সাম্প্রতিক একটি ঘটনায় দৃষ্টিপাত
একজন কাশ্মীরি মুসলিম এবং তার মেয়ে, যিনি একজন ইউপিসি চাকরি প্রত্যাশী, তারা দিল্লীতে থাকার জায়গা খুঁজে পেতে খুবই সমস্যায় পড়েছেন। মেয়ে নাদিয়া দিল্লীতে থেকে গত তিন মাস ধরে ইউপিএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি পেয়িং গেস্ট হিসেবে থাকার জায়গা খুঁজছিলেন।
তার বাবা ৬৩ বছর বয়স্ক আব্দুর রশিদ কাশ্মীরের শ্রীনগরের বাসিন্দা। তিনি দিল্লী এসেছেন গত ১ জুন। তিনি বলেন, “আমি শ্রীনগর থেকে এসেছি। আট দিন হয় আমি দিল্লীতে এসেছি। আমার মেয়ে গত ৩ মাস ধরে এখানেই আছে। সে পিজি হোস্টেলে একটা রুম নিয়েছিল, সেটার ভাড়ার মেয়াদ ১০ জুন শেষ হয়। তাই ১০ জুনের পরের জন্য আমরা নতুন কামরা ঠিক করতে বেড়িয়ে পড়ি। তো মেয়ে বলেছিল ১০ জুনের আগেই আমরা যেন নতুন রুমে চলে আসি, যাতে করে ওর পরালেখায় ক্ষতি না হয়। আমরা এখানে ৮-১০ জায়গায় রুম দেখেছি, একটার তো ভাড়াও ঠিক করেছি। কিন্তু যখনি বাড়ির মালিককে ফোন করে ব্রোকার বলে যে, ‘কাস্টমার এসেছে, তারা কাশ্মীরের’, তখন ওখান থেকে জিজ্ঞেস করা হয়, ‘তারা কি মুসলিম?’ যখনি এখান থেকে বলা হয় ‘হ্যাঁ, তারা মুসলিম’, সেখান থেকে তখন জবাব আসে ‘না’।”
তাদের মুসলিম পরিচয়ের জন্যই সকল বাড়ির মালিক তাদেরকে বাড়িভাড়া দিতে অস্বীকৃতি জানায়। জনাব রশিদ বলেন, ‘দা কাশ্মীর ফাইলস’ সিনেমাটিই মূলত এই বৈষম্যের জন্য দায়ী।
তিনি জানান, “আমরা দালালের মাধ্যমে এক বাড়িওয়ালাকে টাকাও দিয়েছি। তো প্রথমে উনি শর্ত দিলেন যে, ‘আমরা আপনাকে রুম ভাড়া দিচ্ছি, তবে রুমের চাবি আপনারা রাখতে পারবেন না। আমরা যেকোনো সময় রাত ১ টা ২ টায় এসে রুম চেক করবো।’ তো আমি বললাম, ‘এটা কিভাবে সম্ভব? আমার মেয়ে বাইরে যাবে, তখন রুম খোলা থাকলে যে কেউ এসে চেক করতে পারে।’ এরপর অনেক কষ্টে আমরা ভাড়ার টাকাটা ফেরত পেয়েছি। তখন ব্রোকার বলল, ’ এটা ভেবে খুশি হন যে আপনি টাকা ফেরত পেয়েছেন।’ এখন আমরা একেবারে বিরক্ত হয়ে গেছি, তাই আগামী পরশু কাশ্মীরে ফেরত যাচ্ছি।”
“আমরা ব্রোকারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, ‘সমস্যাটা কি, আমাদের ভুল কোথায়? যদি কোন ভুল থাকে তাহলে আমরা সুধরে নিব।’ সে বলল যে, ‘না, তেমন কিছু না। তবে একটা সিনেমা এসেছে ২-১ মাস আগে কাশ্মীর ফাইলস নামে।’ আমি বললাম যে, ‘আমি দেখি নি সেটা।’ বলে যে, ‘আপনি দেখে নেন।’ তো সে বলল, ‘কাশ্মীর ফাইলস নামের যে সিনেমাটা হয়েছে, সেটার কারণে বিশেষ করে কাশ্মীরি মুসলিমদের প্রতি এখানকার মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি একেবারেই বদলে গেছে। তারা তাদেরকে নিজের ঘরে রাখতে একদমই প্রস্তুত না’।”
মেয়ে নাদিয়া জানান, “যখন আমি এখানে রুম খুঁজতে গেলাম, প্রথমে আমাকে না বলা হল, ৩ জায়গা থেকে। বলা হল যে, ‘তুমি কাশ্মীর থেকে আগত মুসলিম’। এবং এমনটা হল কাশ্মীর ফাইলস সিনেমার জন্যই। আমাদের পরিচয় আমরা দিতাম ‘কাশ্মীর থেকে আসা মুসলিম’ আমরা। তো এজন্য আমাদেরকে অনেক নিচু দৃষ্টিতে দেখা হতো এখানে।”
সিনেমাটি প্রসঙ্গে কিছু কথা ও প্রকৃত ইতিহাস
