ভেঙে যেতে পারে ইউরোপীয় ইউনিয়ন?

0
1039
ভেঙে যেতে পারে ইউরোপীয় ইউনিয়ন?

গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের উহান থেকে উদ্ভুত করোনাভাইরাস ইউরোপের মূল ভূখন্ডে এক লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটানোর পর এখন খোদ ইউরোপীয় ইউনিয়নের অস্তিত্বকেই হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। ইউরোপের ২৭ টি দেশ নিয়ে গঠিত এই জোট গত প্রায় চল্লিশ বছর যাবত অনেকটা মসৃণ পথে চললেও – এর অভ্যন্তরীণ দৈন্যতা সাধারণ মানুষের সামনে খোলাসা হয়ে গেছে করোনাভাইরাস তাণ্ডবে।

ব্রেক্সিটের উন্মাদনার মধ্যেও ইইউ দেখা গিয়েছিলো সমন্বিত ও বলিষ্ঠ। কিন্তু করোনাভাইরাস যেন সবকিছু বদলে দিয়েছে। ইউরোপীয় ভ্রাতৃত্ব ও সমন্বিত মূল্যবোধের বুলি ভুলে দেশ গুলো যার যার মত করে করোনাভাইরাস মোকাবেলার চেষ্টা করছে। ইউরোপীয় কমিশন প্রধান উরসুলা ভন ডার লিয়েন এ বিষয়ে সম্প্রতি ইইউ পার্লামেন্টে প্রেসিডেন্টের বক্তব্যে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন – “যখন ইউরোপে একে অন্যকে সহযোগিতার প্রয়োজন সবথেকে বেশি, তখন অধিকাংশ দেশই কেবল নিজের স্বার্থকেই গুরুত্ব দিচ্ছে।“

ইউরোপীয় কমিশন সম্প্রতি ইইউ এর অভ্যন্তরীণ সীমান্ত খোলা রেখে বাকি বিশ্বের সাথে ইউরোপীয় সীমান্ত বন্ধের প্রস্তাব করলেও ইইউ সদস্যদের মধ্যে সে বিষয়ে কোন আগ্রহ দেখা যায় নি। বরং ভাইরাস ঠেকাতে দেশগুলো যার যার সীমান্ত বন্ধ করে দেয়ার ফলে ইউরোজোনে মুক্ত চলাচল কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে।

ইউরোপে মুক্ত সীমান্ত ও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে প্রতিবেশী দেশগুলোর অনেক মানুষই এক দেশ থেকে অন্য দেশে গিয়ে চাকরি করেন – সীমান্ত বন্ধের ফলে তাই কেবল এসব মানুষই কর্মহীন হয়ে পড়েননি বরং সাথে সাথে দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ শিল্প ও অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়ছে। সুইডেনের স্বাস্থ্যখাত অনেকটাই নির্ভর করে পাশের দেশ ফিনল্যান্ডের স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর। সুইডেন থেকে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে সীমান্ত বন্ধের চিন্তা-ভাবনা করছে ফিনল্যান্ড – সেক্ষেত্রে সুইডেনের স্বাস্থ্যব্যবস্থা কর্মীর অভাবেই ভেঙ্গে পড়বে।
করোনাভাইরাসের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ইতালি ও স্পেনকে সাহায্যের বদলে অন্যদেশগুলো বাহ্যত অনেকটাই বয়কট করেছে। ইতালি যখন বার বার মানবিক সাহায্য এবং মাস্ক, স্যানিটাইজারের মত অত্যাবশ্যকীয় স্বাস্থ্য উপকরণ চেয়ে আবেদন করেছে, তখন জার্মানি, ফ্রান্স তাদের দেশ থেকে এসব উপকরণ রপ্তানি নিষিদ্ধ করে আইন পাশ করেছে। ফলে অর্থনৈতিক মন্দা ও বেকারত্বের পাশাপাশি জনগণের মধ্যে ইউরোপীয় ঐক্যের ব্যাপারে সৃষ্টি হয়েছে হতাশা ও ক্ষোভ।

