বাংলাদেশের বর্তমানে গণতন্ত্রের আবরণে রাজনৈতিক নৈরাজ্যবাদের বিস্তার ঘটেছে । অপরাধ-দুর্নীতি, অশিক্ষা-কুশিক্ষা, মাদক-চাঁদাবাজি, অপসংস্কৃতির বিকাশ ঘটছে ভয়াবহভাবে যা দেশকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। দেশের অন্ধকার চিত্র উঠে আসছে আন্তর্জাতিক নানা সমীক্ষায়। যাতে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে দিন দিন অকার্যকর ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে। আর এর জন্য প্রধানত দায়ী কথিত গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা তথা ইসলামবিরোধী রাষ্ট্রব্যবস্থা ।
সুশাসনের সংকট, ঘুষ-দুর্নীতি, পরিবেশগত নানা বিপর্যয়, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অভাব—এসব ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী যত সূচকই প্রকাশ পায়, প্রায় সব কটিতেই অনেক অনেক পিছিয়ে বাংলাদেশ। উচ্চ দুর্নীতিতে জনগণের নাভিশ্বাস উঠেছে। যেমন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) দুর্নীতির ধারণা সূচক ২০১৯-এ এবার ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৬৬তম। ট্রেস ইন্টারন্যাশনাল নামের আরেকটি আন্তর্জাতিক সংস্থার তৈরি বিশ্ব ঘুষ সূচকে বাংলাদেশ ২০০ দেশের মধ্যে ১৮২তম। অর্থাৎ বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম ঘুষখোর দেশে পরিণত হয়েছে ।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) নিয়মিতভাবে গণতন্ত্র সূচক প্রকাশ করে। তাদের তালিকায় বাংলাদেশ আছে ‘হাইব্রিড রেজিম’ অবস্থানে। এটি হচ্ছে স্বৈরতান্ত্রিক ও ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক অবস্থার মাঝামাঝি অবস্থান। আর ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) গত অক্টোবর মাসে প্রকাশ করেছে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা সূচক। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এবার দুই ধাপ পিছিয়ে ১৪১টি দেশের মধ্যে হয়েছে ১০৫তম। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকদের অধিকার প্রশ্নেও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক সংস্থা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের সর্বশেষ প্রকাশিত ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচক ২০১৮’-এ ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৬তম।
সর্বশেষ ১১ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা দ্য ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট (ডব্লিউজেপি) আইনের শাসন সূচক প্রতিবেদন-২০২০ প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই সূচকেও বাংলাদেশের অবনতি হয়েছে। বিশ্বের ১২৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৫তম। এক বছর আগেও বাংলাদেশ ১২৬টি দেশের মধ্যে ছিল ১১২তম।
প্রথম আলোর বিশেষ বার্তা সম্পাদক শওকত হোসেন প্রথম আলোতে লিখেছেন ,
“এম নিয়াজ আবদুল্লাহ ও এন এন তরুণ চক্রবর্তী বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত নিয়ে একটি গবেষণা করেছেন। আশির দশকের পর থেকে পোশাক খাত ক্রমান্বয়ে এগিয়ে শীর্ষস্থানে চলে এসেছে। অথচ এই সময় দুর্নীতি পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি, ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিচালনা সূচকেও পিছিয়ে গেছে বাংলাদেশ। এ অবস্থার মধ্যে থেকেও বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত কীভাবে এগিয়ে গেল, সেটাই গবেষকেরা দেখতে চেয়েছেন।
