। মুসলিমদের জন্য যে অস্ত্রধারণ ও ইশতেশহাদী হামলাকে দশকের পর দশক পশ্চিমাবিশ্ব একটা ঘৃণ্য ও জঘণ্য বস্তু হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে, আজ তারাই ইউক্রেনের ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলোকে বীরত্ব ও মর্যাদাকর হিসেবে উপস্থাপন করছে। তাহলে কি একমাত্র ইসলাম ও মুসলিমেরর জন্যই অস্ত্রের ব্যবহার নিষিদ্ধ.?! কিন্তু তাদের কথিত মানবতাবাদ, জাতীয়তাবাদ, সেকুলারিজম এসবের প্রতিরক্ষা কিংবা তাদের পশুসভ্যতার নীতি অন্যদের উপর চাপিয়ে দেয়ার জন্য অস্ত্রের ব্যবহারকে বীরত্ব ও মর্যাদার বিষয় বলে প্রচার করে ঠিকই।
এই পশ্চিমারা মূলত বর্তমান বিশ্বে শান্তি, মানবতা, স্বাধীনতা, সমতা, নিরপেক্ষতা এই শব্দগুলো ব্যবহার করে সন্ত্রাসের চোরাপথ তৈরি করে যাচ্ছে দশকের পর দশক ধরে। কিন্তু আজকে যখন সবকিছু মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সামনে নানান ঘটনার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট করে দিচ্ছেন, তখন এই চোরাপথগুলোকে বন্ধ চিহ্নিত করে এগিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব মুসলিমদেরকেই নিতে হবে। নিজেদের অধিকার তাদের নিজেদেরকেই নিশ্চিত করতে হবে, নিজেদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বিধর্মীদের দাসত্ব থেকে মুক্ত করার সংগ্রাম শুরু করার এখনি উপযুক্ত সময় বলে মনে করছেন হকপন্থি উলামাগণ।
প্রতিবেদক : ইউসুফ আল-হাসান