ফ্রান্স ঐক্যের কথা বললেও, ফরাসি অর্থমন্ত্রী বলেছেন – পুরো ইউরোপ এখন জার্মানির দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু বিবিসির কাটিয়া এডলারের রিপোর্ট বলছে, অধিকাংশ জার্মান মনে করে বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা নিজেরাই হিমশিম খাচ্ছে। আর ইউরোপের মধ্যে আগে থেকেই অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা ইতালি, স্পেন এই অবস্থায় একেবারেই বিপন্ন ও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। চীন, রাশিয়া কিছুটা হলেও স্বাস্থ্য উপকরণ ও ডাক্তার পাঠিয়ে সাহায্য করার কারণে এ দেশগুলোর জনগণের মাঝে প্রতিবেশিদের চেয়ে দূরের দেশগুলোর প্রতিই ইতিবাচক মনোভাব তৈরি হচ্ছে।

সমালোচনার মুখে ইতালি, ফ্রান্সের কোভিড-১৯ রোগীদের জন্যে জার্মানির হাসপাতালগুলো খুলে দেয়া হলেও অর্থনৈতিক সহায়তার প্রশ্নে ইইউ এখনো একমত হতে পারেনি। পর্যুদস্ত ইতালি, স্পেনসহ নয়টি দেশ অর্থনীতি ও শ্রমবাজার সামাল দিতে প্রয়োজনীয় জরুরি তহবিল হিসেবে ‘করোনাবন্ড’ নামের বিশেষ বন্ড চালুর প্রস্তাব করলেও ধনীদেশ জার্মানি, অস্ট্রিয়া, নেদারল্যান্ড এর বিরোধিতা করেছে। আস্ট্রিয়া ও নেদারল্যান্ড এর পরিবর্তে ইইউ এর জরুরী তহবিল থেকে কঠিন শর্তে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে ঋণ সহায়তার কথা বলেছে – যাকে ইতালি দেখছে হঠকারিতা হিসেবে।

ফলে আগে থেকেই থাকা অর্থনৈতিক বিভাজন পেয়েছে নতুন মাত্রা। স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ হতাশা প্রকাশ করে বলেছেন, “ইউরোপীয় প্রোজেক্টের ভবিষ্যৎ এখন সংকটাপন্ন, আমাদেরকে হয় সংগঠিত ও সংঘবদ্ধ ইউরোপ নতুবা একাকি চলার পথ – দুটোর যে কোন একটা পছন্দ করতে হবে।“

স্বাস্থ্যব্যবস্থার ভিন্নতার পাশাপাশি করোনাভাইরাস শনাক্তকরণের ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি এমনকি কোভিড-১৯ রোগীর চিকিৎসায়ও ভিন্নতার কারণে ইইউ ভুক্ত দেশগুলোকে নিয়ে ভাইরাস প্রতিরোধে কোন সমন্বিত উদ্যোগ এই মুহূর্তে নেয়া সম্ভব নয়। এমনকি কোয়ারেন্টিন ও লকডাউনের ব্যাপারেও কোন সমন্বয় নেই। ড্যানিশ ইন্সটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিস এর গবেষক সেসিলে ফেলিসিয়া স্টকহোম বাংকে বলেছেন, “এই পরিস্থিতি আমাদেরকে এটাই দেখিয়ে দিচ্ছে যে ইইউ সদস্যরা এক্ষেত্রে কতটা বিভক্ত”।

