বিজয়ের মাস : মাহে রমাদানের গৌরবদীপ্ত বিজয়-সিরিজ।।পর্ব-৬।। ঐতিহাসিক মক্কা বিজয়: আরব উপদ্বীপে পৌত্তলিকদের নাপাক আধিপত্যের অবসান।(দ্বিতীয় কিস্তি)

0
1538
বিজয়ের মাস : মাহে রমাদানের গৌরবদীপ্ত বিজয়-সিরিজ।।পর্ব-৬।। ঐতিহাসিক মক্কা বিজয়: আরব উপদ্বীপে পৌত্তলিকদের নাপাক আধিপত্যের অবসান।(দ্বিতীয় কিস্তি)

সঙ্গোপনে শুরু হলো যুদ্ধের প্রস্তুতিঃ-

আবু সুফইয়ান মদীনা থেকে ‘চুক্তি নবায়নে ব্যর্থ হয়ে’ চলে যাবার কিছুদিন পরই রাসূল (ﷺ) সফর ও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দেন। সবাই নিজ নিজ সামানা প্রস্তুত করতে ব্যতিব্যস্ত। কিন্তু এ যুদ্ধ কোথায় হবে, কাদের বিরুদ্ধে হবে? এ ব্যাপারে কাউকে কিছুই জানানো হয়নি৷ ঘনিষ্ঠ সহচর হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুও জানেন না, এবারের যুদ্ধযাত্রা কোন দিকে হবে?

হযরত আবু বকর (রা:) স্বীয় কন্যা আম্মাজান আয়িশাহ রাদিয়াল্লাহু আনহার ঘরে প্রবেশ করে দেখলেন তারাও সফরের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “প্রিয় কন্যা! এ কীসের প্রস্তুতি?” হযরত আয়িশাহ রাদিয়াল্লাহু আনহা উত্তর দিলেন, “আল্লাহর ক্বসম, আমি জানিনা, এ কীসের প্রস্তুতি!” আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “এ তো বনু আসফার অর্থাৎ রোমকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সময় না; রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাহলে কোন দিকের ইচ্ছা করলেন আবার??” আয়িশাহ রাদিয়াল্লাহু আনহা বললেন, “আল্লাহর ক্বসম! এ সম্পর্কে আমি কিছুই জানিনা!!”

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) স্পষ্টভাবে কিছু না বললেও সাহাবায়ে কেরাম পূর্বাপর মিলিয়ে কিছুটা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, এবারের অভিযান কোথায় হতে পারে। কারণ, প্রথমে আমর ইবনে সালিম রাসূলের (ﷺ) দরবারে এসে কুরাইশদের ব্যাপারে চুক্তিভঙ্গের অভিযোগ করে গেল। এরপর একই অভিযোগ নিয়ে আসল বুদাইল। অতঃপর আবু সুফইয়ানের সন্ধিচুক্তি নবায়নের চেষ্টা- সব মিলিয়ে সাহাবায়ে কেরাম বুঝতে পেরেছিলেন যে, এবার রাসূল (ﷺ) এর উদ্দেশ্য মক্কা নগরী।

সাহাবায়ে কেরাম যুদ্ধের সরঞ্জামাদি তৈরী করে যুদ্ধযাত্রার জন্য প্রস্তুত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সবাইকে জানিয়ে দিলেন, “এবারের যুদ্ধাভিযান মক্কার কুরাইশদের বিরুদ্ধে হতে যাচ্ছে।” তথ্যটি যেনো কোনোভাবেই মদীনার বাহিরে না যায়, সে ব্যাপারেও কঠোর নির্দেশ দেন তিনি।

সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ তা’আলার দরবারে এ প্রার্থনাও করেন তিনি:
(‏اللّٰهُمَّ خُذِ الْعُيُوْنَ وَالْأَخْبَارَ عَنْ قُرَيْشٍ حَتّٰى نَبَغْتُهَا فِيْ بِلاَدِهَا‏)‏‏
হে আল্লাহ, কুরাইশদের গুপ্তচর ও সংবাদবাহকদের নিবৃত্ত রাখুন, যাতে আমরা তাদের শহরে অকস্মাৎ উপস্থিত হতে পারি!

