রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) আওতাধীন পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পটি তিন দশকেও বাসযোগ্য না হওয়ার পেছনে অনেকখানি ভূমিকা রয়েছে আট প্রকৌশলীর একটি চক্রের। প্রধান প্রকৌশলী থেকে শুরু করে প্রকল্প পরিচালক (পিডি), অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক (এপিডি), প্রকল্প ব্যবস্থাপক (পিএম), সহকারী প্রকৌশলী, উপসহকারী প্রকৌশলী সব পদেই এই সিন্ডিকেট বা চক্রের লোকজন।
রাজউকের এক দক্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ‘আজকের পত্রিকা’কে বলেন, প্রকল্প এলাকায় রাস্তা-সেতু নির্মাণ, মাটি ভরাট, লেক খনন সবই তারা করে। মনিটরিংয়ের (তদারকি) দায়িত্বেও আবার তারাই। ফলে কাজের মান নিয়েও কোনো তথ্য বাইরে আসে না। রাজউকের সব বিভাগে বদলি থাকলেও পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে কোনো বদলি নেই। এভাবে চলতে থাকলে আরও এক যুগে প্রকল্পটি শেষ হবে না।
ওই কর্মকর্তার কথার সত্যতা পাওয়া যায় রাজউকের নথিপত্র পর্যালোচনা করেও। নথিপত্র ঘেঁটে আজকের পত্রিকা জানায়, ১৯৯৫ সালে শুরু হওয়া দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এই আবাসিক প্রকল্পের মেয়াদ এ পর্যন্ত সাতবার বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ ২০২২ সালের জুন থেকে বাড়িয়ে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু এই সময়সীমার মধ্যেও প্রকল্পের কাজ শেষ হবে কি না, তা নিয়ে রাজউকের কর্মকর্তারাই সন্দিহান।
এ অবস্থায় নিজেদের ব্যর্থতার দায় ঢাকতে প্রকল্প অসমাপ্ত অবস্থায়ই আগামী ডিসেম্বরে ‘ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট অব পূর্বাচল’ নামে নতুন আরেকটি প্রকল্প হাতে নিচ্ছে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী-কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে গৃহায়ণ ও গণপূর্তসচিব মো. নবীরুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প কেন যুগ যুগ ধরে টেনে ধরে রাখা হচ্ছে, তা আমরা খতিয়ে দেখছি। কারও গাফিলতির প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজউকের সব শাখায় নিয়মিত বদলি হলেও প্রকৌশল শাখায় তা হয় না। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় অসংগতি দেখা যায় পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে। একেকজন প্রকৌশলী বছরের পর বছর এই প্রকল্পেই কাটিয়ে দিচ্ছে। প্রকল্প যথাসময়ে বাস্তবায়ন না হলেও তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা হয়নি।
প্রকৌশলীদের বদলি না হওয়ার বিষয়ে পূর্তসচিব বলেন, রাজউকের বদলি সংক্রান্ত বিষয় তারা নিজেরাই দেখে। এ বিষয়ে রাজউক চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মো. ছিদ্দিকুর রহমান সরকার বলেন, ‘আমি অল্প দিন হলো রাজউকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছি। রাজউককে আটটি জোনে ভাগ করা হচ্ছে। সেখানে প্রকৌশল বিভাগের লোকজনকেও নতুন করে দায়িত্ব দেওয়া হবে। আশা করছি, পূর্বাচলে যারা দীর্ঘদিন আছেন, তাদেরও এক মাসের মধ্যে বদলির আওতায় আনতে পারব।’
এমন আটজন প্রকৌশলীর তথ্য মিলেছে, যাদের কেউ কেউ ২০-২২ বছর ধরে পূর্বাচল প্রকল্পে আছেন। অভিযোগ আছে, তারাই প্রকল্প জিইয়ে রাখছেন নিজেদের বিত্ত বাড়ানোর স্বার্থে।
এমন প্রকৌশলীদের একজন হলো মোহাম্মদ মনিরুল হক। সে ২০০৯ সালে প্রকল্পটিতে যোগ দিয়েছিল প্রকল্প ব্যবস্থাপক হিসেবে। পরে পদোন্নতি পেয়ে অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক হয়। এরপর আরও এক ধাপ এগিয়ে প্রকল্প পরিচালকের পদ পেয়েছে। গত ১৫ বছরে প্রকল্পের কোনো অগ্রগতি না হলেও তার হাত দিয়ে খরচ হয়েছে কয়েক শ কোটি টাকা।
