৯/১১, একটি পর্যালোচনা

    2
    2768

    দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষ শক্তি পরাজিত হলে বিশ্ব-সুপার পাওয়ারের তালিকায় ওঠে আসে দুটি নাম, ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতা প্রাপ্ত অ্যামেরিকা এবং ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে জন্ম নেয়া সোভিয়েত ইউনিয়ন।

    এরপর থেকেই এই দুই পরাশক্তির মাঝে শুরু হয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনকাল পর্যন্ত চলে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর পৃথিবীর একমাত্র পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় অ্যামেরিকা। পরাশক্তির তালিকায় অ্যামেরিকার নাম আসার পর থেকেই সে এর থেকে পরিপূর্ণ ফায়েদা লুটতে শুরু করে। নানা সব ভুয়া অজুহাত তৈরী করে একের পর এক স্বাধীন ভূখণ্ডে সামরিক আগ্রাসন চালায়। তার আগ্রাসনের সবচেয়ে বেশী শিকার হয় মুসলিম ভূখণ্ডগুলো। বিশেষত খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ মুসলিম দেশগুলো অ্যামেরিকার প্রধান টার্গেটে পরিণত হয়। সম্পদের লোভ আর ইসলাম বিদ্বেষ, এই দুটি কারণে মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে আগ্রাসন চালাতে মরিয়া হয়ে ওঠে সাম্রাজ্যবাদী অ্যামেরিকা। নিজের মিত্র রাস্ট্রগুলোকে দিয়ে একের পর এক মুসলিম ভূখণ্ডগুলো ধ্বংস করতে থাকে এবং অতি কৌশলে মুসলিম দেশসমূহের খনিজ সম্পদ নিজ দেশে পাচার করতে থাকে। তবে ধূর্ত অ্যামেরিকা কখনোই স্ব-শরীরে যুদ্ধের ময়দানে আসতো না। পরোক্ষভাবে সে প্রতিটি মুসলিম হত্যাযজ্ঞের নেতৃত্ব দিতো। হত্যাযজ্ঞ চূড়ান্ত হওয়ার পর সে আবির্ভূত হতো ত্রাণ কর্তারূপে। উভয় পক্ষের মাঝে সন্ধির নামে যুদ্ধ বন্ধ করতো আর প্রতিদান স্বরূপ পর্দার আড়াল থেকে লুট করত খনিজ সম্পদ। বিশ্বের সামনে সে এক মানবদরদী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতো। এই নাটকীয় হত্যাযজ্ঞের শিকার হয় ইয়েমেন, ইরাক, সুদান, লিবিয়া, সোমালিয়া, চেচনিয়া, বসনিয়াসহ বিশ্বের বহু মুসলিম রাষ্ট্র। এই কারণেই মুসলিম নিধনের পেছনে মূল হোতা অ্যামেরিকা হওয়া সত্ত্বেও বিশ্ববাসীর কাছে সে ছিলো মানবতাবাদী ও জনদরদী একটি রাষ্ট্র। অনেক নির্যাতিত, নিপীড়িত মুসলমানও তাকে বন্ধুই মনে করতো।

    অপরদিকে অ্যামেরিকা কেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো অ্যামেরিকাকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরে মহাশক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে। অ্যামেরিকা যা চায় তাই করতে পারে, যাকে ইচ্ছা ক্ষমতায় বসাতে পারে আবার ক্ষমতা থেকে নামাতেও পারে, মিডিয়ার প্রোপাগাণ্ডার ফলে এ জাতীয় বিশ্বাস মানুষের অন্তরে বদ্ধমূল হতে থাকে৷ অ্যামেরিকা হয়ে যায় অজেয় শক্তি। এ সবের প্রভাব পড়তে থাকে মুসলমানদের আক্বীদা-বিশ্বাসেও। অ্যামেরিকা নিয়ন্ত্রিত গণতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার ফলে মুসলমানদের অন্তরে দানা বাঁধতে শুরু করে অমূলক ও ভিত্তিহীন সব বিশ্বাস।