হাতিব ইবনে আবী বালতা’আহ রাদিয়াল্লাহু আনহুঃ-

এদিকে হাতিব ইবনে আবি বালতা’আহ [১] রাদিয়াল্লাহু আনহু কুরাইশদের নিকট এই তথ্য সম্বলিত একটি পত্র প্রেরণ করেন যে, রাসূল মক্কা আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। পত্রটি পারিশ্রমিক দিয়ে এক মহিলার মাধ্যমে মক্কায় পাঠিয়ে দেন। কিন্তু রাসূল (ﷺ) এর উল্লিখিত দোয়ার কারণে আল্লাহ তা’আলা মুসলিমদের সব খবরাখবর গোপন রেখেছিলেন। সে-মতে ওহীর মাধ্যমে রাসূলকে (ﷺ) জানিয়ে দেওয়া হলো, হাতিব ইবনে আবি বালতা’আহ রাদিয়াল্লাহু আনহুর এই গতিভঙ্গি ও ক্রিয়াকর্মের কথা।

রাসূল (ﷺ) হযরত আলী, যুবাইর ইবনুল আওয়াম ও মিকদাদ রাদিয়াল্লাহু আনহুমকে [২] এই বলে প্রেরণ করেন যে, দ্রুত রাওজাতু খাখ [৩] নামক স্থানে যাও। সেখানে উটের উপর আরোহী একজন মহিলার দেখা পাবে। মক্কার কুরাইশদের নামে প্রেরিত একটা চিঠি আছে তার কাছে। তার থেকে চিঠিটা ছিনিয়ে নিয়ে দ্রুত মদীনায় ফিরে এসো!!

রাসূল (ﷺ) নির্দেশমত তারা তিনজন দ্রুতগামী ঘোড়ায় চড়ে সেখানে পৌঁছলে সত্যি সত্যিই একজন মহিলার [৪] দেখা পেলেন। তাকে থামিয়ে তারা জিজ্ঞেস করলেন, কোনো পত্র আছে তোমার কাছে? সে অস্বীকার করল। তারা ধমক দিলেন, ভয় দেখালেন, তার সব সামানার তল্লাশি নিলেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না।

সবশেষে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, “এটা হতেই পারে না যে, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) মিথ্যা বলেছেন! হয়তো, পত্র বের করে দাও না হলে আমরা বাধ্য হব তোমাকে বস্ত্রহীন করে সারা শরীর তল্লাশি করতে৷”

তাদের থেকে কঠোরতা আঁচ করতে পেরে চুলের খোঁপা থেকে সে একটা চিরকুট বের করে দিল। সেখানে লেখা ছিল –

“হাতিব ইবনে আবি বালতা’আহর পক্ষ থেকে মক্কার মুশরিকদের প্রতি..
অতৎপর, হে কুরাইশগণ, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তোমাদের আক্রমণের উদ্দেশ্যে রাত্রির অন্ধকারে প্রবাহিত সমুদ্র স্রোতের ন্যায় অগণিত সৈন্য নিয়ে মক্কা অভিমুখে অগ্রসর হচ্ছেন। আল্লাহর ক্বসম! তিনি যদি একাকীও তোমাদের নিকটে যান, তাহলেও আল্লাহ তা’আলা তাঁকে সাহায্য করে স্বীয় ওয়াদা পূরণ করবেন! তাই, নিজেদের ব্যাপার চিন্তা করে নিও!

ইমাম ওয়াক্বিদী একটি মুরসাল সনদে বর্ণিত বিষয়বস্তু উদ্ধৃত করে বলেছেন যে, হাতিব ইবনে আবি বালতা’আহ রাদিয়াল্লাহু আনহু মক্কার সোহাইল ইবনে আমর, সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া ও ইকরিমাহ ইবনে আবু জাহলের নিকট এ মর্মে পত্র লিখেছিলেন যে, “রাসূলুল্লাহ (ﷺ) লোকদের মাঝে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছেন। আমি তোমাদের ছাড়া অন্য কারো ধারণা করি না এবং আমি চাচ্ছি যে, আমার দ্বারা তোমাদের একটি উপকার হোক।” [৫]

