“যে ব্যক্তি ভূপৃষ্ঠে চলমান কোন শহীদকে দেখে চক্ষু শীতল করতে চায় সে যেন তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহুকে দেখে।”— মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ।
হযরত তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু কুরাইশ গোত্রের তাইম শাখার সন্তান। হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুও ছিলেন এই তাইম কবীলার লোক।
হযরত তালহা ইসলামের সূচনা পর্বেই মাত্র পনেরো বছর বয়সে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। প্রথম দিকে ইসলাম গ্রহণকারীদের (সাবিকিনে আওয়ালিন) মাঝে তিনি ছিলেন অষ্টম।
তিনি জীবদ্দশাতেই মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পবিত্র জবানে জান্নাত লাভের সুসংবাদ পেয়েছেন। এমনিভাবে, তিনি ছিলেন আহলে শূরার ছয় জনের একজন।
প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী এবং ধনী ব্যক্তিদের অন্যতম ছিলেন হযরত তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ রাযি.। অধিক শক্তি ও সাহসিকতার দরুন আরবরা তাঁকে “আসাদু কুরাইশীন” তথা কুরাইশদের সিংহ উপাধি দিয়েছিল।
মুসা ইবনে তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ বলেন, তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহর চেহারা ছিল খুবই সুন্দর। লালমত ফর্সা। পা ছিল পুরো। মাঝারী উচ্চতার ছিলেন তিনি। কাঁধ ও বুক ছিল প্রশস্ত। কেশ ছিল ঘন; কুঁকড়ানো বা ঝুলন্ত ছিল না।
তাঁর ইসলাম গ্রহণের ঘটনাটি বড় চমকপ্রদ। তিনি গেছেন কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলার সাথে সিরিয়ায়। তাঁরা যখন বসরা শহরে পৌঁছালেন, দলের অন্য কুরাইশ ব্যবসায়ীরা তাঁর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাজারের বিভিন্ন স্থানে কেনা-বেচায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তিনি বাজারের মধ্যে ঘুরাফেরা করছেন, এমন সময়ের একটি ঘটনা তালহার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তিনি বলেন,
‘আমি তখন বসরার বাজারে। একজন খৃস্টান পাদ্রীকে ঘোষণা করতে শুনলাম, ‘ওহে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়! আপনারা এ বাজারে আগত লোকদের জিজ্ঞেস করুন, তাদের মধ্যে মক্কাবাসী কোন লোক আছে কিনা। আমি নিকটেই ছিলাম। দ্রুত তার কাছে গিয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ, আমি মক্কার লোক।’ জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কি আহমাদ আত্মপ্রকাশ করেছেন?’ বললাম, ‘কোন আহমাদ?’
বললেন, ‘আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল মুত্তালিবের পুত্র। যে মাসে তিনি আত্মপ্রকাশ করবেন, এটা সেই মাস। তিনি হবেন শেষ নবী। মক্কায় আত্মপ্রকাশ করে কালো পাথর ও খেজুর উদ্যান বিশিষ্ট ভূমির দিকে হিজরত করবেন। যুবক, তোমার খুব তাড়াতাড়ি তাঁর কাছে যাওয়া উচিত।’ তালহা বলেন, ‘তাঁর এ কথা আমার অন্তরে দারুণ প্রভাব সৃষ্টি করলো। আমি আমার কাফেলা ফেলে রেখে বাহনে সওয়ার হলাম। বাড়িতে পৌঁছেই পরিবারের লোকদের কাছে জিজ্ঞেস করলাম, আমার যাওয়ার পর মক্কায় নতুন কিছু ঘটেছে কি? তারা বললো, ‘হ্যাঁ, মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল্লাহ নিজেকে নবী দাবি করেছেন এবং আবু কুহাফার ছেলে আবু বকর তাঁর অনুসারী হয়েছেন।’
তালহা বলেন, আমি আবু বকরের কাছে গেলাম এবং তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এ কথা কি সত্য যে, মুহাম্মাদ নবুওয়াত দাবি করেছেন এবং আপনি তাঁর অনুসারী হয়েছেন?’ বললেন, ‘হ্যাঁ, তারপর তিনি আমাকেও ইসলামের দাওয়াত দিলেন। আমি তখন খৃস্টান পাদ্রীর ঘটনা তাঁর কাছে খুলে বললাম। অতঃপর তিনি আমাকে সঙ্গে করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট নিয়ে গেলেন। আমি সেখানে কালেমা শাহাদাত পাঠ করে ইসলাম গ্রহণ করলাম এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট পাদ্রীর কথা সবিস্তারে বর্ণনা করলাম। শুনে তিনি দারুণ খুশী হলেন।
***
বদর যুদ্ধে তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ না করলেও পরোক্ষভাবে করেছিলেন। এ কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে গনিমতের হিস্সা দিয়েছিলেন। যুদ্ধের সময় একদল কাফির মদীনার মুসলিম জনপদের ওপর আক্রমণের ষড়যন্ত্র করেছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের খোঁজ-খবর নেওয়ার জন্য তালহাকে পাঠিয়েছিলেন। তালহা ছাড়াও সাত ব্যক্তিকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিভিন্ন দায়িত্ব দিয়ে বিভিন্ন স্থানে পাঠিয়েছিলেন। এ কারণে প্রত্যক্ষভাবে তাঁরা যুদ্ধে শরীক হতে পারেননি। তবে তাঁদেরকে বদরী হিসাবে গণ্য করা হয়।