    যেমন:

    ১. আমাদের সবকিছুই অ্যামেরিকা দেখছে এবং শুনছে। অ্যামেরিকার চক্ষু ফাঁকি দিয়ে কিছুই করা সম্ভব নয়।

    ২. অ্যামেরিকা মুসলমানদের কল্যাণকামী একটি রাষ্ট্র। অন্যদেশগুলো যখন কোনো মুসলিম দেশে আক্রমণ করে তখন অ্যামেরিকা মুসলমানদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়ায়। ৩. অ্যামেরিকা একটি অপরাজেয় রাষ্ট্র। অ্যামেরিকার কোনো বিনাশ নেই। সে যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারে৷ এমন-ই আরো বহু ভ্রান্ত বিশ্বাস মুসলমানদের ঈমান-আক্বীদাহর ভিত্তিমূলে আঘাত হানতে শুরু করে।

    এমন একটি নাজুক মুহূর্তে মুসলমানদের ঈমান-আক্বীদা রক্ষার স্বার্থে, প্রয়োজন ছিলো ভদ্রতার মুখোশপরা ধূর্ত অ্যামেরিকার মুখোশ উন্মোচন করা। আরো প্রয়োজন ছিলো অ্যামেরিকাকে মুজাহিদদের পছন্দমতো কোনো একটি যুদ্ধক্ষেত্রে টেনে এনে নিরীহ মুসলিমদের রক্তের প্রতিশোধ নেওয়া। এ সব প্রয়োজনকে সামনে রেখেই ২০০১ সালের ১১-এ সেপ্টেম্বর অ্যামেরিকার পেন্টাগন, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ও ক্যাপিটাল ভবনকে লক্ষ্য করে একযোগে চারটি হামলা চালায় মুজাহিদগণ। ইতিহাসে যা ৯/১১ আক্রমণ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে।

    ৯/১১ আক্রমণের পেছনে আরো গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি কাজ করেছে তা হলো, মুসলিম হত্যায় অ্যামেরিকার সীমালঙ্ঘন ও মুসলিমদের পবিত্রভূমিতে আমেরিকার সামরিক হস্তক্ষেপ। মুসলিম দেশগুলোতে অ্যামেরিকার নির্মম হত্যাযজ্ঞের ফিরিস্তি অনেক দীর্ঘ। এরমধ্যে, অ্যামেরিকা কর্তৃক ইরাক অবরোধের ফলে প্রায় ২০ লক্ষ নারী-পুরুষ এবং ৫ লক্ষ শিশু হত্যা, ইসরায়েলকে আর্থিক ও রাজনৈতিক সহায়তা দিয়ে লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনিকে বাস্তুচ্যুত করা , তাদের ঘর-বাড়ী, হাট-বাজার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা। অগণিত ফিলিস্তিনিকে হত্যা ও বন্দী করা। ১৯৮২ সালে অ্যামেরিকার সহায়তায় ইসরায়েল কর্তৃক ১৭ হাজার লেবানিজকে হত্যা (১) ও নিরাপত্তা প্রদানের নামে জাযিরাতুল আরবে আমেরিকান সৈন্য নিয়োগ দিয়ে তেলসম্পদ আত্মসাৎ -বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অ্যামেরিকার এই সীমাহীন বাড়াবাড়ির প্রতিশোধ ছিলো ৯/১১ এর আক্রমণ।

    ৯/১১ এর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য।

    একাধিক লক্ষ্যকে সামনে রেখে ৯/১১ এর মোবারক এই আক্রমণ করা হয়েছিল। এখানে আমরা অতি সংক্ষেপে কয়েকটি তুলে ধরছি।