রাসূল (ﷺ) হাতিব ইবনে আবি বালতা’আহকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, “হাতিব, এমন কাজ কেনো করতে গেলে??”
তিনি অনুনয়ের স্বরে বললেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! (ﷺ) আমার ব্যাপারে সিন্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তাড়াহুড়া করবেন না! আল্লাহর ক্বসম! আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (ﷺ) প্রতি পূর্ণ ঈমান রাখি। আমি ধর্মত্যাগী হয়ে যাইনি। আমি এ কাজ শুধু এ জন্য করেছি যে, আমার পরিবার ও সন্তানাদি মক্কায় রয়ে গেছে। তাদের দেখভাল করার জন্য মক্কায় আমার কোনো আপনজন নাই। আমার ভয় হলো, আল্লাহ না করুন আমরা যদি এই যুদ্ধে পরাজিত হই, তাহলে মক্কার মুশরিকরা আমার পরিবারের উপর যে অত্যাচার চালাবে তা থেকে তাদের রক্ষা করার কেউ নাই। তাই আমি এই পত্র পাঠিয়েছিলাম, যেনো মক্কার মুশরিকরা আমার প্রতি একটু সদয় থাকে!

হযরত উমর (রাঃ) ক্রোধান্বিত হয়ে উঠলেন। রাসূলকে (ﷺ) বললেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে অনুমতি দিন, এক্ষুণি এই মুনাফিকের গর্দান উড়িয়ে দিই!’ রাসূল (ﷺ) বললেন, উমর! তুমি কি জান না সে বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল? বদরীদের ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলা বলে দিয়েছেন: “তোমরা যা খুশি করো, আমি তোমাদের ক্ষমা করে দিয়েছি!” রাসূলের (ﷺ) কথা শুনে হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠল। হযরত হাতিব ইবনে আবি বালতা’আহ রাদিয়াল্লাহু আনহুকে এমন কথা বলার জন্য তিনি অনুতপ্ত হলেন। তাঁর যবান থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে আসল “আল্লাহু ও রাসূলুহু আ’লাম!

সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) ও সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে কাফেরদের সাথে এরূপ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বর্জন করতে এবং তা থেকে বিরত থাকতে উক্ত ঘটনার প্রেক্ষিতে আল্লাহ তা’আলা সূরা মুমতাহিনাহর প্রথম চারটি আয়াত নাযিল করেন। যেখানে তিনি ইরশাদ করেন –

“হে মুমিনগণ, তোমরা আমার ও তোমাদের শত্রুদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তোমরা তো তাদের প্রতি বন্ধুত্বের বার্তা পাঠাও, অথচ তারা যে সত্য তোমাদের কাছে আগমন করেছে, তা অস্বীকার করছে। তারা রসূলকে (ﷺ) ও তোমাদেরকে বহিস্কার করে দেয় শুধু এই অপরাধে (?) যে, তোমরা তোমাদের পালনকর্তার প্রতি বিশ্বাস রাখ। যদি তোমরা আমার সন্তুষ্টিলাভের জন্যে এবং আমার পথে জিহাদ করার জন্যে বের হয়ে থাক, তবে কেন তাদের প্রতি গোপনে বন্ধুত্বের পয়গাম প্রেরণ করছ? তোমরা যা গোপন কর এবং যা প্রকাশ কর, তা আমি খুব জানি। তোমাদের মধ্যে যে এটা করে, সে সরলপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যায়।”
(সহীহ বুখারী-৪২৭৪)

এভাবেই আল্লাহ তা’আলা রাসূল (ﷺ) এর কৃত দোয়া কবুল করেছেন এবং মক্কা বিজয়ের জন্য সাহাবায়ে কেরামের এই প্রস্তুতির সংবাদ গোপন রেখেছেন।

মক্কার পথে মুসলিম বাহিনীঃ-

অষ্টম হিজরীর ১০- রমাদান, রাসূল (ﷺ) ১০ হাজার সাহাবীকে সাথে নিয়ে মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। যাবার আগে হযরত আবু যর গিফারী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে মদীনায় নিজের স্থলাভিষিক্ত করে যান। উম্মাহাতুল মুমিনীনদের মধ্যে হযরত উম্মে সালামাহ ও হযরত মায়মূনা রাদিয়াল্লাহু আনহুমা রাসূলের (ﷺ) সাথে ছিলেন।