অন্যদিকে প্রতিটি সরকার এখন তাদের নিজেদের জনগণ, চাকরি ও অর্থনীতি নিয়েই ব্যস্ত এবং এমনকি অনেকটা বিপন্ন সময় পার করছে। সেন্টার ফর ইউরোপীয়ান রিফর্ম এর প্রতিনিধি আগাথা গোস্তিনস্কা-জাকুভস্কা মনে করেন, “প্রাথমিকভাবে ইতালিকে সাহায্য না করাটা এরই মধ্যে ইইউ এর সুখ্যাতি অনেকখানি নষ্ট করেছে।”
আর এই দুরবস্থার সুযোগ ভালভাবে কাজে লাগাতে তৎপর হয়ে উঠেছে – নব্যনাতসীবাদের প্রবর্তক অভ্যন্তরীণ জাতীয়তাবাদীরা। ইতালির সাবেক উপ প্রধানমন্ত্রী মাত্তেও সিলভানি টুইটারে লিখেছেন – “আমাদের উচিত ই ইউএর কার্যকারিতা পুনঃনিরীক্ষা করা, তারা আমাদের কোন সাহায্য করেনি।” যদিও তার কথা পুরোপুরি ঠিক নয় – কারণ এরই মধ্যে জার্মানি থেকে স্বাস্থ্য-উপকরণ পাঠানো হয়েছে ইতালিতে, তবে এ কথাও সত্য যে সেটা হয়েছে ব্যাপক সমালোচনার পর।
হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরবান এরই মধ্যে পার্লামেন্টে আইন পাশ করে ক্ষমতা অনির্দিষ্টকালের জন্যে নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছেন। গণতন্ত্রকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা ইইউ এর জন্যে যেটা বড় হুমকি। ফরাসি কট্টর-ডানপন্থী নেত্রী মেরি লি পেন রাশিয়া টুডে’র এক সাক্ষাৎকারে প্যান্ডেমিক মোকাবেলায় ইইউ এর ব্যর্থতা প্রসঙ্গে মন্তব্য করে বলেন, করোনাভাইরাসে ইউরোপে প্রথম মৃত্যু হয়েছে ইইউ’র।
কার্নেগী ইউরোপের খন্ডকালীন গবেষক মার্ক পিয়েরিনি মনে করেন, করোনা প্যান্ডেমিক বিশেষ রাজনৈতিক স্বার্থের পালে হাওয়া দেবে কারণ এটা এমন সময়ে এল যখন আমরা কেবলই একটা দশক পার করেছি যখন দেশে দেশে স্বার্থান্বেষী জাতীয়তাবাদীদের উত্থান ঘটেছে যাদের নেতারা খোলাখুলি ভাবেই ইইউ এর বিরোধিতা করেন।

তবে এরই মধ্যে চাকরির বাজার ঠিক করতে এবং ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের সাহায্যের জন্যে ইউরোপিয়ান কমিশন ১০০ বিলিয়ন ইউরোর প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এছাড়াও ইতালির জন্যে ৫০ মিলিয়ন ইউরোর স্বাস্থ্য-সামগ্রী বরাদ্দ করেছে। ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংক ৭৫০ বিলিয়ন ইউরোর প্রণোদনা ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইইউ যদি তার খ্যাতি ও অবস্থান ধরে রাখতে চায় তাহলে বর্তমানে পরিস্থিতি যে পর্যায়ে পৌছেছে তাতে প্রণোদনা যথেষ্ট নয় বরং শক্তিশালী জোট হিসেবে তাদেরকে সিদ্ধান্থীনতার দৈন্যতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
সময়টা খুবই নাজুক, গোস্তিনস্কা-জাকুভস্কার কথায় – “এটা ইউরোজোনের জন্যে এমন এক কঠিন পরীক্ষা যা ইউরোপকে আরো সংহত করতে পারে কিংবা ইইউ কেই ভেঙ্গে দিতে পারে।” হতাশার পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতারা আশার কথাও শোনাচ্ছেন – স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ বলেছেন – আমাদের উচিত অতীত থেকে শিক্ষা নেয়া এবং ইউরোপের সাধারণ জনগণ যেন আবারও ব্যর্থতায় না ডোবে সেটা নিশ্চিত করা।
করোনাউত্তর ইউরোপে ইইউ তার কার্যকারিতা হারাবে কিনা সে ব্যাপারে এখনো স্পষ্ট কিছু বোঝা না গেলেও ইইউকে কেবল সুসময়ের জোট বলেই মনে করছেন ইউরোপের সাধারণ মানুষ।

আবু আফিয়া

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধআল-ফিরদাউস সাপ্তাহিকী || সংখ্যা : ১৯ || মে ২য় সপ্তাহ, ২০২০ ঈসায়ী ||
পরবর্তী নিবন্ধমানবেতর জীবনযাপন করছেন নির্মাণশ্রমিকরাও