    ১। বিভিন্ন মুসলিম ভূখণ্ডে আমেরিকার চালানো গণহত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ। আমেরিকা নিজ স্বার্থোদ্ধারের জন্য যে কোনো দেশেই আক্রমণ করে বসত। এই সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব আমেরিকাকে অহঙ্কারী বানিয়ে ফেলেছিলো। ৯/১১ এর এই মোবারক হামলার মাধ্যমে আমেরিকার অহঙ্কার মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া হয়।

    ২। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আবাসভূমি জাযিরাতুল আরব থেকে আমেরিকান সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য করা। আমেরিকা নিরাপত্তা প্রদানের নামে জাযিরাতুল আরবের ভূমিতে নিজেদের সেনাবাহিনী নিয়োগ করে রেখেছিল। এর মাধ্যমে তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিলো, তেলের খনির উপর নিজেদের দখল প্রতিষ্ঠা করে রাখা এবং মুরতাদ সৌদি শাসকদের ক্ষমতায় বসিয়ে রাখা। এই দালাল শাসকগোষ্ঠী অ্যামেরিকান সেনাবাহিনীকে জাযিরাতুল আরবের পবিত্র ভূমি থেকে বের করার পরিবর্তে তাদেরকে পরিপূর্ণ সহায়তা প্রদান করে যাচ্ছিলো। অথচ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্তিম উপদেশ ছিল, জাযিরাতুল আরবে যেন কখনোই কোনো কাফের-মুশরিক থাকতে না পারে।

    সহীহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে:

    أَخْرِجُوا الْمُشْرِكِيْنَ مِنْ جَزِيْرَةِ الْعَرَبِ

    আরব উপদ্বীপ (২)থেকে মুশরিকদের বহিষ্কার করে দাও! (সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৪৪৩১)

    ৩। আমেরিকাকে মুজাহিদদের সুবিধাজনক কোনো ভূমিতে টেনে আনা। এতদিন আমেরিকা নিজের সুবিধামত জায়গাতে মুসলিমদের উপর আক্রমণ করে আসছিল। ফলে মুজাহিদিনের জন্য আমেরিকাকে আঘাত করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অতি সামান্য পুঁজি নিয়ে আমেরিকার মোকাবেলা করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই আমেরিকাকে এমন এক জায়গায় টেনে আনা জরুরি ছিল যেখানে আমেরিকা থাকবে নিঃসঙ্গ। আর মুজাহিদিন তাদের সামান্য সামর্থ্যকেই কাজে লাগিয়ে বড় ধরনের সফলতা অর্জন করতে পারবেন।

    ৪। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আমেরিকার উপনিবেশগুলো থেকে আমেরিকার অর্থনীতি প্রতিনিয়ত ফুলে ফেঁপে উঠছিল। বিশাল আমেরিকান অর্থনীতি ছিল মুসলিম ভূখণ্ডগুলোতে আমেরিকান দখলদারিত্ব অব্যাহত রাখার সবচে বড় হাতিয়ার। তাই আমেরিকাকে এমন কয়েকটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলা জরুরি ছিল যা আমেরিকার অর্থনীতিকে ধীরে ধীরে শেষ করে দিবে। এই অর্থনীতির পতন হলে আমেরিকার দখলদারি মনোভাবও শেষ হয়ে যাবে।