পথিমধ্যে জুহফাহ [৬] নামক স্থানে হযরত আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর সাথে দেখা হয়। তিনি স্ব-পরিবারে ইসলাম গ্রহণ করে মদীনায় হিজরত করছিলেন। রাসূল (ﷺ) তার আসবাবপত্র ও পরিবারের সবাইকে মদীনায় পাঠিয়ে দিয়ে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুকে নিজেদের সফরসঙ্গী করে নেন। সে-মতে তিনি পুনরায় মক্কার দিকে রওয়ানা হন।

রাসূলের (ﷺ) চাচাতো ভাই আবু সুফইয়ান ইবনুল হারিস [৭] ও ফুফাতো ভাই আব্দুল্লাহ ইবনু আবি উমাইয়াহও ইসলাম গ্রহণ করতে মদীনায় যাচ্ছিলেন৷ আবওয়া নামক স্থানে রাসূলের (ﷺ) সাথে তাদের সাক্ষাৎ হয়। মক্কার জীবনে তারা রাসূলকে (ﷺ) সীমাহীন কষ্ট দিয়েছিল। ফলে তিনি তাদের প্রতি চরম অসন্তুষ্ট ছিলেন। তাঁর সাথে প্রথম সাক্ষাতের অনুমতি চাওয়া হলে তিনি অনুমতি দেননি৷ পরবর্তীতে হযরত উম্মে সালামাহ রাদিয়াল্লাহু আনহা রাসূলকে (ﷺ) বললেন, “এটা কী করে হয় যে, আপনি অন্যদেরকে ক্ষমা করছেন অথচ আপনার চাচাতো ও ফুফাতো ভাইয়েরা আপনার ক্ষমা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে!!”

এদিকে আলী দিয়াল্লাহু আনহু তাদের শিখিয়ে দিলেন যে, তোমরা রাসূলের (ﷺ) এর সামনে গিয়ে ঐভাবে ক্ষমা চাও, ইউসুফ আলাইহিস সালামের সামনে যেভাবে তার ভাইয়েরা ক্ষমা চেয়েছিলেন। তারা তাই করল। রাসূলের (ﷺ) সামনে দাঁড়িয়ে বলল:
‏(‏تَاللهِ لَقَدْ آثَرَكَ اللهُ عَلَيْنَا وَإِن كُنَّا لَخَاطِئِيْنَ‏)‏
“আল্লাহর কসম! আল্লাহ আপনাকে আমাদের উপর সম্মানিত করেছেন এবং নিশ্চয়ই আমরা দোষী ছিলাম।”(সূরা ইউসুফ,আয়াত নং- ৯১)

তাদের থেকে উক্ত আয়াত শোনার সাথে সাথে রাসূলের (ﷺ) যবান দিয়ে বেরিয়ে আসল হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালামের সেই অমর বাণী:
(‏لاَ تَثْرَيبَ عَلَيْكُمُ الْيَوْمَ يَغْفِرُ اللهُ لَكُمْ وَهُوَ أَرْحَمُ الرَّاحِمِيْنَ‏)‏
“অদ্য তোমাদের উপর কোন নিন্দা নেই। আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করুন এবং তিনি দয়াশীলদের চাইতেও অধিক দয়ালু।” (সূরা ইউসুফ, আয়াত নং-৯২)
রাসূলের (ﷺ) থেকে মাফ পাবার পর তারা ইসলাম গ্রহণ করেন।

রাসূল (ﷺ) ও সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম রোজাদার অবস্থায় মদীনা থেকে বের হয়েছিলেন। কিন্তু কাদীদ নামক স্থানে পৌঁছার পর সাহাবায়ে কেরামের কষ্টের দিকে বিবেচনা করে রাসূল (ﷺ) রোজা ভেঙে ফেলেন। তাঁর অনুসরণ করে সাহাবায়ে কেরামও নিজেদের রোজা ভেঙে ফেলেন।