সিনেমাটি এবছর ১১ মার্চ মুক্তি পায়, সেটা ১৯৯০ সালের কাশ্মীরি পণ্ডিতদের দেশত্যাগের উপর ভিত্তি করে বানানো হয়। সিনেমাটির পরিচালক ভিবেক অগ্নিহোত্রী, অভিনয় করেছে বিজেপিতে যোগ দেওয়া মিঠুন চক্রবর্তী , অনুপম খের প্রমুখ।
বিজেপি’র সদস্যরা এই সিনেমার ব্যাপক প্রচার করেছে, এমনকি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও।
অবশ্য তৎকালীন ঘটনাগুলোর একপেশে ভুল দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপনের দায়ে সিনেমাটিকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। যদিও সিনেমার পরিচালক ভিবেক অগ্নিহত্রি দাবি করেছিল যে, এটি নাকি সম্পূর্ণ বাস্তব কাহিনী ভিত্তিক সিনেমা; কিন্তু আদতে সিনেমাটি ভরপুর মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্যনির্ভর দৃশ্যে।
১৯৮৭ সালে মুসলিম ইউনাইটেড ফ্রন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে যখন বিপুল ভোটে জয়ের কাছাকাছি চলে যায়, এমন অবস্থায় হিন্দুত্ববাদী ভারতের তরফ থেকে প্রকাশ্য জালিয়াতির মাধ্যমে এমইউফকে পরাজিত ঘোষণা করা হয়। এরপর মুসলিমদের মধ্যে বিশেষ ভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ক্রোধ সঞ্চারিত হলে, কাশ্মীরি মুসলিমদের শায়েস্তা করার জন্য হিন্দুত্ববাদী ভারত সরকার গভর্নর জগমোহনকে যা ইচ্ছা তা করার লাইসেন্স দিয়ে দেয়। এরপরে জগমোহন কাশ্মীরি মুসলিমদের উপর হিন্দুত্ববাদী বাহিনী লেলিয়ে দেয়। পুলিশি হেফাযততে মৃত্যু, খুন ধর্ষণ নিত্তনৈমত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়ায় তখন কাশ্মীরে। মুসলিমরা প্রতিবাদ জানালে আরও বর্বর হয়ে উঠে জগমোহন। এমনকি মসজিদের মধ্যে আশ্রয় নেওয়া কাশ্মীরি মুসলিম নারীদেরও ধর্ষণ করে হিন্দুত্ববাদী বাহিনী। আরও ঘটতে থাকে কুনান পোষ্পরা গণধর্ষণ ও গণহত্যা, পাজিপোরা গণহত্যা আর জাকুরা ও টেংপোরা গণহত্যার মতো বর্বরোচিত সব ঘটনা। অথচ এসবের কোন উল্লেখই নেই কাশ্মীর ফাইলসে।
যাই হোক, পরবর্তীতে হিন্দুত্ববাদী দখলদার ভারত চাইল কাশ্মীর উপত্যকাকেই মুসলিম শুন্য করে ফেলতে। এর প্রেক্ষিতে তারা কাশ্মীর থেকে পন্ডিতদের বেরিয়ে যেতে আদেশ দেয়, এমনকি তাদের বাসের টিকেট পর্যন্ত ধরিয়ে দেয়া হত। তাদেরকে অন্যত্র বাড়ি-গাড়ি ও নগদ অর্থ প্রদানের লোভও দেখানো হয়, যা পরবর্তীতে চিঠিতে স্বীকার করেছে ২৩ জন পণ্ডিত নেতা। ঐ ২৩ জন নেতৃত্বস্থানীয় হিন্দু পন্ডিত কাশ্মীরি মুসলিমদের কাছে চিঠি লিখে জানায়, জগমোহন ভারত সরকারের সাথে যোগসাজেশে তাদের বলির পাঠা বানিয়েছে। তাদের কাশ্মীর ত্যাগ একটা নাটক ছিল।
আর এই ঘটনাকেই পরিচালক দাবি করেছে যে, সমুসলিমরা ৫ লাখ কাশ্মীরি পণ্ডিতকে বাস্তুচুত করেছে। অথচ হিন্দু গবেষকদের বর্ণনাতেই ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত কাশ্মীরে বসবাসরত পণ্ডিতদের সংখ্যা পাওয়া যায় ১ লাখ ৪০ হাজারের কিছু কম। আর কোন কোন বিশেষজ্ঞ এই সংখ্যা বলেছেন ১ লাখ ৬০ হাজার থেকে থেকে ১ লাখ ৭০ হাজার।
আবার সিনেমায় বলা হয়েছে যে, মুসলিমরা সেখানে হিন্দু পণ্ডিতদের উপর গণহত্যা চালিয়েছে; প্রায় ৪ হাজার হিন্দুকে নাকি সেসময় হত্যা করে মুসলিমরা!