    ৫। মুসলিমদের সামনে আসল শত্রুকে স্পষ্ট করা। আমেরিকা যেহেতু সবসময় পর্দার পেছন থেকে কলকাঠি নেড়ে মুসলিম দেশগুলোতে হত্যাযজ্ঞ চালানোর নীতি গ্রহণ করেছিলো, তাই সাধারণ মুসলিমরা আমেরিকা নয় বরং আঞ্চলিক সরকারকে নিজেদের শত্রু মনে করত। এবং এর ভিত্তিতেই তারা স্থানীয় সরকার পরিবর্তনের লক্ষ্যে বিভিন্ন আন্দোলন ও জিহাদ করত। কিন্তু এক সরকারের পতনের সাথে সাথে আমেরিকা পর্দার পেছন থেকে আরেক সরকারকে বসিয়ে দিত। ফলে মুক্তিকামী মুসলিমদের সকল চেষ্টা প্রচেষ্টা সামগ্রিক অর্থে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছিল। তাই আমেরিকাকে মুসলিম জনসাধারণের আসল শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য কোনো মুসলিম ভূখণ্ডে আমেরিকার প্রত্যক্ষ আক্রমণ অপরিহার্য ছিল। যেন মুসলিমরা তাদের আসল শত্রুকে চিনতে পারে এবং তাদের সকল শক্তি সামর্থ্য আঞ্চলিক সরকারের বিরুদ্ধে অপচয় করা বাদ দিয়ে সাপের মাথা আমেরিকার বিরুদ্ধে সকলে একত্রিত হতে পারে।

    ৬। মুসলিমদের মনে আমেরিকার যে অপরাজেয় মনোভাব তৈরি হয়েছিল সেটাকে গুঁড়িয়ে দিয়ে জিহাদের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা। কারণ তারা যখন দেখবে, মাত্র ১৯ জন মুজাহিদের ছোট্ট একটি দল যদি আমেরিকার মত দেশের হৃদপিণ্ডে আঘাত করতে পারে তাহলে সকল মুসলমান একত্রিত হয়ে বিশ্ব কুফুরের হোতা আমেরিকার বিষবৃক্ষ উপড়ে ফেলতে চাইলে সেটাও অবশ্যই সম্ভব।

    উল্লেখিত লক্ষ্য অর্জনে আমেরিকার উপর আল কায়েদার মুজাহিদগণ এই মহান হামলাটি পরিচালনা করেন।

    ৯/১১ এর দুই যুগ পর এসে আজ আমরা যদি অর্জনের হিসাব কষতে বসি তাহলে আল্লাহর রহমতে আমাদের সামনে ৯/১১ হামলার বিপুল সাফল্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যে উদ্দেশ্যগুলো সামনে রেখে শাইখ উসামা রাহিঃ ৯/১১ হামলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সবগুলো উদ্দেশ্য আল্লাহর রহমতে অর্জন হয়েছে। আসুন আমাদের সফলতাগুলো একটু আলোচনা করি…

    প্রথমতঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে মুসলিম বিশ্বে আমেরিকা যে দখলদারিত্ব চালিয়ে এসেছে সুদান, ফিলিস্তিন, ইরাক, লিবিয়া, বসনিয়া, চেচনিয়ায় যে গণহত্যার নেতৃত্ব দিয়েছে সেই হাজারো শহীদ আর হাজারো মা বোনের পক্ষ থেকে সর্বপ্রথম জবাবি আক্রমণ ছিল এটা। যা হাজার নিপীড়িতের অন্তর্জ্বালা কিছুটা হলেও কমিয়েছে। কুফুরি বিশ্ব ও তাদের পা চাটা মুসলিম রাষ্ট্রনায়কদের কবলে পড়ে মুসলিমরা যখন প্রতিরোধের কল্পনা হারিয়ে ফেলে নির্যাতিত হওয়ার ভাগ্যকেই বেছে নিয়েছিল তখন এই আক্রমণ ছিল একটি বিপ্লবের মত! যা মুসলমানদের মাঝে ঘুমিয়ে থাকা প্রতিবাদী সত্ত্বাকে জাগিয়ে তুলেছিল। ফলশ্রুতিতে এশিয়া ও আফ্রিকার দিকে দিকে জিহাদের এক নতুন ধারা শুরু হয়ে আজ বিজয়ের প্রহর গুনছে।

