আফগান তালিবান ও পাকিসেনাদের মধ্যকার উত্তেজনা : পটভূমি ও নিকট ভবিষ্যত (দ্বিতীয় কিস্তি)

    ত্বহা আলী আদনান

    3
    2698
    আফগান তালিবান ও পাকিসেনাদের মধ্যকার উত্তেজনা : পটভূমি ও নিকট ভবিষ্যত (দ্বিতীয় কিস্তি)

    তালিবানদের বিরুদ্ধে ক্রুসেড যুদ্ধে পাকিস্তানের ভূমিকা:

    যে বাধ্যবাধকতা এবং পরিস্থিতি পাকিস্তানকে আফগানিস্তানে ন্যাটোকে সমর্থন করতে প্ররোচিত করেছিল তা আরও গবেষণার বিষয়। তবে উল্লেখ্য যে, পাকিস্তানের সীমাহীন সমর্থন ছাড়া আফগানিস্তানে এ ধরনের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে কখনোই সম্ভব ছিলো না। আফগানিস্তানের সাথে আন্তর্জাতিক কোন সমুদ্রের সংযোগ নেই। ফলে পশ্চিমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না যে, তারা ভারী সব যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে আফগানিস্তানে আক্রমণ করবে। তবে আন্তর্জাতিক সমুদ্রের সাথে সংযুক্ত রয়েছে আফগানিস্তানের প্রতিবেশি মাত্র দুটি দেশের, ইরান ও পাকিস্তান।

    আফগানিস্তানের অন্যান্য প্রতিবেশী হল স্থলবেষ্টিত দেশ। যেগুলোতে সম্পূর্ণভাবে আমেরিকার রাজনৈতিক শত্রু চীন ও রাশিয়ার প্রভাব বিস্তৃত। এই ক্ষেত্রে, ন্যাটো আফগানিস্তানে ক্রমাগত সরবরাহ বজায় রাখার জন্য পাকিস্তানের উপর নির্ভরশীল ছিলো। ন্যাটোর সমস্ত সরবরাহ ভারত মহাসাগর হয়ে পাকিস্তানে এসে পৌঁছতো। আর এই ভূখণ্ডের স্থলপথেই আফগানিস্তানে ন্যাটোর সমস্ত সরবরাহ পাঠানো হয়েছিল।

    এরফলে পাকিস্তানে নতুন করে মুজাহিদদের বিভিন্ন ছোট ছোট গ্রুপ তৈরি হয়। যাদের লক্ষ্য ছিলো ইমারতে ইসলামিয়ার সমর্থনে ন্যাটোর এই সরবরাহে আঘাত হানে। সেইসাথে পাকিস্তানের ভূখণ্ডেই তাদেরকে প্রতিরোধ করা এবং এসব সরবরাহ আফগানিস্তানে পৌঁছাতে বিলম্বিত করা। যাতে আফগান তালিবানরা এই সময়ের মধ্যে প্রস্তুতি নিতে পারেন এবং ক্রুসেডারদের এই সরবরাহ সঠিক সময়ে আফগানিস্তানের না পৌঁছে। আর এতে পাকিস্তানের এই মুজাহিদ গ্রুপগুলো সফলও হয়। যার ফলে মার্কিনীদের প্লান নষ্ট ও প্রচুর পরিমাণে ক্ষতি হতে লাগলো। সেইসাথে অপরপ্রান্তের মুজাহিদরা সফলতা পান। আর এসব কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের গোলাম পাকিস্তান সরকারগুলি এই মুজাহিদ গোষ্ঠীগুলির বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরু করে।

    পাকিস্তান রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ব্যক্তিরা এই সরবরাহগুলি আফগানিস্তানে পৌঁছানো নিশ্চিত করার বিনিময়ে প্রচুর মুনাফা অর্জন করে।

    এই ক্ষেত্রে, পাকিস্তান সরকার, আরও স্পষ্টভাবে বলতে গেলে গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এবং রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণকারী পাকিস্তানি গাদ্দার সেনাবাহিনী, আফগান যুদ্ধে প্রকাশ্যে ক্রুসেডার আমেরিকার পক্ষ নেয়। পাকিস্তান তার জাতীয় স্বার্থের সাথে সামঞ্জস্য রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যে জোট প্রতিষ্ঠা করেছিল তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আফগানিস্তানে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সক্ষম করে। পাকিস্তানের এই সমর্থন ২০২১ সালের আগস্টে যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।

    এই যুদ্ধে পাকিস্তানের আরেকটি পদক্ষেপ ছিল আফগান তালেবান নেতাদের গ্রেপ্তার করা। এই নেতাদের পাকিস্তানের পশতুন জনগোষ্ঠী তাদের অঞ্চল এবং দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন দ্বীনি প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় দেন। আর এই পদক্ষপে কয়েক ডজন আফগান তালিবান ও আল-কায়েদা নেতা এবং অনেক আরব মুজাহিদকে গ্রেফতার করে পাকিস্তান। যাদেরকে বহু বছর কারারুদ্ধ ও নির্যাতন করা হয়। যেসব অত্যাচারে প্রাণ হারান অনেকেই। আবার অনেককেই দিয়ে দেওয়া হয়েছিলো মার্কিন বাহিনীর কাছে।

