ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনের নামে হাজার কোটি টাকা ব্যয় দেখালেও ফলাফল শূন্য

0
535
ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে হাজার কোটি টাকা ব্যয় হলেও ফলাফল শূন্য

ঢাকা শহরে জলাবদ্ধতা নিরসনের নামে প্রতিবছর ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকা খরচ দেখায় দুই সিটি করপোরেশন। অথচ, নাজুক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের ফলে বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা হয়। কখনোই দায় নেয় না সিটি করপোরেশন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, জলাবদ্ধতা হলে এক সংস্থা অন্য সংস্থার ওপর দায় চাপায়। কিন্তু যে সংস্থাই দায়ী হোক, সিটি করপোরেশন সঠিক পন্থায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করলে, হাতের কাছে সবার আবর্জনা ফেলার জায়গা দিলে এবং জনগণকে সচেতন করতে পারলে এই সমস্যা অনেকটাই কমে আসতো।

দেশের অন্য সব সিটি করপোরেশন এলাকায় জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট করপোরেশন কর্তৃপক্ষের। শুধু ঢাকায় এ দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি ঢাকা ওয়াসা, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ ছয়টি সংস্থা পালন করে। তবু জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধান হয়নি।

ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব ওয়াসা ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো)। কিন্তু তারা এটি করতে ব্যর্থ হয়েছে।

সিটি করপোরেশন ঢাকা ওয়াসা বা পাউবোকে দোষারোপ করলেও দায় এই সংস্থারও রয়েছে। কারণ, জলাবদ্ধতা নিরসনে সিটি করপোরেশনও বছর বছর কোটি কোটি টাকা খরচ করে।

গতকাল চেষ্টা করেও এ বিষয়ে ডিএসসিসির মেয়রের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। খালে ময়লা ফেলা নিষেধ। তা অমান্য করে ময়লা ফেলা হচ্ছে খালে। পরিষ্কার না করায় খালটি দিন দিন ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে।

দুই সিটির খরচ

ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনের মূল দায়িত্ব ওয়াসার, এতে কোনো বিতর্ক নেই। কারণ, এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত বড় নালা ও খালগুলো ওয়াসার দখলে। কিন্তু এসব নালা ও খালে পানি যায় সিটি করপোরেশনের নির্মাণ করা অপেক্ষাকৃত ছোট নালা থেকে। দুই সিটির আওতায় এমন নালা আছে প্রায় ২ হাজার ২১১ কিলোমিটার। এর মধ্যে দক্ষিণের হাতে আছে প্রায় ৯৬১ কিলোমিটার এবং উত্তরের হাতে আছে বাকি ১ হাজার ২৫০ কিলোমিটার। এসব নালা নির্মাণ ও সংস্কারবাবদ দুই সিটি করপোরেশনের খরচের খতিয়ান জানতে যোগাযোগ করা হয়েছিল সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীর দপ্তরে।

ওই দপ্তর লিখিতভাবে জানিয়েছে, গত পাঁচ অর্থবছরে ডিএসসিসি প্রায় ৫৯৭ কিলোমিটার নালা নির্মাণ ও সংস্কার করেছে। কিলোমিটারপ্রতি গড়ে ব্যয় হয়েছে ১ কোটি ১ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। এতে পাঁচ বছরে সংস্থাটির খরচ হয়েছে ৬০৫ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। অন্যদিকে একই সময়ে প্রায় ৬৯৬ কিলোমিটার নালা নির্মাণ ও সংস্কার করেছে ডিএনসিসি। প্রতি কিলোমিটারে গড়ে খরচ হয়েছে প্রায় ১ কোটি ২১ লাখ টাকা। আর ৬৯৬ কিলোমিটারে খরচ হয়েছে প্রায় ৭১১ কোটি টাকা।

এই হিসাবে জলাবদ্ধতা নিরসনে দুই সিটি করপোরেশন শুধু নালা নির্মাণ ও সংস্কারবাবদ খরচ করেছে প্রায় ১ হাজার ৩১৬ কোটি টাকা। আবার ঢাকা ওয়াসা তিন বছরে খরচ করেছে প্রায় ১০০ কোটি টাকা।

