
পতিত আওয়ামী সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘ব্যক্তিগত অভিপ্রায়’ পূরণে কেনা হয় রাজধানীর পুরান ঢাকার ‘রোজ গার্ডেন’ নামে বাড়িটি। বাড়িটি কিনতে রাষ্ট্রকে গুনতে হয় ৩৩১ কোটি ৭০ লাখ টাকা। একই সঙ্গে শতকোটি টাকা মূল্যের বাড়িসহ গুলশানের এক বিঘা জমির মালিকানা ছাড়তে হয় সরকারকে।
বাড়িটি কেনা, দলিল ও অর্থ পরিশোধ থেকে শুরু করে পরতে পরতে দুর্নীতি ও অনিয়ম হয়েছে বলে অভিযোগ গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের একাধিক উপদেষ্টা জানিয়েছে, শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত ইচ্ছাপূরণে সরকারি ক্রয় আইনসহ প্রচলিত তিনটি আইন ও বিধি লঙ্ঘন করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। এ-সংক্রান্ত নথি আমরা যতই পর্যালোচনা করছি, ততই বিস্মিত হচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী পদে থেকে হাসিনা তার নির্বাহী ক্ষমতার নজিরবিহীন অপপ্রয়োগ করে।
গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের অভিযোগ, এক ব্যক্তির কাছ থেকে একটি বাড়ি কেনা ও বিনিময়ে আরেকটি বাড়ি দেওয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের প্রচলিত সব আইন ও বিধি-বিধান ভঙ্গ করা হয়েছে।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত এবং সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অভিযোগ, ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে ‘পুরাকীর্তি’ দেখিয়ে রাষ্ট্রের ৪০০ কোটি টাকার বেশি গচ্চা দেওয়ার সঙ্গে শেখ হাসিনা ছাড়াও সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং সাবেক সচিব মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন আহমেদ ও মোহাম্মদ শহীদ উল্লা খন্দকার প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল। এছাড়া অর্থছাড়ের সময় এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয় সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত এবং দাম বৃদ্ধির প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয় পলাতক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী। বাড়িটি কেনার পর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে নিয়ে নেয় তৎকালীন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ। বাড়িটি কেনার সময় নথিতে রোজ গার্ডেন হিসেবে দেখানো হলেও আসলে এটি ছিল ‘রশিদ মঞ্জিল’। বাড়ির মূল মালিক হুমায়ূন রশিদের নাম অনুসারে নামফলকেও রশিদ মঞ্জিল লেখা হয় বলে স্থানীয়রা জানিয়েছে।
হাসিনার ইচ্ছাপূরণে মন্ত্রীদের ভূমিকা
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ২০১৮ সালের শুরুতে শেখ হাসিনা নিজের অভিপ্রায় ব্যক্ত করে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে রোজ গার্ডেন নামের বাড়িটি সরকারের অনুকূলে অধিগ্রহণের নির্দেশনা দেয়। নির্দেশনাপত্রে কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, বাড়িটি ১৯৪৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ (পরে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ) গঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। হাসিনার এমন অভিপ্রায় তুলে ধরে কাজী আব্দুর রকিবের মালিকানাধীন বাড়িটি অধিগ্রহণ করার প্রস্তাব দিয়ে ওই বছরের ৪ এপ্রিল গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে একটি পত্র দেয় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নাসির উদ্দিন আহমেদ।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধিশাখা-১০ বাড়িটি কেনার বিষয়ে ২৫ পৃষ্ঠার একটি নথি (নোট শিট) তৈরি করে। এর ভিত্তিতে তৈরি করা সারসংক্ষেপ চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হলে হাসিনা তাতে তাৎক্ষণিকভাবে অনুমোদন দেয়।