অথচ, গবেষক সুমন্ত্র বোস একাধিকবার কাশ্মীরে গিয়ে সারেজমিনে পরিদর্শন করে বলেছে যে – হাজার হাজার নয়, কয়েক ডজন কাশ্মীরি পন্ডিত নিহত হয়েছে তখন। আর কাশ্মীর পন্ডিত সংস্কৃতি সমিতি, যা কাশ্মীর কেন্দ্রিক হিন্দুদের একটি সংস্থা, তাদের পরিচালিত জরিপ অনুসারেও ২০ বছরে নিহত পন্ডিতদের সংখ্যা ৬৫০ এর বেশী নয়। খোদ হিন্দুত্ববাদী কাশ্মীর পুলিশেরই তথ্যমতে, ১৯৯০ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত স্বশস্ত্র গোষ্ঠীর হাতে ১৭২৪ জন নিহত হয়েছে, এদের মধ্যে মাত্র ৮৯ জন হলেন কাশ্মীরি পন্ডিত।
সিনেমাটিতে আরও দেখানো হয়েছে যে, কাশ্মীরি মুসলিমরা নাকি হিন্দুদের সম্পত্তি দখলের লোভে তাদেরকে তাড়িয়ে দিত, হত্যা করত। কিন্তু বাস্তবতা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। ১৯৯০ এর আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ ভারত সরকারের কাশ্মীর বিষয়ক মন্ত্রী জর্জ ফারনান্ডেজ কাশ্মীর সফরে যায়। সে তখন বলেছে, বিগত এক বছরে পন্ডিতদের মালিকাধীন সম্পত্তি, বাড়ি, বাগান, কোনো কিছুই ক্ষতিগ্রস্থ হয় নি। পন্ডিতদের পরিত্যাক্ত বাড়িগুলি আগের মতোই স্থানীয় মুসলমানেরা দেখাশোনা করছে।
হিন্দুদের উপরে ‘দা কাশ্মীর ফাইলস’এর প্রভাব
ভারতজুড়ে অনেক হলে সিনেমাটি দেখার পরে উপস্থিত দর্শকদেরকে জিঘাংসামূলক বক্তব্য দিতেও দেখা গেছে। আর সিনেমার বিভিন্ন দৃশ্যের পর তো ‘জয় শ্রী রাম’ শ্লোগান চলেছে নিয়মিত।
একজায়গায় একজন হিন্দুত্ববাদী নেতাকে সিমেনাতি দেখার পর দরশকদের উদ্দেশ্য করে বলতে শোনা যায়, “যদি আজকে আমরা না জাগি, তাহলে আমাদের সামনে যে প্রজন্ম আস্তে যাচ্ছে, তাহলে মধ্য প্রদেশ কি, বারওয়ানি জেলাতেও কাশ্মীরের পণ্ডিতদ্দের পরিস্থিতি হতে যাচ্ছে।”
এখানে উল্লেখ্য, সিনেমায় পরিচালক উগ্র হিন্দুত্ববাদী উন্মাদনা উস্কে দেয়ার নিমিত্তে পাশবিক এক চিত্র দৃশ্যায়ন করেছে। দৃশ্যটিতে দেখানো হয়, একদল সশস্ত্র ব্যক্তি সামরিক বাহিনীর পোশাক পরে নাদিমারগ গ্রামে প্রকাশ্য দিবালোকে তান্ডব চালায়। গণকবরের সামনে কাশ্মীরি পন্ডিতদের গুলি করে হত্যা করে। হত্যাকান্ডের পুরো দৃশ্য পন্ডিতদের মুসলিম প্রতিবেশীরা পর্যবেক্ষণ করে। এরপর দেখানো হয়, মুসলিম একজন আলেমের নির্দেশে শারাদাহ পন্ডিত নামের এক নারীর স্বামীকে হত্যা করা হয়। এরপর শারদাহকে বাধ্য করা হয় তার মৃত স্বামীর রক্তের উপর ভাত খেতে। কামুক, লম্পট হিসেব চিত্রায়িত করা ঐ আলেমের নির্দেশে শারদাহর বস্ত্র হরণ করে তাকে মেকানিল স এর মাধ্যমে জীবন্ত কেটে টুকরো টুকরো করে মুসলিমরা।
