সাবেক একজন চীনা গোয়েন্দা কর্মকর্তা যিনি নিজে একসময় এ ধরনের নির্যাতনমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিলেন তিনি এবিষয়টি নিয়ে মুখ খুলেছেন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে দেওয়া প্রায় তিনঘণ্টার এক সাক্ষাৎকারে তিনি চীনের গোপন এই কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ফাঁস করে দিয়েছেন। বর্তমানে ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা ইউরোপের একটি দেশে আশ্রয় নিয়েছে। চীনে তার পরিবারের বাকি সদস্যরা থাকায় সে তার নাম-পরিচয় গোপন রাখার অনুরোধ করেছেন। তবে, তার নাম-পরিচয় এবং পদবি সম্পর্কে সিএএন তথ্য সংগ্রহ করে তার পরিচয়ের সত্যতা নিশ্চিত করেছে। প্রয়োজনে তা আদালতে দেখানো যাবে বলেও আশ্বস্ত করেছে সংবাদমাধ্যমটি।
চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের বাসিন্দা আব্দুওয়ালি আইয়ুপ (৪৮) পেশায় একজন স্কুলশিক্ষক। নিজের একটি কিন্ডারগার্টেনে ছোট বাচ্চাদের উইঘুর ভাষা শিক্ষা দেন তিনি।
আইয়ুপের অভিযোগ, ২০১৩ সালের ১৯ আগস্ট স্কুলের সামনে থেকে তাকে আটক করে পুলিশ। আটকের পর কাশগর শহরের একটি ডিটেনশন সেন্টারে তার প্রথম রাত কাটে। এই স্কুলশিক্ষকের অভিযোগ, সেখানে কারারক্ষীদের নির্দেশে ১২ জন বন্দী তাকে গণহারে বলাৎকার করেছেন। নির্যাতনে বমি ও পায়খানা-প্রস্রাব করে দিলেও সারারাত ধরেই তার ওপর এমন পাশবিক নির্যাতন চলে।
‘আইয়ুপ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থজোগান দিচ্ছেন’, এমন স্বীকারোক্তি আদায়ে তার ওপর দীর্ঘদিন ধরে নির্যাতন চালানো হয়। অবশেষে ২০১৪ সালের ২০ নভেম্বর বিশেষ শর্তে মুক্তি পান তিনি। এত বছর পরেও সেই দুঃসহ স্মৃতি এখনো তাড়া করে বেড়ায় এই স্কুলশিক্ষককে।
এদিকে বর্তমানে নেদারল্যান্ডসে বসবাস করছেন ওমির বেখিল। যার বাবা একজন কাজাখ এবং মা উইঘুর সম্প্রদায়ের। সন্ত্রাসবাদে সমর্থন দেওয়ার অভিযোগে গত ২৬ মার্চ ২০১৭ সালে তাকে আটক করে চীনা বাহিনী। স্বীকারোক্তি আদায়ে ক্যারামে সিটির একটি পুলিশ বেজমেন্টে তার ওপর টানা চারদিন নির্যাতন চালানো হয়।
নির্যাতনের শিকার অপর এক উইঘুর মুসলিম ওমির বেখিল। চীন ছেড়ে বর্তমানে তিনি ইউরোপে আশ্রয়গ্রহণ করেছেন।
নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে বেখিল বলেন, এক ধরনের চেয়ারে (টাইগার চেয়ার) বসিয়ে তাদের পেটানো হতো। পা উপরে বেঁধে, মাথা নিচে ঝুলিয়ে দিয়ে উরু-নিতম্বে পিটিয়ে থেঁতলে দেওয়া হতো।
বোঝার সুবিধার্থে এখানে তার নাম ‘ঝিয়াং’ হিসেবে ব্যবহার করা হলো। ঝিয়াং বলেন, ‘আমাদের গণহারে আটকের নির্দেশ থাকতো। বিশেষ করে সেটা রাতের বেলায়। কোনো এলাকায় যদি একশজন মানুষ থাকতো, আমাদের ওপর নির্দেশ থাকতে তাদের সবাইকে আটক করা এবং স্বীকারোক্তি আদায় করা। আমরা জানতাম, কোনো এলাকার সবাই বিচ্ছিন্নতাবাদে লিপ্ত হতে পারে না। কিন্তু আমরা কেবল নির্দেশ বাস্তবায়ন করতাম।’
ঝিয়াং আরও জানান, ‘স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য প্রায় প্রতিটি বন্দীকে পেটানো হতো। বৃদ্ধ, নারী এমনকি ১৪ বছরের কিশোররাও এ ক্ষেত্রে বাদ পড়তো না’।পায়ে সবসময় পরিয়ে রাখা হতো মোটা ও ভারী শেকল। সেই সঙ্গে দুইহাত পেছনে একত্রিত করে আরেকটি শেকল দিয়ে বেঁধে সেভাবেই ঘুমাতে বাধ্য করা হতো। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বন্দীদের প্রায় কয়েকদিন ঘুমাতেও দেওয়া হতো না।
উইঘুর সম্প্রদায়ের এই মুসলিম ব্যবসায়ী বলেন, নির্যাতন ও দীর্ঘ আট মাস কারাভোগের ফলে তার শরীর কঙ্কালসার হয়ে যায়। নির্যাতনে পরিচিত কয়েকজনকে মারা যেতেও দেখেছেন তিনি। নিজে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন জানিয়ে বেখিল বলেন, ‘আমি একজন ধর্মভীরু মানুষ। এমন নির্যাতনের মধ্যেও আল্লাহর ওপর বিশ্বাসের জোরেই আমি বেঁচে ফিরেছি। আর সেই বিশ্বাসই ছিলো আমার একমাত্র শক্তি’।
আইয়ুপ ও বেখিল মাত্র দুটি চরিত্র, যারা জিনজিয়াংয়ে চীনা প্রশাসনের পদ্ধতিগত নির্যাতনের শিকার। প্রকৃতপক্ষে এই সংখ্যা অন্তত ১৫ লাখেরও বেশি। যাদের মধ্যে কাউকে স্বেচ্ছাশ্রমে বাধ্য করা হচ্ছে, আবার কারো ওপর শারীরিক-মানসিক, এমনকি যৌন নির্যাতনও চালানো হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে বারবার অভিযোগ তোলা হলেও বরাবরই বিষয়টি অস্বীকার করে আসছে দেশটির কমিউনিস্ট সরকার।
তাদের পক্ষ থেকে এটাকে বিচ্ছিন্নতাবাদ থেকে মুক্ত রাখতে পুনঃশিক্ষণ কর্মশালা বলে দাবি করা হচ্ছে।
অপেক্ষা কর হে জালিম!!