এভাবে লাগাতার ও খুব দ্রুত সফর করে মুসলিম বাহিনী মক্কার উপকণ্ঠে “মাররুয যাহরান” [৮] নামক স্থানে ছাউনি ফেলেন। রাসূলের (ﷺ) সাথে ছিল দশ হাজার সাহাবীর এক বিশাল কাফেলা। তাঁর দোয়ার বরকতে ততক্ষণ পর্যন্ত মুসলিম বাহিনীর এই তৎপরতা সম্পর্কে কুরাইশরা কিছুই জানতে পারেনি। রাসূল (ﷺ) কুরাইশদের ভড়কে দিতে চাচ্ছিলেন। তিনি চাচ্ছিলেন, তারা যেনো যুদ্ধক্ষেত্রে না আসে, বরং মুসলিমদের শক্তিমত্তা দেখেই আত্মসমর্পণের কথা চিন্তা করে। তাই তিনি প্রত্যেক তাবুর সামনেই চুলা জ্বালানোর নির্দেশ দিলেন।

আরবদের প্রাচীন প্রথা ছিল, তারা শত্রুসেনার সংখ্যা জানতে রাতের বেলা তাদের চুলার হিসাব করত। যদি চুলা বেশি হত তাহলে বুঝে নিত সৈন্যসংখ্যাও বেশি। বিচক্ষণ সেনাপতি রাসূল (ﷺ) সেই পদ্ধতিতেই কুরাইশদের মনে ভয় ধরানোর পরিকল্পনা করলেন। রাতের আঁধার ভেদ করে মাররুয যাহরান উপত্যকায় জ্বলে উঠল দশ হাজার অগ্নিচুল্লি। দূর থেকে যে কেউ দেখলেই বুঝবে, এখানে বিশাল সৈন্যসমাবেশ ঘটেছে।

গ্রেফতার হল কুরাইশ-নেতা আবু সুফইয়ানঃ-

আবু সুফইয়ানের সন্ধিচুক্তি নবায়নের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর মক্কার সবাই অজানা এক আশঙ্কায় দিন গুজরান করছিল। কোনো এক অশনিসংকেত তাদেরকে সারাক্ষণ তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। কারণ, কারোরই এটা বুঝতে বাকি ছিল না যে, মুহাম্মাদ নিশ্চয়ই এই চুক্তিভঙ্গের দৃষ্টান্তমূলক প্রতিশোধ নিবে। যে কোনো সময় তাঁর বাহিনী মক্কায় হামলা করতে পারে- এমন ভয় তাদের রাতদিন এক করে রেখেছিল।

এক রাতে আবু সুফইয়ান ইবনে হারব, হাকীম ইবনে হিযাম ও বুদাইল ইবনে ওয়ারকা মক্কার বাহিরে বের হলো। উদ্দেশ্য ছিল, মক্কার আশপাশটা টহল দেওয়া, যেনো মক্কাবাসীর অজ্ঞাতেই মুহাম্মাদ তাদের উপর আক্রমণ না করে বসে। ঘুরতে ঘুরতে তারা যখন মাররুয যাহরান উপত্যকার কাছে আসল তখন দেখল ময়দান-ভর্তি সৈন্য। বেশ ঘাবড়ে গেল তারা।

আবু সুফইয়ান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল এই আগুন কীসের? বুদাইল উত্তর দিল এ আগুন খুযা’আ গোত্রের হবে। আবু সুফইয়ান বলল, না! তারা এত সৈন্য কোথায় পাবে?? এসব আলাপচারিতার মাঝেই তারা মুসলিম বাহিনীর টহলরত সেনাদের চোখে পড়ল এবং গ্রেফতার হল। আবু সুফইয়ান জিজ্ঞেস করল, তোমরা কারা? তারা উত্তর দিলেন, আমরা মুহাম্মাদ (ﷺ) এর সৈনিক। আবু সুফইয়ান বুঝে নিল, কী হতে চাচ্ছে?

কুরাইশ নেতা আবু সুফইয়ানের ইসলাম গ্রহণঃ-

এদিকে হযরত আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু চিন্তা করলেন, হায়, মক্কাবাসী যদি আত্মসমর্পণ করত! মক্কাবাসীকে কোনোভাবে আত্মসমর্পণ করানো যায় কি না। তিনি সে বিষয়ে চেষ্টা শুরু করলেন। সেই মানসে তিনি রাসূলুল্লাহর (ﷺ) সাদা খচ্চরটি নিয়ে মক্কার দিকে রওয়ানা হলেন। ততক্ষণে আবু সুফইয়ান মুসলিম সেনাদের হাতে গ্রেফতার হয়ে গেছে এবং তাদের সাথে তার কথোপকথন হচ্ছে। হযরত আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু আবু সুফইয়ানের পরিচিত কণ্ঠস্বর চিনে ফেললেন। আবু সুফইয়ানকে লক্ষ করে তিনি বললেন, আফসোস,আবু সুফইয়ান! এরা হচ্ছে রাসূলের (ﷺ) বাহিনী। তারা যদি কোনোভাবে মক্কায় প্রবেশ করতে পারে, তাহলে নিশ্চিত তোমার গর্দান উড়িয়ে দিবে।