এই দুই গবেষক পোশাক খাতের ৯২ জন মালিক ও ব্যবস্থাপকের বিস্তারিত সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে গবেষকেরা পাঁচটি ফলাফলের কথা জানিয়েছেন। যেমন ২২ দশমিক ৮ শতাংশ উত্তরদাতার মতে, ঘুষ সবচেয়ে বড় বাধা। ৩ দশমিক ৩ শতাংশ চাঁদাবাজিকে সবচেয়ে বড় সমস্যার কথা বলেছেন। দ্বিতীয়ত, ৪৯ শতাংশ বলেছেন ঘুষ ও চাঁদাবাজি কোম্পানির প্রবৃদ্ধিকে ব্যাহত করছে। তৃতীয়ত, ব্যবসায়ীরা কর বা শুল্ক পরিহার বা আমদানির ক্ষেত্রে আন্ডার-ইনভয়েস (দাম কম দেখানো) করার জন্য সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ দেন। চতুর্থত, আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে কী পরিমাণ অর্থ ঘুষ দিতে হবে, তা কাস্টমস কর্মকর্তারাই ঠিক করে দেন। পঞ্চমত, বিদেশি কোম্পানিও সরকারের কাজ পেতে, যন্ত্রপাতি সরবরাহের জন্য সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে থাকে। মোদ্দা কথা হচ্ছে ঘুষ দেওয়াকে সবাই একটি রীতি বলে মেনে নিয়েছেন।
একটি কাজ পেতে কত দিন লেগেছে এবং কী পরিমাণ অর্থ ঘুষ দিতে হয়েছে, তারও একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে এই গবেষণায়। যেমন কোম্পানি গঠনের বিভিন্ন পর্যায়ে ঘুষ দিতে হয় ৩৪ হাজার ৩৩২ ডলার। আবার কোম্পানি গঠনের দলিল সংগ্রহ বা নানা ধরনের অনুমতি পেতে যে ঘুষ দিতে হয়, তাকে তঁারা অনানুষ্ঠানিক ব্যয় বলছেন। এর পরিমাণ ২৩ হাজার ৩৩০ ডলার।
অনুমোদন পাওয়ার পর কোম্পানির কার্যক্রম শুরুর জন্য প্রয়োজন বিদ্যুৎ, গ্যাস, ও পানি সরবরাহ সংযোগ, টেলিফোন লাইনপ্রাপ্তি, ফায়ার লাইসেন্স নবায়ন, ইত্যাদি। এসব কাজে দিতে হয় ১৪ হাজার ৮০৮ ডলার। এরপরে প্রতিটি রপ্তানির দলিলের জন্য ৫ দশমিক ৭১ ডলার ও প্রতিটি আমদানি কনসাইনমেন্টের জন্য ঘুষ দিতে হয় ১৪২ ডলার। গবেষকেরা বলছেন, মূলত এভাবে ঘুষ দিয়ে কাজ করাটাই এখানকার রীতি।
২০০৫ সালে পোশাক রপ্তানিতে যখন কোটাব্যবস্থা উঠে যায়, তখন বাংলাদেশ ছিল টানা পঞ্চমবারের মতো শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। এরপর থেকে পোশাক খাতের চমকপ্রদ অগ্রগতি হলেও দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি অতি সামান্য। এমনকি সহজে ব্যবসা পরিচালনার সূচকেও বাংলাদেশ ক্রমে খারাপ পর্যায়ে গেছে। সুতরাং দুর্নীতি অর্থনৈতিক অগ্রগতির অন্যতম বাধা—এই যুক্তি পোশাক খাতের ক্ষেত্রে খাটছে না। পোশাক খাতের অগ্রগতি বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশের সামান্য উন্নতিও আনতে পারেনি।
বলা হয়ে থাকে একটি গণতান্ত্রিক কাঠামো দুর্নীতি কমায়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ায়। আর টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ক্রমান্বয়ে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নতি ঘটায়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা–ও দেখা যায়নি। ২০১৪ সালের এ বিষয়ে এক গবেষণায় ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ও সিমিন মাহমুদ বলেছিলেন, ১৯৯১ সালে একনায়কের শাসন থেকে সংসদীয় গণতন্ত্রে বাংলাদেশের রূপান্তর ঘটেছিল। তবে এরপর চলতে থাকা রাজনীতির সংস্কৃতি দেশে একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশের বিস্তার ঘটায়নি, একটি জবাবদিহিমূলক ও স্বচ্ছ রাষ্ট্রেরও দেখা মেলেনি। শাসনব্যবস্থার মূলে রয়েছে অকার্যকর সংসদ, তীব্র দ্বন্দ্ব-সংঘাতপূর্ণ রাজনীতি, প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চার অনুপস্থিতি, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর রাজনীতিকীকরণ, দুর্নীতিগ্রস্ত ও অযোগ্য আমলাতন্ত্র। এ ছাড়া প্রকটভাবে যা আছে তা হলো পৃষ্ঠপোষকতার রাজনীতি, যেখানে রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনাকে টিকিয়ে রাখতে বিভিন্ন গোষ্ঠীকে আশ্রয়–প্রশ্রয় ও অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। ”
শওকত হোসেনের প্রতিবেদন থেকে স্পষ্ট হয় বাংলাদেশের দুর্নীতির স্বরূপ। আদর্শ ও নৈতিকতাহীন পরকাল বিমুখ প্রতারণাপূর্ণ গণতন্ত্র বা ইহজাগতিক কোনো মতবাদের সাহায্যে অবস্থার উন্নতি সম্ভব নয় । দুর্নীতিমুক্ত অধিকারমুখী স্বচ্ছ সুন্দর পৃথিবী বিনির্মাণে ইসলাম এর কোন বিকল্প নেই । আর এই ইসলাম হীনতাই বাংলাদেশকে নিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারের দিকে ।