    দ্বিতীয়তঃ মুসলিমদের উপর নির্যাতনের নেতৃত্বদানকারী আমেরিকার বিপুল অর্থনীতির পতনের সূচনা হয়েছে এই মোবারক হামলার মাধ্যমে। ৯/১১ এর কারণে শুধুমাত্র টুইন টাওয়ার ও এর মধ্যকার যাবতীয় উপকরণ ধ্বংস হয়ে যাওয়া ও তা পুননির্মাণ অর্থাৎ ফিজিক্যাল ড্যামেজের কারণে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৬৬ বিলিয়ন ডলারের’ও বেশি। এর সাথে সাথে এই মোবারক হামলার কারণে পরবর্তী দশ বছরে আমেরিকার এয়ারলাইন ইন্ড্রাস্টি, এয়ারপোর্ট সিকিউরিটি, অতিরিক্ত নিরাপত্তার কারণে ব্যয়িত সময়ে ক্রমবর্ধমান আর্থিক ক্ষতি, ট্যুরিজম ইন্ড্রাস্টি, লোকাল ও ফেডারেল সিকিউরিটি, হোমল্যান্ড সিকিউরিটি, ইনস্যুরেন্স লস, জিডিপি হ্রাস ও শেয়ার মার্কেটের ক্ষতির হিসাব করলে তা ৩১৫ বিলিয়নের থেকেও বেশি দাঁড়ায়। (৩)

    এটা হল ৯/১১ এর কারণে আমেরিকার অভ্যন্তরে সৃষ্ট ক্ষতির পরিমাণ। এই হামলার কারণে আমেরিকার সবচেয়ে বড় ক্ষতিটি হয়েছে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ওয়ার অন টেররের সূচনা করা। যা ছিল এই হামলার একটি বড় লক্ষ্য। আমেরিকার মাটিতে আমেরিকার উপর আঘাত আসার কারণে আমেরিকার ঔদ্ধত্য চুরমার হয়ে যায়। যার ফলে বোকা আমেরিকা পরিণতির কথা না ভেবেই আফগানিস্তানে তাদের জন্য তৈরিকৃত মরণফাঁদে এসে এক দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এটাই মুজাহিদদের চাওয়া ছিল। মুজাহিদদের পছন্দমত ভূমিতে আমেরিকাকে টেনে এনে দীর্ঘ ২০ বছরের এক যুদ্ধের সূচনা করা হল। যুদ্ধের এই চোরাবালিতে আটকে গিয়ে ক্ষয়ে যেতে শুরু হয় অ্যামেরিকার অর্থনীতি। মরুভূমিতে পানির মতই আফগান এবং ইরাক যুদ্ধ চুষে নিতে থাকে অ্যামেরিকার অর্থনীতি!

    ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণ ছিল আরও একটি চোরাবালিতে আটকে যাওয়া। ওয়ার অন টেররের চোরাবালিতে আটকে গিয়ে আজ পর্যন্ত আমেরিকার ক্ষতির পরিমাণ হিসাব করলে দেখা যায় তা ৩.৩১৪ ট্রিলিয়নের চেয়েও বেশি। আমেরিকার ব্রাউন ইউনিভার্সিটির রিপোর্ট অনুযায়ী যুদ্ধকালীন খরচ, যুদ্ধপরবর্তী আহতদের খরচসহ আফগানে আমেরিকার মোট খরচ হয়েছে ২.৩১৩ ট্রিলিয়ন। আর ইরাক যুদ্ধে ব্যয় হয়েছে ১.২ ট্রিলিয়ন। ফালিল্লাহিল হামদ। যে বিশাল অর্থনীতির দাপটে আমেরিকা মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছিল সে অর্থনীতি আজ মুখ থুবড়ে পড়েছে।