পূর্ব থেকেই মুসলিমদের ভয়ে ভীত আবু সুফইয়ান নিজের মৃত্যুর কথা শুনে আরও ভয় পেয়ে গেল। ভয়াতুর কণ্ঠে সে জিজ্ঞেস করল, “আবুল ফাজল! (আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর উপনাম) তোমার উপর আমার পিতা মাতা কুরবান হোক, এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?” তিনি বললেন, রাসূলের কাছে আত্মসমর্পণ কর। এটাই তোমার জন্য ও গোটা মক্কাবাসীর জন্য কল্যাণকর হবে৷

এরপর হযরত আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু আবু সুফইয়ানকে খচ্চরের পিঠে বসিয়ে রাসূলের (ﷺ) দরবারে নিয়ে যান। হাকীম ইবনে হিযাম ও বুদাইল ইবনে ওয়ারকাও সাথে ছিল। রাসূল (ﷺ) তাদের দেখে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বললেন, “রাতে তাদেরকে তোমার তাবুতে রাখো, ভোরে আমার কাছে নিয়ে এসো!”

তারা সবাই বের হয়ে গেল তাবু থেকে। কিছুক্ষণ পর হাকিম ইবনে হিযাম ও বুদাইল ইবনে ওয়ারকা রাসূলের (ﷺ) দরবারে উপস্থিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করলেন। রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুমা! রাসূল (ﷺ) কিছুক্ষণ পর্যন্ত তাদের থেকে মক্কার বিভিন্ন খোঁজ-খবর নিয়ে তাদের বিদায় করলেন। তারা বের হয়ে সরাসরি মক্কায় চলে গেলেন।

হযরত আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু নিজ তাবুতে নিয়ে আবু সুফিয়ানকে ইসলামের সত্যতা বুঝাতে শুরু করলেন। রাতে এভাবে বুঝানোর পর ভোরে রাসূলের (ﷺ) দরবারে নিয়ে আসলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “আবু সুফইয়ান! এখনো কি সময় আসেনি যে, তুমি আল্লাহ তা’আলাকে রব হিসাবে আর আমাকে তাঁর প্রেরিত রাসূল হিসাবে মেনে নিবে??” আবু সুফইয়ানের চোখ খুলতে শুরু করেছে। রাতেই হযরত আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু তার চোখ খুলে দিয়েছেন। এখন বাকিটুকুও খুলে গেল। তিনি কালিমা পড়ে ইসলাম গ্রহণ করলেন৷ রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু!

ইসলাম গ্রহণ করার পর হযরত আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূলকে (ﷺ) বললেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আবু সুফইয়ান, মক্কার সর্দার। সে গর্ব করতে পছন্দ করে, আপনি তাকে এমন কোনো সম্মান দিন যা নিয়ে সে গর্ব করতে পারে। রাসূল (ﷺ) বললেন: “যারা আবু সুফইয়ানের ঘরে প্রবেশ করবে তারা নিরাপদ।” আবু সুফইয়ান বললেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার ঘরে তো মক্কার সব মানুষের জায়গা হবে না।’ তিনি (ﷺ) বললেন, “যারা মসজিদে হারামে প্রবেশ করবে তারাও নিরাপদ।” আবু সুফিয়ান আবারও বললেন, ‘সেখানেও তো স্থান সংকুলান হবে না!’ তিনি (ﷺ) বললেন, “যারা নিজ ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে থাকবে তারাও নিরাপদ।” আবু সুফইয়ান বললেন, ‘এবার হয়েছে।’