অথচ, কোনো স্থানীয় ব্যক্তি বা সরকারি উৎস থেকে এমন ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায় না। নাদিমারগের স্থানীয় অধিবাসীদের মতে, এই গণহত্যা সংঘটিত হয় রাতের আঁধারে। অধিকাংশ গ্রামবাসীই তখন নিজ নিজ বাড়িতে অবস্থান করছিল। স্থানীয়রা আরও জানায়, আক্রমণকারীদের রাইফেলে সাইলেন্সার লাগানো ছিল। হিন্দু পন্ডিতদের একটা ঝরনার পাশে দাঁড় করিয়ে গুলি করা হয়। স্থানীয়রা হতাহত পন্ডিতদের কান্না ও চিৎকার শুনেই কিছু একটা ঘটেছে বুঝতে পারে। নাদিমারগের মুসলিমরা তাদের প্রতিবেশী হিন্দুদের জন্য এখনো শোকার্ত। তাছাড়া নাদিমারগে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে ২০০৩ সালে, কিন্তু পরিচালক এই ঘটনাকে ১৯৮৯-৯০ সময়ের সাথে জুড়ে দিয়েছে।
কিন্তু পরিচালকের এই পাশবিক দৃশ্যায়ন লক্ষ্য পূরনে সফল হয়েছে। আপনারা হয়ত ইতিমধ্যেই লক্ষ্য করেছেন, হিন্দুত্ববাদীরা কাশ্মীর ফাইলস দেখার পর মুসলিম গণহত্যার হুমকি দেবার সময় বারবার এই ঘটনার প্রসঙ্গ এনেছে। এমনকি খারাগাও এ মুসলিমদের উপর হিন্দুদের আক্রমণের ক্ষেত্রেও এই ঘটনা রসদ যুগিয়েছে। কাশ্মীর ফাইলস সিনেমার এই দৃশ্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে শিবসেনা খারগাঁও মসজিদের বাইরে উসকানিমূলক মিছিলের আয়োজন করে। লাউড স্পিকারে উসকানিমূলক স্লোগান দিতে দিতে মুসলিমদের উপর হামলা চালায়। হিন্দুত্ববাদী মিডিয়া হিন্দুদের হামলাকে ‘দাঙ্গা’ হিসেবে প্রচার করে। পুলিশ ও প্রশাসনের প্রত্যক্ষ্য সহায়তায় হামলার সময় ও পরে মুসলিমদের বাড়িঘর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আগুন দেয় হিন্দুত্ববাদীরা, চলে লুটপাট, বেছে বেছে বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয় মুসলিমদের সম্পত্তি।
রামনবমী উদযাপনের নামে রমাদানে তারাবীহ চলার সময়ও মসজিদের সামনে উসকানিমূলক শোডাউন করেছে হিন্দুত্ববাদীরা। পুলিশি প্রটোকেশনে গনহত্যার আহ্বান জানানোর গানের তালে তালে অস্ত্র নিয়ে নাচানাচি করেছে, মসজিদের উপর গেরুয়া পতাকা টানিয়ে দিয়েছে তারা। এখন আবার মসজিদ ও মুসলিদের বানানো ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোতে শিবলিঙ্গ পাওয়ার কাল্পনিক অযুহাতে সেগুলো ধ্বংস করে দিয়ে মন্দির বানাতে চাচ্ছে। এমনকি মসজিদের বাহিরের জমায়েত থেকে মুসলিম নারীদের অপহরণ করে ধর্ষণের হুমকিও দিয়েছে হিন্দুরা।
আবারো যাওয়া যাক জনাব আব্দুর রশিদের বক্তব্যে। তিনি বলেন, “আমাদের সাথে অনেক বৈষম্য হচ্ছে। আমরা তো এতোটা খারাপ না, যেমনটা দেখানো হচ্ছে, আর যেমনটা এখানে এসে মনে হচ্ছে। আমি এটা একেবারেই আশা করিনি যে এখানে এমন পরিস্থিতি হবে। ……আমার তো মনে হচ্ছিল যে আমি কোন ভুল জায়গায় এসে গেছি। এটা সেই দিল্লী নয়, যেখানে আমি আসতাম, যেখানে রাত ১২ টায় ১ টায় আমি ঘুরা-ফেরা করতাম। সবচেয়ে বড় সমস্যা হল যে, বাচ্চাদের মধ্যে এমন ভুল ধারণা জন্মাচ্ছে।”
“আমরা ইতিমধ্যে কাশ্মীরেই এক সমস্যায় ফেঁসে আছি। তার উপরে আবার এসব!”