প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ মনিরুল হক অবশ্য বলে, ‘একই প্রকল্পে অনেক দিন থাকার বিষয়টি তো আমাদের ওপর নির্ভর করে না। এটি চেয়ারম্যান নির্ধারণ করেন। একই জায়গায় দীর্ঘ সময় থাকায় প্রকল্পের ক্ষতি হচ্ছে—এমন অভিযোগ সত্য নয়। আমরা কাজ করে যাচ্ছি, কর্তৃপক্ষ যেখানে দায়িত্ব দেবে, সেখানেই কাজ করব।’
জানা যায়, ২০০৯ সালে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে যোগদানকারী মো. আবু সাঈদ খন্দকারও এতকাল এই প্রকল্পেই আছে। বর্তমানে সে প্রকল্প ব্যবস্থাপক। সেই সঙ্গে পূর্বাচল হাইরাইজ অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পের পিডির পদটিও বাগিয়েছে। প্রকৌশলী মোহাম্মদ বদিউল আলমও ২০১৮ সাল থেকে আছে প্রকল্প ব্যবস্থাপক পদে। পূর্বাচলের অস্বাভাবিক ব্যয়ের পানি সরবরাহ প্রকল্পেরও সে প্রকল্প পরিচালক। যদিও ৩০টি সেক্টরের মধ্যে মাত্র তিনটিতে সে পানি সরবরাহ করতে পেরেছে।
রাজউকের নথিপত্র ঘেঁটে আজকের পত্রিকা জানায়, ২০১৮ সাল থেকে পূর্বাচল প্রকল্পে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে আছে আশরাফুল ইসলাম ও সাদ্দাম হোসেইন। উভয়েই প্রকল্প ব্যবস্থাপকের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছে। ২০০০ সাল থেকে এই প্রকল্পে আছে প্রকৌশলী ওয়াহেদুজ্জামান, আলতাফ হোসেন ও বিজন কুমার সাহা। তারা উপসহকারী প্রকৌশলী থেকে পদোন্নতি পেয়ে সহকারী প্রকৌশলী হলেও পূর্বাচল ছাড়তে হয়নি। প্রকৌশলী উজ্জল মল্লিক ২০০৯ সালে প্রকল্প কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দিয়ে এক দফা পদোন্নতি পেয়ে অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক হয়। পরে আবার পদোন্নতি পেয়ে প্রকল্প পরিচালক হয়ে ২০২০ সাল পর্যন্ত ছিল। একপর্যায়ে সে সংস্থার প্রধান প্রকৌশলী হলেও পিডির পদ ছাড়েনি। তবে অনিয়মের অভিযোগে পরে তাকে পিডির পদ থেকে সরানো হয়। দায়িত্ব দেওয়া হয় তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আমিনুর রহমান সুমনকে। কিন্তু প্রকৌশলীদের সিন্ডিকেটের চাপে তিনি তিন মাস পরই কেটে পড়েন। প্রকৌশলী আমিনুর রহমান সুমন অবশ্য এ বিষয়ে কিছু বলতে রাজি হননি।
রাজউক সূত্রে জানা যায়, পূর্বাচলকে একটি আধুনিক শহর বানাতে ৬ হাজার ২৭৭ দশমিক ৩৬ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। পুরো প্রকল্পকে ৩০টির বেশি সেক্টরে ভাগ করে সেখানে ২৬ হাজার ২১৩টি আবাসিক প্লট করা হয়েছে। সর্বশেষ সংশোধন অনুযায়ী ব্যয় ৬ হাজার ৪৪৮ কোটি টাকা ধরা হয়েছে। কাগজে-কলমে প্রকল্পের উন্নয়নকাজ শেষ বলা হলেও অভ্যন্তরীণ রাস্তা ও সারফেস ড্রেন, লেক উন্নয়ন, সেন্ট্রাল আইল্যান্ড, নিষ্কাশন ব্যবস্থা, ফুটপাত নির্মাণের কাজ বাকি।
বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে পিডি মোহাম্মদ মনিরুল হক জানায়, নিরাপত্তার জন্য গত এপ্রিল মাসে ৫০ জন আনসার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।৩৬৫ কিলোমিটার রাস্তার মধ্যে কাজ শেষ হয়েছে ৩৫০ কিলোমিটারের। ৪৩ কিলোমিটার দীর্ঘ লেক খনন শেষ হয়েছে। ২৬ হাজার ২১৩টি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হলেও নকশা অনুমোদন হয়েছে মাত্র ৩৬৩টি। স্থাপনা নির্মাণ হচ্ছে ৬০-৭০টি প্লটে। তবে লেকের মাটি কোথায় কাজে লাগানো হয়েছে, জানতে চাইলে মনিরুল হক কিছু বলতে রাজি হয়নি।
তথ্যসূত্র:
১. ৮ প্রকৌশলীর চক্রে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প – https://tinyurl.com/587ehvxa