হিজরী তৃতীয় সনে মক্কার মুশরিকদের সাথে সংঘটিত হয় উহুদের যুদ্ধ। এ যুদ্ধে হযরত তালহা বীরত্ব ও সাহসিকতার নজীরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। প্রকৃতপক্ষে তিনিই ছিলেন উহুদ যুদ্ধের হিরো। তীরন্দাজ বাহিনীর ভুলের কারণে মুসলিম বাহিনী যখন দারুণ বিপর্যয়ের সম্মুখীন, তখন যে ক’জন মুষ্টিমেয় সৈনিক আল্লাহর রাসূলকে ঘিরে প্রতিরোধ সৃষ্টি করেন, তালহা ছিলেন তাঁদের অন্যতম। এ সময় হযরত আম্মার বিন ইয়াযিদ শহীদ হন। কাতাদা বিন নু’মারের চোখে কাফিরের নিক্ষিপ্ত তীর লাগলে চক্ষু কোটর থেকে মণিটি বের হয়ে তাঁর গণ্ডের ওপর ঝুলতে থাকে। ’আবু দুজানা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে তাঁর পুরো দেহটি ঢাল বানিয়ে নেন। এ সময় সাদ বিন আবী ওয়াক্কাস অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে তীর ছুড়ছিলেন। আর তালহা এক হাতে তলোয়ার ও অন্য হাতে বর্শা নিয়ে কাফিরদের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালান।
যুদ্ধের এক পর্যায়ে আনসারদের বারোজন এবং মুহাজিরদের এক তালহা ছাড়া আর সকলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পাহাড়ের একটি চূড়ায় উঠেন, এমন সময় একদল শত্রুসন্য তাঁকে ঘিরে ফেলে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবীদের বললেনঃ ‘যে এদের হটিয়ে দিতে পারবে, সে জান্নাতে আমার সাথী হবে।’ তালহা বললেন, ‘আমি যাব, ইয়া রাসূলাল্লাহ।’ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, না, তুমি থাম। একজন আনসারী বললেন, আমি যাব। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হ্যাঁ, যাও। আনসারী গেলেন এবং মুশরিকদের সাথে যুদ্ধ করে শহীদ হয়ে গেলেন। এভাবে বার বার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আহ্বান জানালেন এবং প্রত্যেক বারই তালহা যাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে নিবৃত্ত করে একজন আনসারীকে পাঠালেন। এভাবে এক এক করে যখন আনসারীদের সকলে শাহাদাতবরণ করলেন, তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তালহাকে বললেন, এবার তোমার পালা, যাও।
হযরত তালহা আক্রমণ চালালেন। অন্যদিকে, মুশরিকদের আক্রমণে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও আহত হলেন, তাঁর দান্দান মুবারক শহীদ হলো এবং তিনি রক্তে রঞ্জিত হয়ে পড়লেন। এ অবস্থায় তালহা একাকী একবার মুশরিকদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে তাদেরকে একটু দূরে তাড়িয়ে দেন, আবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দিকে ছুটে এসে তাঁকে কাঁধে করে পাহাড়ের উপরের দিকে উঠতে থাকেন এবং এক স্থানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রেখে আবার নতুন করে হামলা চালান। এভাবে সেদিন তিনি মুশরিকদের প্রতিহত করেন। হযরত আবু বকর বলেন, এ সময় আমি ও আবু উবাইদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে দূরে সরে পড়েছিলাম। কিছুক্ষণ পর আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট ফিরে এসে তাঁকে সেবার জন্য এগিয়ে গেলে তিনি বললেন, ‘আমাকে ছাড়, তোমাদের ভাই তালহাকে দেখো’। আমরা খুঁজে দেখি, তিনি রক্তাক্ত অবস্থায় একটি গর্তে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। তাঁর একটি হাত দেহ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং সারা দেহে তরবারী ও তীর বর্শার সত্তরটির বেশী আঘাত। তাই পরবর্তীকালে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, “যদি কেউ কোনো শহীদকে পৃথিবীতে হেঁটে বেড়াতে দেখে চক্ষু শীতল করতে চায়, সে যেন তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহকে দেখে। এ কারণে তাঁকে ‘জীবন্ত শহীদ’ বলা হতো। হযরত সিদ্দীকে আকবর রাদিয়াল্লাহু আনহু উহুদ যুদ্ধের প্রসংগ উঠলেই বলতেন, ‘সে দিনটির সবটুকুই তালহার।’ এ যুদ্ধে হযরত তালহার বীরত্বে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সন্তুষ্ট হন। হযরত তালহাকে জান্নাতুল ফিরদাউসের সুসংবাদ দান করেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহুকে নিয়ে গর্ব করে বলতেন, উহুদের দিন ডানপাশে আমার নিকটে ছিল ফেরেশতা আর বাম পাশে ছিল তালহা।
**
ইবনে আসাকির বিভিন্ন সূত্রে উল্লেখ করেছেন যে, জঙ্গে জামাল তথা উটের যুদ্ধের দিন মারওয়ান ইবনুল হিকামের নিক্ষিপ্ত তীরে হযরত তালহা আহত হন। পরবর্তীতে, হিজরী ৩৬ সনের জুমাদিউল আউয়াল মতান্তরে ১০ই জুমাদিউস সানী ৬৪ বছর বয়সে তিনি ইন্তিকাল করেন।
তথ্যসূত্র:
সিয়ারু আলামুন নুবালা/ আয যাহাবী
সফওয়াতুস সফওয়া/ আল জাওযী
উসদুল গাবাহ/ইবনে আসীর
আল্লাহরব্বুল আলামীন আপনাদের মেহনত তথা প্রচেষ্টা কবুল করুন। এবং উম্মাহর আরও বড় বড় খেদমতগুলো আঞ্জাম দেওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন !
“ইসলামের তারকাগণ” সিরিজটা নিয়মিত দিলে আমরা উপকৃত হতাম।
জাযাকুমুল্লাহু আহসানাল জাযা !