শুধু কাশ্মীর বা কাশ্মীরি নয়, সারা ভারতের মুসলিমদেরকে এক জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে ফেলে দেওয়ার শেষ ধাক্কাটা দিয়েছে এই ‘দা কাশ্মীর ফাইলস’ সিনেমাটি। গণহত্যা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ গ্রেগরি স্টেন্টন কয়েকমাস আগেই সতর্ক করেছিলেন যে, ভারতে মুসলিম গণহত্যা অতি আসন্ন। আবার অন্য বিশেষজ্ঞরা এই গণহত্যা ক্ষুদ্র পরিসরে শুরু হয়ে যাওয়ার কথাও স্বীকার করেছিলেন।
হিন্দুত্ববাদী ন্যারেটিভের প্রোপাগান্ডা সিনেমা ‘দা কাশ্মীর ফাইলস’
মূলত বিজেপি ও অন্যান্য হিন্দুত্ববাদী নেতাদের বিভিন্ন মুসলিমবিদ্বেষী ইস্যু তৈরি, সাধু-সন্ন্যাসীদের একের পর এক ইসলাম ও মুসলিমবিদ্বেষী উগ্র বক্তব্য প্রদান, বলিউডের সিনেমাগুলর গেরুয়া রং ধারন ও ইসলামবিদ্বেষ প্রচার, গণহত্যার প্রকাশ্য আহ্বান ও অস্ত্র কিনার ডাক – এসব ঘটনাপ্রবাহের মাধ্যমে ধীরে ধীরে সকল স্তরের হিন্দুদের মনোজগৎকে মুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষ ও জিঘাংসার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে প্রস্তুত করা হয়েছে। আর সেই মুসলিম হননের আকাঙ্খাকে বাস্তবে রূপ দিতে মনোজগতে যে শেষ ধাক্কাটি দেওয়ার প্রয়োজন ছিল, সেটি করেছে এই ‘ দা কাশ্মীর ফাইলস’ সিনেমাটি।
এই সত্য এখন প্রমাণিত যে, কাশ্মীর ফাইলস সুনির্দিষ্ট ভাবে বিজেপির একটি প্রোপাগান্ডা সিনেমা। এই সিনেমা সরাসরি বিজেপির ন্যারেটিভ বহন করেছে। ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি এবং আর এস এস বিশ্বজুড়ে এমন জাতিসঙ্ঘের কাছে পর্যন্ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে দায়ী। কিন্তু তারা জানে যে, বিশ্ব জুড়ে তাদের একটি প্রতিষ্ঠানের গ্রহণযগ্যতা আছে, আর সেটি হচ্ছে বলিউড। এজন্য তারা বলিউডের প্রতারনার মাধ্যমে কাশ্মিরে তাদের সকল অন্যায়কে গ্রহনযগ্যতা দেয়ার চেষ্টা করছে। শুধু তাই নয়, ‘কাশ্মীর নাকি শুধুই হিন্দুদের’ – বিশ্বজুড়ে তারা কাশ্মীরের ব্যাপারে তাদের এই হিন্দু-ন্যারেটিভ গ্রহণযোগ্য করতে চাচ্ছে। এজন্য নিউইয়র্ক এর বিশ্ববিখ্যাত টাইম স্কয়ারের থ্রিডি পর্দায় পর্যন্ত কাশ্মীর ফাইলস এর প্রচারনা চলেছে। কাশ্মীর কেন্দ্রিক হিন্দু- ন্যারেটিভের বিষয়টি সবচেয়ে ভাল বুঝা সম্ভব হবে যদি আমরা ইজরায়েলের দিকে তাকাই। ইজরায়েল যেভাবে ফিলিস্তিন দখল নিচ্ছে এবং মুসলিম উচ্ছেদ করে বিশ্ব জুরে তাদের প্রমিজড ল্যান্ড ন্যারেটিভ দাড়া করাতে চাইছে হুবহু সেই একই কাজ কাশ্মিরে করে চলেছে বিজেপি।