এত টাকা খরচ করেও কেন সুফল মিলছে না জানতে চাইলে নগর বিশেষজ্ঞ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, স্থানীয় পর্যায়ের সমস্যা সমাধানের জন্য নতুন নালা নির্মাণ বা সংস্কারে সিটি করপোরেশন যে ব্যয় করে, তা হয়তো যৌক্তিক। কিন্তু এর সঙ্গে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়টি যোগ না হলে এই ব্যয় অপচয়ে রূপ নিতে বাধ্য।

দায় এড়ানোর সুযোগ নেই

আইন অনুযায়ী সিটি করপোরেশনের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। কারণ, সিটি করপোরেশন আইনের তৃতীয় তফসিলে বলা আছে, করপোরেশন ‘নগরীতে পানি নিষ্কাশনের জন্য পর্যাপ্ত পানি নিষ্কাশন নর্দমার ব্যবস্থা করিবে এবং জনসাধারণের স্বাস্থ্য ও সুবিধার প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া নর্দমাগুলি নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও সংরক্ষণ করিবে এবং পরিষ্কার রাখিবে।’

কিন্তু হাজার কোটি টাকা খরচ করে নালা নির্মাণ হলেও এতে কতটা যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিষ্কার করে রাখা হয়, তা নিয়ে বিতর্ক আছে।

করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, নালা বা ড্রেনেজ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সিটি করপোরেশনে আলাদা কোনো বিভাগ বা জনবল নেই। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও বরাদ্দেরও ঘাটতি আছে। নির্মিত নালা দেখভালের দায়িত্ব পালন করে করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ। রুটিন কাজের অংশ হিসেবে এই বিভাগ কিছু কাজও করে। কিন্তু সেটি পর্যাপ্ত নয় বলে সিটি করপোরেশনের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। এমন অবস্থায় এসব নালা কঠিন বর্জ্যে ভরে থাকলে, সেগুলো দিয়ে ঠিকমতো পানি প্রবাহিত হতে পারে না। এতেও এলাকাভিত্তিক জলাবদ্ধতা হয়।

তাই সিটি করপোরেশনেও দায় এড়ানোর সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেছেন নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি বলেন, শুধু নালা নির্মাণ করলেই হবে না, যথাযথভাবে এগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। সিটি করপোরেশনের নালাগুলোর সবই সচল আছে, তাতে ময়লা–আবর্জনা নেই, সেটিও বলা যায় না। তাই দায় না এড়িয়ে আত্মসমালোচনা করতে হবে, আর যার যে দায়িত্ব আছে, সেটি যথাযথভাবে পালন করতে হবে।

এমন অবস্থায় সিটি করপোরেশন চাইছে ওয়াসার হাতে থাকা সব নালা ও খালের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিতে। এ সম্পর্কে আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, শুধু দায়িত্ব হস্তান্তর হলেই সমস্যার সমাধান হবে, বিষয়টি এমন নয়। তবে এটি সমস্যা সমাধানের পথে যাত্রা শুরু হিসেবে বিবেচিত হবে।

নাজুক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা

ঢাকার খাল বা নালাগুলো বছরের বেশির ভাগ সময় ময়লা-আবর্জনায় ভরে থাকে। বিভিন্ন সংস্থা সময়ে সময়ে সেগুলো পরিষ্কার করলেও কিছুদিন পর আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসে। ফলে কোনো এলাকার নালা ও খাল বর্ষার আগে পরিষ্কার না করলে ওই এলাকায় বেশি জলাবদ্ধতা হয়। আবার এলাকার বাসিন্দারাও নালা বা খালে ময়লা ফেলেন। অনেক সময় খাল বা নালার বর্জ্য পরিষ্কারের পর সেগুলো খালের পাড়েই ফেলে রাখা হয়। বৃষ্টিতে সেসব আবার খালে গিয়ে পড়ে খাল ভরাট হয়ে যায়। তবে সিটি করপোরেশনের কর্মপন্থা অনুযায়ী, বাসিন্দাদের উৎপাদিত কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনেরই।

দুই সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন ঢাকায় পাঁচ থেকে ছয় হাজার মেট্রিক টন বর্জ্য উৎপাদিত হয়। কিন্তু এগুলো ব্যবস্থাপনায় সিটি করপোরেশন এখনো সফল হতে পারেনি বলে মনে করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক আকতার মাহমুদ। তিনি বলেন, ঢাকার মোট বর্জ্যের ৬০ শতাংশের ব্যবস্থাপনা করতে পারে সিটি করপোরেশন। বাকি ৪০ শতাংশ খাল বা নালায় পড়ে। এতে খাল ও নালার পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে জলাবদ্ধতা হয়।

