বাংলাদেশ ছাত্রলীগ এখন এক আতংকের নাম। পাড়া-মহল্লা থেকে শুরু করে দেশের প্রত্যেকটি অঙ্গনে সন্ত্রাসী কার্যক্রম করে যাচ্ছে দলটি। তাদের ভয়ে সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত আতংকে দিনাতিপাত করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে ছাত্রলীগ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র-ছাত্রীদের র্যাগিং এর নামে চরম নির্যাতনের ঘটনা সবারই জানা। আস্তে কথা বলার জন্য শাস্তির মুখোমুখি হওয়া থেকে শুরু করে সালাম না দেয়ার জন্য ৫০-৬০ টি চড়-থাপ্পড় দেয়ার ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাভাবিক ব্যাপার। তাদের ও সরকারের নীতি বা হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কথা বললে যে কাউকেই বরণ করতে হচ্ছে আবরার ফাহাদের মতো পরিণতি।
২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের নৃশংস অত্যাচারে বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ শহীদ হন৷ এরপর বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীর আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ১১ অক্টোবর প্রতিষ্ঠানটিতে সব রাজনৈতিক সংগঠন ও কার্যক্রম কর্তৃপক্ষের নির্দেশক্রমে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়৷
বুয়েটে সকল ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়া সত্বেও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কার্যক্রম থেমে নেই এখানে। কয়েকদিন পর পরই গায়ের জোরে বিভিন্ন কার্যক্রম করতে দেখা যাচ্ছে তাদেরকে। গত ২ জুলাই ও ৮ জুন দুটি সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করে দলটি। গত ১৩ আগস্ট আবারও বুয়েট অডিটোরিয়াম কমপ্লেক্সে ছাত্রলীগের সাবেক নেতৃবৃন্দের আয়োজনে একটি অনুষ্ঠান করতে দেখা যায়।
বুয়েটের একাধিক শিক্ষার্থী জানান, বুয়েটের শিক্ষার্থীরা বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের ব্যানারে আয়োজিত কর্মসূচিটির কথা জানতে পারেন শনিবার ১৩ আগস্ট সন্ধ্যা ছয়টার দিকে। পরে তারা বুয়েট মিলনায়তনের সামনে জড়ো হতে থাকেন৷ বাইরে শিক্ষার্থীরা অবস্থান করলেও বুয়েট ক্যাফেটেরিয়ার সেমিনার কক্ষে তখনও সন্ত্রাসীলীগের অনুষ্ঠান চলছিল৷ অনুষ্ঠান শেষে রাত সোয়া আটটার দিকে বেরিয়ে আসার পর বাইরে অপেক্ষমাণ শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করর বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাবেক নেতারা৷
এরপর ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়া সত্বেও ছাত্রলীগের কার্যক্রমের অনুমতি দেয়ার বিষয়ে জানতে বুয়েট কর্তৃপক্ষের কাছে বিবৃতি দেন ছাত্ররা।
এদিকে এ ঘটনায় গতকাল ১৪ আগস্ট বুয়েটের ছাত্রদেরকে জঙ্গি-সন্ত্রাসী ও পাকিস্তানের প্রেতাত্মা হিসেবে আখ্যা দিয়েছে সন্ত্রাসী ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়। বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হলেও তাদেরকে রাজনীতি করতে দেয়ার জন্য বুয়েট কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানায় সে। এবং যে সকল ছাত্র সন্ত্রাসীলিগের কার্যক্রমে বাধা দিয়েছে তাদের তালিকা তৈরি করে দেখে নেয়ার হুমকি দেয় সে।
এ সময় বুয়েটের প্রশাসনের উদ্দেশে জয় বলেছে, ‘ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করে আপনারা কি বুঝাতে চান? আপনারা কি বুয়েটকে জঙ্গিমুক্ত করতে পারবেন? পারবেন না। আপনাদের জন্য অশনি সংকেত এই জঙ্গি চক্র আপনাদেরকেই প্রথমে হত্যা করবে। বুয়েট প্রশাসনকে আবারো বিবেচনা করতে বলব, ছাত্র রাজনীতি আবারো সচল করে বুয়েটকে জঙ্গিমুক্ত করার জন্য আপনারা পদক্ষেপ নেবেন।’
সে আরও বলেছে, ‘ওই বুয়েট ক্যাম্পাসে পাকিস্তানের প্রেতাত্মা যারা মাথাচারা দিচ্ছে, তাদের চিহ্নিত করা হবে। তাদের পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড খতিয়ে দেখা হবে। প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থার কাছে অনুরোধ করব যারা যারা বঙ্গবন্ধুর শোকের প্রোগ্রাম বানচাল করার প্রচেষ্টা হাতে নিয়েছে তাদেরকে আপনারা খুঁজে বের করুন, তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করা উচিত। তারা রাষ্ট্রদ্রোহ এবং সংবিধান লঙ্ঘনের মতো একটা কাজ করেছে।’