    ৯/১১ এর মোবারক হামলার সফলতা আজ আমাদের সামনে দিনের আলোর ন্যায় স্পষ্ট।

    তৃতীয়তঃ প্রথমে আফগানিস্তান ও পরে ইরাকে আমেরিকা নিজস্ব সেনাবাহিনী পাঠিয়ে সবচেয়ে বড় ভুল করে বসে। মুসলমানদের সামনে স্পষ্ট হয়ে যায় তাদের মূল শত্রু কে? ফলে বৈশ্বিক এই কুফুরী শক্তির মোকাবেলায় বিভিন্ন অঞ্চলে মুসলিমরা জামাত বদ্ধ হতে শুরু করে। মুসলিমদের সকল কর্মতৎপরতায় আমেরিকান স্বার্থে আঘাত হানার নীতি গৃহীত হয়। বৈশ্বিক জিহাদের এই ধারা মুসলিমদের মাঝে নতুন চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। সাথে সাথে আফগানে আমেরিকার পরাজয় আর তালেবানের বিজয়ে মুসলামনদের সামনে এই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায় যে, পৃথিবীতে ইসলামের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য গণতন্ত্র নয় জিহাদই হল একমাত্র এবং কার্যকরী পদ্ধতি।

    সফলতার হিসাব করলে তা শেষ হবে না। আল্লাহর অনুগ্রহে জিহাদের বদৌলতেই উম্মাহ এই সফলতার মুখ দেখেছে।

    ৯/১১ এর গুরুত্ব ও গভীর তাৎপর্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে কিছু সরলমনা মুসলমান ভাই অজ্ঞতার কারণে বলতে চান, এই মোবারক আক্রমণ শরীয়ত কর্তৃক অনুমোদিত ছিল না। তাদের মতে বিশ্ব সন্ত্রাসের কেন্দ্রবিন্দু পেন্টাগন ও মূল চালিকাশক্তি ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে আক্রমণ করা ইসলাম সমর্থন করে না। তাই এখানে আমরা শরিয়াহ’র আলোকে ৯/১১ এর উপর তাদের পক্ষ থেকে আরোপিত প্রশ্ন ও সেগুলোর জবাব নিয়ে সংক্ষেপে কিছু কথা বলব ইনশাআল্লাহ।

    প্রথমতঃ আমেরিকা একটি হারবী দেশ বা মুসলিমদের সাথে যুদ্ধরত দেশ। মুসলিমদের সাথে আমেরিকার কোন নিরাপত্তা চুক্তি ছিল না। আর যদি মুসলিমদের সাথে আমেরিকার কোনো নিরাপত্তা চুক্তি থেকেও থাকে তবে আমেরিকা সেই চুক্তি একবার নয় বারবার ভঙ্গ করেছে। ইসরাইল কর্তৃক ফিলিস্তিনি মুসলিমদের উপর সকল আক্রমণের সমর্থন ও সহযোগিতার মাধ্যমে, সুদানের আশ শিফা হাসপাতালে বোম্বিংয়ের মাধ্যমে, লেবাননের মুসলিমদের উপর ইসরাইলি আক্রমণে সহযোগিতার মাধ্যমে, এ ছাড়াও বিভিন্ন মুসলিমদেশে স্থানীয় সরকার কর্তৃক মুসলিমদের উপর নির্যাতনে আমেরিকা সবসময়ই সহযোগিতা করে এসেছে। এত অপরাধ করা সত্ত্বেও কীভাবে একটি দেশের চুক্তি বহাল থাকতে পারে? সুতরাং আমেরিকার উপর আক্রমণে কোনো ধরনের চুক্তি লঙ্ঘিত হয়নি। বরং এটাই তার প্রাপ্য ছিল। এবং যতদিন পর্যন্ত তারা এই ধরনের কার্যক্রম থেকে পরিপূর্ণভাবে বিরত না হবে ততদিন পর্যন্ত এটাই তাদের জন্য নির্ধারিত থাকবে।

    দ্বিতীয়তঃ অনেকে বলেন, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ও পেন্টাগনে নিহতরা এবং চারটি বিমানের যাত্রীদের মধ্যে তো অনেক বেসামরিক লোক ছিল, তাই তাদেরকে হত্যা করা বৈধ হয়নি। কেননা, শাসকদের অপরাধের কারণে সাধারণ লোকদের শাস্তি দেওয়া ইসলাম সমর্থন করে না।