    বর্তমানে আফগান তালিবান প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ অনেক সদস্য এবং নতুন সরকারের দায়িত্ব নেওয়া নিম্ন, মধ্যম এবং উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী ছিলেন।

    পাকিস্তানের প্রতি আফগান তালিবানের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল আপন ভাইয়ের মত। উপরন্তু তালিবানদের এই দৃষ্টিভঙ্গিই অনেক তালিবান সদস্যের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। কেননা তালিবান সদস্যদের যখন গাদ্দার সৈন্যরা দেখত, তখন তাদেরকে অস্ত্র রেখে কাছে আসতে বলা হত। আর সরল মনের কিছু তালিবান পাকি-সৈন্যদেরকে ভাই মনে করে তাদের সামনে উপস্থিত হতেন। তখনই তাঁরা বুঝতে পারতেন যে, তারা এই ভাই রুপি গাদ্দার সৈন্যদের হাতে বন্দী হচ্ছেন।

    ২০০১ সালে মার্কিন আগ্রাসনের ফলে তালিবান মুজাহিদদের প্রতিষ্ঠিত শরিয়াহ্ শাসনের সাময়িক পতন ঘটে। কিছু তালিবান মুজাহিদ পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ অঞ্চলে আশ্রয় নেন। তখন পাকিস্তান সরকার কর্তৃক গ্রেপ্তারের একটি বড় তরঙ্গ শুরু হয়। গাদ্দার সরকার শত শত আফগান তালিবান এবং তালিবান-সম্পর্কিত বিদেশী (আল-কায়েদা) যোদ্ধাদের ধরে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তর করে।

    আর বর্তমানে পাকিস্তানের প্রতি তালিবানদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হওয়ার সবচাইতে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির মধ্যে এই গ্রেপ্তার এবং কারাদণ্ড প্রক্রিয়া অন্যতম ।

    এই যুদ্ধে আমেরিকার পক্ষে গাদ্দার পাকিস্তানের তৃতীয় পদক্ষেপ ছিল, আফগান সীমান্তবর্তী পশতুন এলাকায় পাকিস্তানের যুদ্ধ ঘোষণা। উপজাতীয় এই অঞ্চলগুলি আফগানিস্তানে ক্রুসেডার ন্যাটো জোটের সরবরাহের উপর আক্রমণের কেন্দ্র ছিল। সেইসাথে পশতুন অঞ্চল এবং বেলুচিস্তান, যেখানে আফগান তালিবানরা আশ্রয় নিয়েছিল, সেখানে পাকিস্তান সরকার আক্রমণ শুরু করে। এখানে আফগানিস্তানের যুদ্ধের সমান্তরালে পাকিস্তান গাদ্দার সরকার কর্তৃক শুরু করা যুদ্ধে হাজার হাজার বেসামরিক মানুষ প্রাণ হারান। এসময় পাকিস্তান সরকার মারাত্মকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করে।

    উল্লেখ্য যে, পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল যেখানে পশতুন এবং অন্যান্য আফগান উদ্বাস্তুরা বাস করেন তা ছিল আফগানিস্তানের জন্য একটি সম্প্রসারণ। এই অঞ্চলগুলো স্বাভাবিকভাবেই আফগানিস্তানে চলমান যুদ্ধের সময় আফগান তালিবানদের সমর্থন এবং আশ্রয়ের লাইনে পরিণত হয়। যার ফলে গাদ্দার পাকিস্তান ও আমেরিকাকে চরম মূল্য দিতে হয়।

    এদিকে পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমের পশতুন অঞ্চলে দ্রুত তালেবানীকরণ এবং সামরিকীকরণও পাকিস্তান রাষ্ট্রের সামরিক প্রতিচ্ছবিকে আরও কঠোর করে তোলে। আফগানিস্তানের সাথে এই অঞ্চলের নৈকট্যকে পাকিস্তান সরকারের গোলামির পিছনে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাড়ায়। তাই শেষ পর্যন্ত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যৌথভাবে জারব-ই আজাব নামে এই অঞ্চলে অপারেশন চালাতে শুরু করে গাদ্দার সরকার। এরমাধ্যমে এই অঞ্চলের হাজার হাজার বেসামরিক লোককে শহিদ ও তাদের সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি করা হয়। মোটকথা তখন এই অঞ্চলটিকে পাকিস্তান সরকার একটি ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে।

    এই দৃষ্টিকোণ থেকে, এটা বলা যেতে পারে যে, আফগান তালিবানদের প্রতি পাকিস্তানের নাগরিকদের সমর্থন রয়েছে। অপরদিকে পাকিস্তান রাষ্ট্র এই সমর্থন প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছে। এ লক্ষ্যে গাদ্দার পাকিস্তান সরকার ৮০ হাজার পাকিস্তানি মুসলিমকে শহিদ করে।

    3 মন্তব্যসমূহ

    Leave a Reply to ali প্রতিউত্তর বাতিল করুন

    দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
    দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

    পূর্ববর্তী নিবন্ধএবার ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র ঘােষণার দাবি জানালো পুরীর উগ্র শঙ্করাচার্য
    পরবর্তী নিবন্ধমালি থেকে ইউরোপীয় আরও একটি দেশের সেনা প্রত্যাহার: বাড়ছে আল-কায়েদার হামলা