মাররুয যাহরান থেকে মক্কা অভিমুখে মুসলিম বাহিনীঃ-

রাসূল (ﷺ) আর দেরি করতে চাইলেন না৷ মক্কার দিকে অগ্রসর হতে নির্দেশ দিলেন। আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বললেন, আবু সুফইয়ানকে নিয়ে কোনো টিলার উপর দাঁড়াও, যেনো পুরো মুসলিম বাহিনী সে দেখতে পায়। তিনি তাই করলেন। আবু সুফইয়ান দাঁড়িয়ে আছেন টিলার উপর। তাঁর সামনে দিয়ে এক এক করে মুসলিম বাহিনীগুলো অগ্রসর হচ্ছে আর তিনি বিস্ময়াভিভূত হয়ে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বলছেন, “তোমার ভাতিজার বাদশাহী তো অনেক বিস্তৃত হয়েছে! আল্লাহর ক্বসম! এত বিশাল বাহিনীর মোকাবিলা করার শক্তি-সামর্থ মক্কাবাসীর নাই।”

এরপর তিনি দৌড়ে মক্কায় গেলেন, এবং ঘোষণা করলেন, মুহাম্মাদ তাঁর দলবল নিয়ে মক্কা আসছেন। আমার ধারণা যে, তাঁর সাথে মোকাবিলা করার সামর্থ কারো নাই। তাই আমার পরামর্শ হলো, তোমরা সবাই ইসলাম গ্রহণ করে নাও, তাহলে নিরাপদ থাকবে। অবশ্য যারা আমার ঘরে প্রবেশ করবে তারাও নিরাপদ থাকবে। যারা মসজিদে হারামে আশ্রয় নিবে তারাও নিরাপদ থাকবে এবং যারা নিজ ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে থাকবে তারাও নিরাপদ থাকবে।

তাঁর এই ঘোষণা শোনার পর কালবিলম্ব না করে সবাই যার যার ঘরের দিকে দৌড় দিল। মক্কার পরিবেশ রাসূলের (ﷺ) অনুকূলে। হাজারো স্মৃতিঘেরা মাতৃভূমি হাতছানি দিয়ে ডাকছে মুহাজির সাহাবীদের। মুসলিম বাহিনী সদর্পে এগিয়ে চলেছেন মক্কার পানে। অপেক্ষা করছে বিজয়ের এক মাহেন্দ্রক্ষণ!

চলবে… ইনশা আল্লাহ


 

নোটঃ

[১] প্রকৃতপক্ষে তিনি মক্কার অধিবাসী ছিলেন না। বরং তিনি ছিলেন ইয়েমেনের অধিবাসী। মক্কার বনু আসাদ ইবনে আব্দুল উযযার সাথে চুক্তিভুক্ত ছিলেন। কারো মতে যুবাইর ইবনুল আওয়ামের সাথে চুক্তিবদ্ধ ছিলেন। মুহাজির সাহাবীদের বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয়-স্বজন মক্কায় ছিল, যে কোনো দুর্যোগে যারা তাদের পতিবারের দেখাশোনা করতে পারত। কিন্তু হাতিব ইবনে আবি বালতা’আহ যেহেতু মক্কার অধিবাসী ছিলেন না, তাই তার পরিবারের দেখাশোনার জন্য মক্কায় কেউ ছিল না। এ কারণেই তিনি চেয়েছিলেন মক্কার কুরাইশদের কিছুটা সহানুভূতি অর্জন করতে। এই প্রেক্ষিতেই তিনি উক্ত পত্র প্রেরণ করেন।

[২] এখানে রেওয়াতের ভিন্নতা আছে। কোনো কোনো রেওয়াতে তিনজন না, বরং দু’জনের উল্লেখ আছে। কোনো কোনো রেওয়াতে তিনজনই আছে কিন্তু আলী দিয়াল্লাহু আনহুর সাথে অন্যদের নাম আছে। আমরা এখানে বুখারীর একটি রেওয়াতের উপর নির্ভর করেছি, যার হাদীস নম্বর শেষে উল্লেখ করা হয়েছে।

[৩] রাওজাতুল খাখ। মদীনা থেকে দক্ষিণ ও পশ্চিমে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি জায়গার নাম।