    এই সংশয়ের উত্তরে কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়।

    যখন কোনো জাতি যুদ্ধ ঘোষণা করে তখন তাদের সকলকেই সেই সিদ্ধান্তের দায়ভার বহন করতে হয়। সামরিক, বেসামরিক, শাসক বা সাধারণ জনগণের মাঝে কোনো পার্থক্য থাকে না। বরং পুরো জাতিকেই যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যেমনটা আমরা দেখতে পাই রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনে। মদীনার ইহুদি গোত্র বনু কুরাইজার সাতশ লোককে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হত্যা করেছেন। বাকিদেরকে গোলাম বানিয়েছেন। কারণ তাদের অপরাধ ছিল মুসলামনদের সাথে গাদ্দারি করে চুক্তি ভঙ্গ করা। চুক্তি ভঙ্গের এই সিদ্ধান্তটি সে গোত্রের নেতাদের থাকলেও সামরিক, বেসামরিক সকলকেই সেই অপরাধের শাস্তি পেতে হয়েছিল। কাউকে হত্যা করে শাস্তি কার্যকর করা হয়েছে আর কাউকে গোলাম বানিয়ে। মোটকথা, আমেরিকা যখন মুসলিমদের উপর আক্রমণ করেছে তখন থেকে পুরো আমেরিকান জাতি শাস্তির উপযুক্ত হয়ে গিয়েছে। তাই ৯/১১ এর আক্রমণে যে সকল বেসামরিক কাফের মারা গিয়েছে তারাও তাদের শাসকদের মত সমান দোষে দোষী ছিল। যেমনটা ছিল বনু কুরাইযার সাধারণ মানুষেরা। তাই তাদের হত্যা করা কখনোই শরিয়াহ বিরোধী নয়। এমনকি এটি কাফেরদের ও অনুসৃত নীতি। অতিরিক্ত কাফের প্রীতি কিংবা কাফের ভীতির জন্য আমাদের এই নুন্যতম তথ্যটুকুও যানার সুযোগ হয়নি!

    একই এই আক্রমণটি ছিল একটি প্রতিশোধমূলক আক্রমণ। বিভিন্ন মুসলিম দেশে আমেরিকা আমাদের যত মুসলিম ভাইদের হত্যা করেছে, যত মা বোনের রক্ত ঝরাতে ও তাদের সম্ভ্রম নষ্ট করতে সহযোগিতা করেছে , যত শিশু সন্তানকে তারা হত্যা করেছে ৯/১১ ছিল সে সকল মাজলুমানের পক্ষ থেকে একটি প্রতিশোধ। আর আল্লাহ তাআলা বলেছেনঃ

    وَاِنۡ عَاقَبۡتُمۡ فَعَاقِبُوۡا بِمِثۡلِ مَا عُوۡقِبۡتُمۡ بِہٖ ؕ

    আর যদি তোমরা প্রতিশোধ গ্রহণ করো তাহলে তারা তোমাদেরকে যেভাবে আক্রমণ করেছে ঠিক সেভাবেই তোমরা প্রতিশোধ গ্রহণ করো। (সূরা আন-নাহল, ১২৬)

    আমেরিকা আমাদের নিরপরাধ সন্তানদের হত্যা করেছে, আমাদের পর্দাশীল মা বোনদের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে, তাদের বেইজ্জত করেছে, তাদের স্বামীদের আর সন্তানদের হত্যা করেছে, আমাদের ভূমিতে বোমা ফেলেছে, তাদের বিষাক্ত বোমার কারণে হাজার হাজার বিকলাঙ্গ শিশু জন্ম নিচ্ছে!  ৯/১১ হামলার ঘটনায় নিহত শিশু ১০ এর অধিক নয়, অপর দিকে অ্যামেরিকা শুধু মাত্র ইরাকেই হত্যা করেছে ৫ লক্ষ শিশু! নিঃসন্দেহে ৯/১১ ছিল মুমিনদের হৃদয়প্রশান্তকারী আক্রমণ। এটি অত্যন্ত আনন্দের একটি ঘটনা, যা প্রতি বছর মুসলিমদের অন্তরে অনাবিল প্রশান্তি ছড়িয়ে দেয়। শুধুমাত্র কাফের প্রীতিতে আন্দোলিত এবং কাফের ভীতিতে উদ্বিগ্নরাই এই আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়!