তবে দুই সিটির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের দাবি, তারা সব বর্জ্যই যথাযথভাবে ব্যবস্থাপনা করে। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, খালের আবর্জনাগুলো আসে কোথা থেকে? এই প্রশ্ন করা হয়েছিল ডিএসসিসির ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ হোসেনকে। তাঁর এলাকার কালুনগর খালটি আবর্জনায় ভরে আছে। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, এটা সুনির্দিষ্টভাবে বলা মুশকিল। খালে ময়লা ফেলার জন্য তিনি আশপাশের ট্রাক ও টেম্পোস্ট্যান্ড, বাজার, চায়ের দোকানকে দায়ী করেছেন। তাঁর মতে, স্থানীয় বাসিন্দাদের দায় ১০ ভাগ।

বর্জ্য ব্যবস্থাপনার করুণ চিত্র দেখা গেছে মিরপুর এলাকার কালশী খালেও। গুরুত্বপূর্ণ এই খালটি গত বছর পুনঃ খনন করেছে ডিএনসিসি।

পরিষ্কারের সময় এই খালে ৮৮ ট্রাক ডাবের খোসা, ৩৩টি জাজিম, টেলিভিশন, ফ্রিজসহ অনেক ময়লা পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম। আপনার ভোটাররাই এসব আবর্জনা ফেলেছেন, এটি বন্ধ করতে আপনারা কী করছেন জানতে চাইলে মেয়র বলেন, ‘আমরা জনগণকে বারবার খালের মধ্যে বর্জ্য ফেলতে নিষেধ করছি।’

সম্প্রতি ডিএনসিসির ওয়েবসাইটে বলা হচ্ছে, সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত স্থান ছাড়া অন্য কোথাও আবর্জনা ফেলা দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু খালে ময়লা ফেলার দায়ে কারও দণ্ড হয়েছে এমন তথ্য পাওয়া যায়নি।

ব্যবস্থা নেয়নি ডিএসসিসি

গত বুধবার স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর সঙ্গে ডিএসসিসির মেয়র প্রথম যে খালটির কাছে যান, সেটি কালুনগর খাল নামে পরিচিত। ডিএসসিসির ৫৫-৫৭ নম্বর ওয়ার্ডে অবস্থিত খালটি হাজারীবাগ খাল থেকে উৎপন্ন হয়ে আদি বুড়িগঙ্গার চ্যানেলে মিশেছে। গত বছর প্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যয় করে খালটির ২ দশমিক ৩ কিলোমিটার অংশ পুনঃ খনন করেছিল পাউবো।

খননকাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পাউবোর একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ওই সময় খালটি বারোয়ারি বর্জ্যে ভরে ছিল। খালে ১৫-১৬ ফুট গভীর পর্যন্ত ছিল আবর্জনার স্তর। আশপাশের লোকজন এই খালকে ডাস্টবিনের মতো ব্যবহার করেছে।

খালটির খননকাজ যখন অর্ধেকের মতো হয়েছে, তখনই এই খালে আবার ময়লা-আবর্জনা ফেলা শুরু হয়। এটি বন্ধের ব্যবস্থা নিতে গত বছরের ১১ জুন ডিএসসিসিতে চিঠি দেয় পাউবো। কিন্তু দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেয়নি ডিএসসিসি। ফলে গত বুধবার স্থানীয় সরকারমন্ত্রীকে নিয়ে ডিএসসিসির মেয়র যখন খালটির পাড়ে যান, তখন এটিকে আবর্জনার ভাগাড়ের মতোই দেখতে পান।

পাউবোর এক কর্মকর্তা বলেন, খাল রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তাঁদের জনবল নেই। প্রকল্পের আওতায় তাঁরা খালটি খনন করেছিলেন। এই খালের মালিক জেলা প্রশাসন। এখন যে হারে খালটিতে ময়লা ফেলা হচ্ছে, তা চলমান থাকলে আগামী বছরের মধ্যেই খালে পানির প্রবাহ আবার বন্ধ হয়ে যেতে পারে। প্রথম আলো

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধখোরাসান | তালেবান মুজাহিদদের সাথে যোগদান করল কাবুল প্রশাসনের ২২ সেনা ও পুলিশ সদস্য
পরবর্তী নিবন্ধকোরবানির পশুর হাট বন্ধের নির্দেশ রেল কর্তৃপক্ষের