[৪] উক্ত মহিলার নাম ছিল সা-রাহ। এক সময় মক্কার গায়িকা ও নর্তকী ছিল সে। মুসলিমরা যখন মক্কা অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন সে মদীনায় এসে রাসূল (ﷺ) এর সাথে দেখা করে। রাসূল (ﷺ) তাকে জিজ্ঞেস করেন, “ইসলাম গ্রহণ করে মদীনায় এসেছ?” সে উত্তর দেয়, ‘না।’ “তাহলে এমনিই হিজরত করেছ??” সে উত্তর দেয়, ‘না।’ “তাহলে কেনো এসেছ মদীনায়?” সে বলে, ‘আমার আর্থিক সাহায্যের প্রয়োজন, তাই সাহায্যের জন্য এসেছি।’ তিনি (ﷺ) বললেন, “কেনো, মক্কার যুবকদের কী হলো?” সে বলে, ‘বদরের পর তারা আমাকে আর ডাকেনি৷’ এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে অন্ন-বস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেন।

সে যখন মক্কার ফিরতি পথ ধরে, তখন হাতিব ইবনে আবি বালতা’আহ রাদিয়াল্লাহু আনহু তার হাতে একটি পত্র গুঁজে দেন এবং বলে দেন, যেন গোপনে মক্কায় পৌঁছে দেয়। বিনিময়ে তাকে তিনি দশ দিনার প্রদান করেন। তিনি তার হাতে পত্র দেওয়ার পরপরই আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে হযরত জিবরাইল আলাহিস সালাম রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে সব তথ্য দিয়ে যান।

[৫] বুখারীর উদ্ধৃত রেওয়াতের মধ্যে হাতিব ইবনে আবি বালতা’আহর উক্ত পত্রের বিষয়বস্তুর উল্লেখ নেই। সূরা মুমতাহিনাহর প্রথম আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার প্রেক্ষাপট আলোচনা করতে গিয়ে ইমাম কুরতবী (রাঃ) তাঁর বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ “তাফসীরে কুরতুবি”তে এই বিষয়বস্তু উদ্ধৃত করেছেন। এছাড়াও বুখারীর ব্যখ্যাগ্রন্থ ‘ফাতহুল বারী’তেও এরূপ বিষয়বস্তুর উল্লেখ রয়েছে।

[৬] জুহফাহ, মক্কা উত্তর-পশ্চিমে ১৮৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি জায়গার নাম।

[৭] রাসূলের (ﷺ) চাচাতো ভাই ও দুধ ভাই ছিলেন তিনি। হালিমা সা’দিয়্যাহ তাদের উভয়কে দুধ পান করিয়েছেন। কিন্তু রাসূল (ﷺ) ইসলামের দাওয়াত দিতে শুরু করল তিনি অত্যন্ত বিরোধী হয়ে উঠেন। ফাতহে মক্কার আগ পর্যন্ত ইসলামের বিরুদ্ধে কুরাইশদের প্রতিটি যুদ্ধে শরীক ছিলেন। কিন্তু ফাতহে মক্কার পূর্বে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। এরপর ফাতহে মক্কা, হুনাইন ও তায়েফের যুদ্ধে তিনি রাসূলের (ﷺ) সাথে শরীক ছিলেন। তাঁর ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন। ১৫ হিজরিতে তিনি ইন্তিকাল করেন।

[৮] বর্তমানে উক্ত স্থানকে ওয়াদিয়ে ফাতিমাহ নামে নামকরণ করা হয়েছে।


লিখেছেন :   মুফতি আব্দুল্লাহ মুনতাসির


 

তথ্যসূত্রঃ

(১) সহীহ বুখারী।
(২) তাফসীরে কুরতুবী।
(৩) সীরাতে ইবনে হিশাম।
(৪) যাদুল মা’আদ।
(৫) আর রাহীকুল মাখতুম।
(৬) সীরাতে মুস্তফা।
এছাড়াও সীরাত ও ইতিহাসের উপর রচিত গ্রহণযোগ্য অন্যান্য কিতাব।

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধহিন্দুত্ববাদী প্রধানমন্ত্রী কসাই মোদীর আগমনে ‘আরো অবরুদ্ধ’ কাশ্মীর
পরবর্তী নিবন্ধরুশ সেনাবহরে আল-কায়েদার হামলা : হতাহত একডজনেরও বেশি