বাড়িটির দামের বিষয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ওই সময়কার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানান, যেহেতু এটি ব্যক্তিমালিকানাধীন বাড়ি, তাই এর প্রকৃত মূল্য যাচাই করার জন্য সরেজমিন যাই। সেখানে সাবেক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর ও ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনও ছিল। ভূমি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমেও খোঁজ নিয়ে বাড়িটির দাম ১০৫ কোটি ২৯ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়। বাড়িটির মালিকদের সঙ্গে এভাবেই কথা চূড়ান্ত হয়। আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও ড্রাফটিং বিভাগকে পাশ কাটিয়ে মন্ত্রী আনিসুল হকের হস্তক্ষেপের বিবরণ তুলে ধরা হয় নথিতে। সেই সঙ্গে ১০৫ কোটি টাকার বাড়ি ৩৩২ কোটি টাকা দিয়ে কেনার দায়িত্ব দেওয়া হয় সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতকে। টাকা ছাড়ের ক্ষেত্রে অর্থ মন্ত্রণালয় এ-সংক্রান্ত সবগুলো আইন লঙ্ঘন করে। এক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রীর বিশেষ নির্দেশনার কথা তুলে ধরা হয় গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের নোটের সারসংক্ষেপে। দফায় দফায় বাড়িটির দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে পলাতক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিশেষ ভূমিকার কথা বলা হয়েছে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের নথিতে।
দফায় দফায় বাড়ে বাড়িটির দাম
বাড়িটি কেনার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হওয়ার পর এর দাম নির্ধারণে অর্থ মন্ত্রণালয়, ভূমি মন্ত্রণালয় এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তার সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি মালিকপক্ষের সঙ্গে আলোচনা ও আশপাশের এলাকা ও অন্যান্য জমির দাম পর্যালোচনা করে বাড়িটির দাম ১০৫ কোটি ২৯ লাখ টাকা হতে পারে বলে প্রতিবেদন দেয়। পরবর্তীতে বাড়িটির মালিকের আপত্তি ও তার অমতের কথা উল্লেখ করে দাম ২১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা ধার্য করা হয়।
বাড়িটি কেনার জন্য গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ২০১৮ সালের ২৪ মে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এ-সংক্রান্ত একটি সারসংক্ষেপ পাঠায়। শেখ হাসিনা ওই সারসংক্ষেপ অনুমোদন করে বাড়িটি কেনার জন্য গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে ৩৪০ কোটি টাকা বরাদ্দের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেয়। পাশাপাশি বাড়ির মালিককে ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে উল্লেখ করে গুলশানের ১১৬ নম্বর রোডের সিইএস (এ)-৮-এর ১১ নম্বর হোল্ডিংয়ের এক বিঘা (২০ কাঠা) আয়তনের সরকারি বাড়িটি বরাদ্দের নির্দেশ দেয়। তবে বাড়ির মালিককে ৩৩১ কোটি ৭০ লাখ টাকা দেওয়ার প্রস্তাব অনুমোদন দেয় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। ২১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা ধার্য করার পর ৩৩১ কোটি ৭০ লাখ টাকা পরিশোধের বিষয়ে নথিতে বিস্তারিত কিছু উল্লেখ করা হয়নি।
প্রকৃতপক্ষে রোজ গার্ডেনের মালিক মৃত কাজী আব্দুর রকিবের পরিবার কত টাকা বুঝে পায়, সে বিষয়ে কোনো তথ্য জানা সম্ভব হয়নি। আব্দুর রকিবের স্ত্রী ও তিন সন্তানের নামে বরাদ্দ দেওয়া গুলশানের বাড়িতে সরেজমিনে গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সেখানে একটি ডেভেলপার কোম্পানি নির্মাণকাজ করছে। ডেভেলপার কোম্পানির মাধ্যমে জমির মালিকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে প্রতিষ্ঠানটি এ বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানায়।
তথ্যসূত্র:
১. হাসিনার ইচ্ছাপূরণে গচ্চা ৩৩২ কোটি টাকা
– https://tinyurl.com/7bhhw87z