পৃথিবীতে ইজরায়েলের সাথে সবচেয়ে বড় সাদৃশ্যপুর্ন দেশটি হচ্ছে ভারত। ভারত হচ্ছে এ উপমহাদেশের ইজরায়েল। তাদের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য ভারতের সকল মুসলিমকে অবাঞ্চিত প্রমান করে রাম রাজত্ব কায়েমের দিকে এগিয়ে যাওয়া। আর এই কাশ্মীর ফাইলস সিনেমাটি সেই লক্ষ্য অর্জনের পথকে মসৃণতর করে যাচ্ছে। ভারত ও বিশ্বের অন্যান্য দেশে এই প্রোপাগান্ডা সিনেমার প্রচারে বিজেপী ও অন্যান্য হিন্দুত্ববাদী নেতাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ, এমনকি সিনেমাটি দেখতে খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আহ্বান এই সত্যকে অনেকটাই পরিষ্কার করে দিয়েছে।
শেষ কথা
কাশ্মীর ফাইলস স্পষ্টভাবে মুসলিম গণহত্যার ডাক দিয়েছে এমন মত প্রকাশ করেছে বিশেষজ্ঞ মহল। এমনকি কয়েকজন সেকুল্যার হিন্দু বিশেষজ্ঞসহ ভারতের কুখ্যাত গুপ্তচর সংস্থা র’এর প্রাক্তন প্রধান এ এস দাউলত পর্যন্ত এমন কথা বলেছে। গনহত্যার উসকানি, তীব্র মাত্রার মুসলিম বিদ্বেষ ছড়ানোর কারণে সিংগাপুর কাশ্মীর ফাইলস সিনেমা নিষিদ্ধ করেছে । অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি ভিভেক অগ্নিহোত্রীকে আমন্ত্রণ জানিয়েও প্রত্যাখ্যান করেছে। কয়েকটি আরব দেশেও এই সিনেমা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে প্রতিক্রিয়া নেই শুধু বাংলাদেশের ভারতীয় দালাল সরকারের। ভারতপ্রেমে অন্ধ হয়ে যাওয়া এই দালাল শাসকশ্রেণী তো এমনকি নবী অবমাননার ঘটনারও নিন্দা জানায়নি। উল্টো আরো আন্দোলনরত বাংলাদেশের মুসলিমদের পরোক্ষ হুমকি দিয়ে বলেছে যে, কারো উস্কানিতে রাস্তায় নামলে পরিণাম ভালো হবে না।
ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিমরা এখন একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তকারী সময়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। হিন্দুত্ববাদীরা তাদেরকে হয় মৃত্যু না হয় ইসলাম ত্যাগ – এই দু’টির একটি বেছে নেওয়ার মতো অবস্থায় নামিয়ে এনেছে। তাদের জন্য খুবই সঙ্কুচিত হয়ে গেছে উপমহাদেশের ভূমি। আর তৃতীয় মুক্তির পথটি হচ্ছে নিজেদের জান-মাল-ইজ্জত-আব্রুর রক্ষার্থে নববী মানহাজ অনুযায়ী প্রস্তুতি নিয়ে থাকা; যার আহ্বান অনেক আগে থেকেই জানিয়ে আসছেন হক্কপন্থী উলামায়ে কেরাম। আর এখনো যারা কথিত ‘অসাম্প্রদায়িকতার’ মুখোশ পরে থাকা হিন্দুত্ববাদীদের ছেলে ভুলান ফাঁপা বুলিতে আটকে আছেন, তাদের চোখ খুলে দেওয়ার জন্য সর্বজন শ্রদ্ধেয় দারুল উলুম দেওবন্দের মুহতামিম মুফতি আবুল কাশেম নোমানী সাহেবের গত মাসে দেওয়া বক্তব্যটি রয়েছে, যেখানে তিনিও এমন আহ্বানই জানিয়েছেন।
লেখক : আব্দুল্লাহ বিন নজর