বুয়েটের বিক্ষোভকারীদের জামায়াত-শিবির আখ্যা দিয়ে জয় বলেছে, দেশের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক নেতৃবৃন্দরা কাজ করেছে। কিন্তু জামায়াত-শিবিরের প্রেতাত্মারা নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাইদের সাথে কী বেয়াদবিটা করল দেখেছেন! এ ধরণের বেয়াদবদের থেকে ভালো কিছু বয়ে আসবে কখনো তা আমি মনে করি না। জাতির পিতা এই বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছেন, তাকে নিয়ে যারা ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটাবে তাদের অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে।
অন্যদিকে বুয়েটে ছাত্রলীগের কমিটি দেয়ার দাবিতে মধুর ক্যানটিনে অবস্থান নিয়েছেন ছাত্রলীগের দু’জন নেতা। তাদের একজন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির উপ ছাত্রবৃত্তি বিষয়ক সম্পাদক মো. আমির হামজা। তারা গত ১৩ আগস্ট দুপুরে মধুর ক্যানটিন থেকে বুয়েট শহীদ মিনার পর্যন্ত এ দাবিতে লংমার্চ করার ঘোষণা দেন।
অর্থাৎ তারা যেকোন পন্থায় বুয়েটে নিজেদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এ উদ্যেশ্যে তারা বিভিন্নভাবে বুয়েটে আসার চেষ্টা চালাচ্ছে বলে মনে করছেন বুয়েটের ছাত্ররা৷
ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের কাছে এখন পুরো দেশই জিম্মি হয়ে পড়েছে। তাদের সন্ত্রাসের বলি হয়ে শত শত মায়ের বুক খালি হয়েছেন। ধর্ষণের শিকার হয়ে সম্ভ্রম হারিয়েছেন অসংখ্য মা-বোন। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, চুরি-ডাকাতির মতো সকল অপরাধের সাথে জড়িত এই ছাত্রলীগ। তারা এখন দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নৈরাজ্য চালিয়ে ধ্বংস করতে চাচ্ছে জাতির মেধাবী ছাত্রদের জীবন। তাদের অত্যাচার আর কতদিন সইতে হবে এ দেশের মানুষকে? এই প্রশ্নটিই এখন সাধারণ মানুষের।
তবে ইসলামি চিন্তাবিদরা বলছেন, ছাত্রলীগের এই ত্রাসের রাজত্বের জন্য দায়ি এই জুলুমের সিস্টেম। কথিত গণতান্ত্রিক এলিটরা তাদের পশ্চিমা প্রভুদের সন্তুষ্ট করতে পশ্চিমা জুলুমের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আমাদের উপরে চাপিয়ে দিয়েছে, আর আমরা তা মেনেও নিয়েছি। তারা তাদের জুলুমের সিস্টেমকে কায়েম রাখতে আমাদের উপর মানবরচিত সংবিধান চাপিয়ে দিয়েছে, আমরাও আল্লাহ প্রদত্ত ইসলামকে ছুঁড়ে ফেলে সেই সংবিধানের আনুগত্য করতে শুরু করেছি। আর সেই জুলুমের সিস্টেম আজ আমাদের মুসলিম পরিচয়ে বেঁচে থাকাই কঠিন করে তুলেছে।
তারা তাদের আদর্শ আমাদের উপরে চাপিয়ে দিয়েছে, আর আমরাও ইসলামবিরোধী এই আদর্শ বা চেতনার কোন প্রতিবাদ করিনি। আমরা ভেবেছি, আমরা ইসলাম ও তাদের চেতনা একই সাথে ধারণ করে নির্বিঘ্নে জীবন কাটাবো। কিন্তু আজ যখন দাড়ি-টুপি বা সুদ্ধভাবে সালাম দেওয়া, কিংবা নোংরা পশ্চিমা সামাজিকতা বয়কট করা, অথবা ইসলাম পালনের দিকে মনোনিবেশ করাকেই তারা তাদের জন্য হুমকি মনে করছে, তখন আমরা কিছুটা টের পাচ্ছি যে।
আর যা-ই বা যাকেই তাঁরা নিজেদের জন্য হুমকি মনে করবে, তাকেই তারা মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক অপসক্তি, পাকিস্তানের প্রেতাত্মা, জঙ্গি-সন্ত্রাসী ট্যাগ দিবে; ও তাকে নির্মূল করতে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়গ করবে। আবরারকেও তারা শিবির ট্যাগ দিয়েছিল, এখন বুয়েটের সব ছাত্রকে পাকিস্তানের প্রেতাত্মা বলছে। আলেমদেরকে তারা নিজেদের জন্য হুমকি মনে করে জেলে বন্দী করে রেখেছে। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের ছাত্রদেরকেও তারা গুম-হত্যা করেছিল।
এই সিস্টেম, এই জুলুম আমাদের উপর চেপে বসার দায় যেহেতু কিছুটা হলেও আমাদের, তাই একে জুলুমকে নিঃশেষ করার উপায়ও তালাশ করতে হবে আমাদেরকেই। আমাদের হয়ে এই কাজ চীন-অ্যামেরিকা বা কথিত জাতিসঙ্ঘ এসে করে দিবে না। আমাদেরকে তাই এই সিস্টেম থেকে বের হয়ে ফিরে আসতে হবে নববী চেতনায়, ইসলামি আদর্শে – এমনটাই মনে করেন ইসলামি বিশ্লেষকগণ।
প্রতিবেদক : ইউসুফ আল-হাসান
তথ্যসূত্র
১। বুয়েটে শোক দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠান শেষে তোপের মুখে ছাত্রলীগের সাবেক নেতারা-
https://tinyurl.com/56ppj7y4
২। বুয়েটে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে পাকিস্তানের প্রেতাত্মারা: জয়-
https://tinyurl.com/mrx8vd7u