    পরিশেষে, ৯/১১ এর হামলা ছিল একটি যুগান্তকারী ঘটনা। শরীয়ত ও মানবিক, সবদিক থেকেই এই আক্রমণের যথার্থতা প্রমাণিত। আমরা আজ কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করছি এই মোবারক ইতিহাসের মূল শক্তি শাইখ উসামা বিন লাদেন (রহিমাহুল্লাহ) কে। স্মরণ করছি, হামলার পরিকল্পনাকারী শাইখ খালেদ শাইখ মুহাম্মাদ (ফাক্কাল্লাহু আসরাহ) কে। যিনি এখন তাগুত আমেরিকার কারাগারে বন্দি জীবনযাপন করছেন। আল্লাহ তাআলা তার দ্রুত মুক্তির ব্যবস্থা করে দিন। আরও স্মরণ করছি, এই ইতিহাসের বাস্তবায়নকারী সেই ১৯ জন অভূতপুর্ব যুবককে ইতিহাস যাদের স্মরন করবে! যারা নিজেদের রক্ত দিয়ে উম্মাহর বিজয়ের পথ রচনা করে দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা তাদের সকলকে শহীদ হিসেবে কবুল করে নিন। সকল বন্দির উত্তম ও দ্রুত মুক্তির ব্যবস্থা করে দিন। উম্মাহকে তাদের দেখানো পথে চলার তাওফীক দান করুন। খিলাফাহ আলা মিনহাজিন নুবুওয়্যাহ প্রতিষ্ঠার এই সংগ্রামকে সফল করুন। আমিন। ইয়া রাব্বাল আলামিন।

    লেখক: মাওলানা আব্দুল্লাহ মুনতাসির হাফিজাহুল্লাহ

    Footnote:

    (১) এই হামলার মূল পরিকল্পনাকারী খালিদ শাইখ মুহাম্মাদ ফা: রচিত “ওবামার প্রতি খোলা চিঠি”। ৯-১০

    (২) নোট: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সময় আরব উপদ্বীপ বলতে বুঝানো হতো-একদিকে এডেন হতে ইরাক পর্যন্ত অন্যদিকে জেদ্দা হতে সিরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল এলাকাকে।

    (৩) https://yhoo.it/3tn2601

    2 মন্তব্যসমূহ

    1. আলহামদুলিল্লাহ, মুহতারাম মাওলানা আব্দুল্লাহ মুনতাসির হাফিজাহুল্লাহ এর লেখা থেকে বরাবরই উপকৃত হয়ে থাকি। আজকের এই লেখা থেকেও উপকৃত হলাম।
      আল্লাহ তায়ালা মুহতারামের লেখাকে এই উম্মাহর কল্যাণের জন্য কবুল করেন, এবং তাঁকে পরিপূর্ণ নিরাপত্তার সাথে জীবন যাপন করার তৌফিক দান করেন।

    Leave a Reply to Sumaiya Jannat প্রতিউত্তর বাতিল করুন

    দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
    দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

    পূর্ববর্তী নিবন্ধনবগঠিত সরকার ও মন্ত্রিপরিষদের নীতি সম্পর্কে ইমারতে ইসলামিয়া আফগানিস্তানের আমীরের পক্ষ থেকে বার্তা
    পরবর্তী নিবন্ধজেল পালিয়ে যাওয়া ফিলিস্তিনিদের ৬ আত্মীয়কে ধরে নিয়ে গেছে ইসরাইল’