ইতিহাস অধ্যয়ন করলে দেখতে পাওয়া যায় সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্বের দীর্ঘ ইতিহাস। মিথ্যা সর্বদাই সত্যকে (ইসলাম) পরাজিত করার জন্য ভিন্ন ধরনের ষড়যন্ত্রের পথ খুঁজতে থাকে। তারা পার্থিব জগতে ইসলামের কেন্দ্রগুলোকে তাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে চায়, তাদের ওপর ইসলামবিরোধী সংস্কৃতি প্রসার ও প্রয়োগ করতে চায়। ইসলামের কেন্দ্রগুলোতে মিথ্যা ও প্রত্যাখ্যাত ধারণা ছড়িয়ে দিতে চায়। সেই সূত্রে তারা আফগানিস্তানেও বার বার এই চেষ্টা করেছে। কিন্তু প্রতিবারই তারা সত্যের পতাকাবাহীদের কাছে লাঞ্চনাকর পরাজয়ের বরণ করেছে।
যেহেতু আফগানিস্তান এই অঞ্চল ও বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং কৌশলগত দেশ, তাই বিশ্বের পরাশক্তিগুলো এই দেশ বার বার দখল করতে এসেও সবসময় ব্যর্থ হয়েছে। বৃটিশ বা রুশ যেই হোক না কেন, তারা এখানে নিজেদের শক্তি পরীক্ষা করতে এসে নিজেদের মাথা ও সম্পত্তি দিয়ে বড় মূল্য চুকিয়েছে। কিন্তু এখান থেকে তারা ব্যর্থতা ও অপমান ছাড়া আর কিছুই অর্জন করতে পারেনি। বিশ্ব আজও এই ভূমিতে দখলদারদের লজ্জাজনক পরাজয়ের গল্প বলছে এবং মানুষ এগুলোর উদাহরণ দিচ্ছে। কলামিস্টরা বিশ্বের পরাশক্তি আর অত্যাচারী শাসকদের এই ভূমিতে পা রাখার অনেক গল্প নথিবদ্ধ করেছে।
তবে প্রতিটি গল্পের শেষে এটাই লিপিবদ্ধ হয়েছে যে, আশ-শুহাদা ও ইসলামের এই বরকতময় ভূমি কখনোই বিদেশীদের আধিপত্য ও ক্ষমতা মেনে নেয়নি। তাই আফগান বীর মুসলিমদের বিরুদ্ধে বারে বারে শুরু হয়ছে ইতিহাসের এক একটি রক্তক্ষয়ী মহাযুদ্ধ।
কিন্তু আফগানরাও নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকেন নি, তারা হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে জিহাদ করেছেন, ত্যাগ স্বীকার করেছেন। দখলদাররা একের পর এক তাঁদের শহর, গ্রাম ও বাড়িঘর ধ্বংস করেছে। কনের বিয়ে, অনুষ্ঠান এবং ধর্মীয় উৎসবগুলিতেও বোমাবর্ষণ করা হয়েছে। ফলে সর্বত্র শোক ও দারিদ্রের হাহাকার ছিল। আফগান জাতি তবুও পরাজয় মেনে নেয়নি, মাথা নত করেনি।
অপরদিকে প্রতিটি দখলদার শত্রু তাঁদের কাছে পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। এই পরাজয় কেউ কাগজে কলমে স্বীকার করেছে আবার কেউ ময়দান ছেড়েই পালিয়েছে।
৯০ দশকে যখন রুশরা (আজকের রাশিয়া) আফগানদের প্রবল প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সামনে টিকতে না পেরে পরাজিত হয়, তখন তাদের ক্ষমতা ও পরাশক্তির ভাবমূর্তি ধূলিসাৎ হয়ে যায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পনেরটি রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে যায়।
তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এই বিজয়ের পর আফগানিস্তানে ইসলামী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা থাকলেও, তার পরিবর্তে এর বিরুদ্ধে সাতটি দল গঠিত হয়। প্রতিটি দল সিংহাসনে আরোহণের চেষ্টা করতে থাকে।
স্বভাবতই যখন একটি দেশে সাত রাজা থাকে, তখন তাদের মধ্যে পাপাচার ও দুর্নীতি বৃদ্ধি পায়। আর আফগানিস্তানেও তাই হয়েছিল। দেশটিতে ক্ষমতার লড়াই নিয়ে গৃহযুদ্ধ তীব্রতর হতে থাকে, সর্বত্র চেকপোস্ট বসিয়ে চলে নিষ্ঠুরতা, চুরি, ডাকাতি সহ সকল ধরনের অপরাধ।
তবে সেসময় এটি ছিল সর্বশক্তিমান আল্লাহর রহমত ও অনুগ্রহ যে, প্রয়াত আমিরুল-মুমিনিন মোল্লা মুহাম্মদ ওমর মুজাহিদ একটি একক সেনাবাহিনী এবং একটি একক কমান্ড গঠন করতে সক্ষম হন। মোল্লা ওমরের (রহিমাহুল্লাহ্) আগমনে ধীরে ধীরে আফগানরা সবাই এক পতাকাতলে জড়ো হলো। আফগানিস্তান বিশ্বের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠে। মুসলমানরা আফগানিস্তানে আশ্রয় নিতে থাকে।
কিন্তু বিশ্ব কুফ্ফাররা চায়নি আফগানরা শান্ত থাকুক। এখানে একটি ইসলামি রাষ্ট্র স্থায়ী হোক। যা সারা বিশ্বের জন্য একটি আদর্শ রোলমডেল হবে। তাই যখন ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার সহ ৩ টি স্থানে ৯/১১ হামলা হয়। তখন আমেরিকা কোন প্রমাণ ছাড়াই আফগানে অভিযান চালাতে এই হামলাকে বিশ্বের সামনে একটি অজুহাত হিসেবে দাড় করায়। সেই সাথে সিআইএ-এর নির্দেশে বিশ্ব মিডিয়ায় চলে নানারকম অপপ্রচার, যার মধ্যে অন্যতম ছিল নারী অধিকার।
ঐতিহাসিক ৯/১১ হামলার জন্য তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শহিদ ওসামা বিন লাদেন তাকবালুল্লাহকে দায়ী করে। সেই সাথে যারা এই বরকতময় হামলায় তাকে সহায়তা করেছেন। বিশেষ করে ইমারতে ইসলামিয়া আফগানিস্তান কে। কেননা শাইখ ওসামা বিন লাদেন রহিমাহুল্লাহ্ তখন ইমারাতে ইসলামিয়ার আশ্রয়ে আফগানিস্তানে অবস্থান করছেন।
ফলে ৭ অক্টোবর ২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালানোর সময় দুনিয়ার কুফ্ফাররা আমীরুল মুমিনীনকে বলেছিল, আফগান প্রশাসন যেনো ওসামি বিন লাদেনকে আমেরিকার হাতে তুলে দেয়। নয়তো আফগানিস্তানে হামলা চালানোর হুশিয়ারি দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
অপরদিকে মোল্লা মুহাম্মদ ওমর মুজাহিদ রহিমাহুল্লাহ্ আমেরিকার এসব হুমকি ধামকিকে ভয় না করে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে, শাইখ ওসামা বিন লাদেন রহিমাহুল্লাহ্ কে আমেরিকার হাতে তুলে না দেওয়ার।
এবিষয়ে, ২০০১ সালের অক্টোবর মাসে আফগানিস্তানে মার্কিন আগ্রাসনের এক মাস পূর্বে (সেপ্টেম্বর) ১২ মিনিটির একটি ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকার শুনতে পায় বিশ্ব। সাক্ষাৎকারটি ছিল প্রায়াত আমীরুল মুমিনিন মোল্লা মুহাম্মদ ওমর মুজাহিদ রহিমাহুল্লাহ্’র।
যেখানে তিনি দৃঢ় কন্ঠে বলেছিলেন যে – আমরা ওসামাকে আমেরিকার হাতে তুলে দিবো না। কেননা এটি কেবল ওসামা বিন লাদেনের প্রশ্নই নয়। বরং এর সাথে ইসলামের প্রশ্নও জড়িত। ওসামাকে তাদের হাতে তুলে দিলে ইসলামের মর্যাদা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। সেই সাথে এটি আফগান ঐতিহ্যেরও পরিপন্থী।
আর আজকে যদি আমরা ওসামাকে দূরে ঠেলে দেই, তাহলে আজ যেসব মুসলিমরা তাকে পরিত্যাগ করার জন্য আমাদেরকে অনুরোধ করছে, একদিন তারাই ওসামাকে দূরে ঠেলে দেওয়ায় আমাদেরকে ঘৃণা করবে। যাইহোক, আমার কক্ষণোই ওসামাকে আমেরিকার হাতে তুলে দিবো না। আর যদি আমরা এমনটা করি, তাহলে এর অর্থ দাঁড়ায় আমরা মুসলমানই না, আমাদের থেকে ইসলাম শেষ হয়ে গেছে।
এসময় তিনি আফগানিস্তানে আমেরিকার হামলার হুশিয়ারি সম্পর্কে বলেন :
আমার সামনে দু’টি ওয়াদা রয়েছে। একটি হচ্ছে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তাআ’লার ওয়াদা অপরটি বুশের ওয়াদা।
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তাআ’লার ওয়াদা হল- আমার জমীন সুবিশাল, যদি তুমি আল্লাহ্ তাআ’লার পথে জিহাদ কর, তবে তুমি পৃথিবীর যেকোনো জায়গায়ই নিরাপদে বসবাস করতে পারবে। সেই সাথে যারা সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর ঈমান এনেছে এবং তাঁর নিকট নিজেকে সঁপে দিয়েছে, তাদেরকে তিনি সাহায্য করার প্রতিশ্রোতী দিয়েছেন।
অপরদিকে বুশের ওয়াদা হল- আমার নাগাত বাইরে এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে তুমি নিরাপদে থাকতে পারো।
এখন আমরা দেখবো এই দুই ওয়াদার মধ্যে কার ওয়াদা সত্য হয়।
আমীরুল মুমিনিন উক্ত সাক্ষাৎকারে আরো বলেন :
এই সংঘাতের মাধ্যমে মূলত আমেরিকা নিজের পায়ে নিজেই কুঠার মারছে। তাই তাদেরকেই এর মূল্য দিতে হবে। আমেরিকা বিশ্বব্যাপি যে সংঘাত শুরু করেছে, তা কখনোই থামবেনা। এমনকি যদি আমি, ওসামা বা অন্যরা মারা যায়।
তাই আমেরিকার উচিৎ এখনই পিছু হটা এবং নিজেদের পলিসিতে পরিবর্তন আনা।
ইনশাআল্লাহ্ চলবে…
লিখেছেন : ত্বাহা আলী আদনান
পড়ুন আগের পর্বগুলো-