সোমালিয়ায় উদয়ের পথে নিকটবর্তী বিজয়ের নতুন সূর্যোদয় ||চতুর্থ কিস্তি|| ইসলামি ইমারত প্রতিষ্ঠা এবং মুজাহিদদের ঐক্যের সুফল

    0
    1630
    সুবিধামত ফন্ট ছোট বড় করুনঃ

    ৯০ দশকে ৬টি দল নিয়ে গঠিত হয় ইউনিয়ন অব ইসলামিক কোর্টস (আইসিইউ)। এই দলটিও ৮০’র দশকে প্রতিষ্ঠিত ‘আল-ইত্তিহাদুল ইসলামিয়া’ এর মতোই আল-কায়েদার সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখে। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দলটি সোমালিয়া জুড়ে ব্যপক জিহাদি কার্যক্রম শুরু করে। পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্থানে শরিয়াহ্ আদালত গড়ে তোলার প্রতি বেশি গুরুত্ব দেয়। ৯০’এর দশকে যখন ‘ইত্তিহাদুল ইসলামিয়া’র মাঝে রাজনৈতিক মতপার্থক্য দেখা দেয়, তখন “ওয়াহদাতুশ শাবাব” জোট থেকে সরে পড়ে এবং নতুন দল “আইসিইউ” তে যুক্ত হয়।

    TL-2008-Al-Shabab-Terrorists-jpg

    ইত্তিহাদুল ইসলামিয়া ও ইসলামিক কোর্টস ইউনিয়নের কার্যক্রম:

    দলগুলো যখন মতপার্থক্যে জড়িয়ে পৃথক হয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে, সেই মহূর্তেও আল-কায়েদা হাল না ছেড়ে উভয় দলের সাথে সম্পর্ক ধরে রাখে, এবং তাদেরকে একে অপরের বিরুদ্ধে যাওয়া থেকে বিরত রাখে। উভয় দলের প্রতিরোধ যোদ্ধারই তখন স্বাধীনভাবে নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করতে থাকেন এবং আল-কায়েদাও উভয় বাহিনীকে সর্বোচ্চ সহায়তা দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।

    তবে এই সময়টাতে ওয়াহদাতুশ শাবাবের উপস্থিতি ইসলামিক কোর্টসকে অনেক শক্তিশালী করে তুলে। কেননা ওয়াহদাতুশ শাবাবের সদস্যরা ছিলো শিক্ষিত ও নেতৃস্থানীয়। এই দলটি “আইসিইউ”তে যুক্ত হওয়ার সাথে সাথে ইত্তিহাদুল ইসলামিয়ার অনেক সদস্য বিশেষ করে শরিয়াহ্ ভিত্তিক আদালতগুলো ইসলামিক কোর্টে যুক্ত হয়। যেহেতু সাধারণ জনগণ পূর্ব থেকেই এই আদালতগুলোর সাথে পরিচিত এবং মানুষের কাছে এর সদস্যরা বিশ্বস্ত হিসাবে পরিচিত ছিলো, তাই নতুন এই জোট খুব সহজেই সাধারণ মানুষ পর্যন্ত পৌঁছতে সক্ষম হয়।

    অপরদিকে ইত্তিহাদুল ইসলামিয়া তখন ৩টি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। যার বড় একটি অংশ “আইসিইউ” তে যুক্ত হয়, এবং অন্য একটি অংশ (সেক্যূলার) সামরিক কার্যক্রম থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয়। বাকি ক্ষুদ্র একটি অংশ আঞ্চলিক কার্যক্রমের পাশাপাশি আল-কায়েদার সাথে সম্পর্ক রেখে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক মানের অভিযানে অংশ নেয়।

    আর ইত্তিহাদুল ইসলামিয়ার ক্ষুদ্র এই দলটি সোমালিয়ায় কর্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি ইথিওপিয়ার নিয়ন্ত্রণে থাকে ওগাডেনেও হামলা চালিয়ে যায়। পাশাপাশি আল-কায়েদার নেতৃত্বে ১৯৯৮ সালে কেনিয়া এবং তানজানিয়ায় পরিচালিত হামলায় অংশ নেয়। একই সময় শাইখ সাইফ আল-আদেল (হাফি.) এর নেতৃত্বে রাজধানী মোগাদিশুতে মার্কিন বিমান ভূপাতিত করে। এবং ৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে সোমালিয়ায় জাতিসংঘের উপস্থিতির বিরুদ্ধে যুদ্ধেও বড় ভূমিকা পালন করে ইত্তিহাদুল ইসলামিয়া। সেই সাথে ১৯৯৮ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে এই জোটের অনেক সদস্যই শাইখ ওসামার নির্দেশে ইয়েমেনে হিজরত করেন। বিশেষ করে ২০০১ এর ১১ সেপ্টেম্বরের (৯/১১) ঘটনার পর ক্রুসেডার মার্কিন বাহিনী যখন সোমালিয়ায় ইত্তিহাদুল ইসলামিয়ার সদস্যদের টার্গেট করে বিমান হামলা চালানো শুরু করে, তখন হিজরতের এই মাত্রা কয়েকগুণ বেড়ে যায়।

    যাইহোক ১৯৯৮ সালের পর থেকে উভয় জোট রাজধানীর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। তবে ইত্তিহাদুল ইসলামিয়ার তুলনায় ইসলামিক কোর্ট অনেকাংশেই ছিলো এগিয়ে। দলটি ২০০২ সালের মধ্যে রাজধানীর বিস্তীর্ণ অঞ্চলের উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। আর একবছরের ব্যবধানে উভয় দল সোমালিয়ার দক্ষিণাঞ্চল থেকে পুরোপুরিভাবে পশ্চিমা দোসরদের হটাতে সক্ষম হয়। সেই সাথে ২০০৪ এর মধ্যে উভয় বাহিনী নিজেদের মধ্যে কোন সংঘর্ষ ছাড়াই রাজধানীর প্রাণ কেন্দ্রে পৌঁছে যায়। এবং ঐবছরের নভেম্বর নাগাদ রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহর ব্যতিত পুরো প্রদেশটি মুজাহিদগণ শত্রু মুক্ত করেন। এসময় উভয় দল নিজ নিজ নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে ইসলামি শরিয়াহ্ ভিত্তিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনে। পাশাপাশি তাঁরা দেশের উত্তরে এবং ইথিওপিয়ার দখলে থাকা ওগাডেনে সামরিক অভিযান শুরু করে। যা ২০০৬ সালের জুন মাস পর্যন্ত চলতে থাকে।

    TL-2007-Mogadishu-Falls-jpg

    একতাই যখন শক্তি, বিজয় তখন নিশ্চিত :

    মুজাহিদগণ যখন দেশের উত্তরাঞ্চল ও ইথিওপিয়ার ওগাডেনে সামরিক কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। তখন ক্রুসেডার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাজধানীর কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা সেক্যূলাদরদের শক্তিশালী করতে থাকে। সর্বশেষ ২০০৬ সালের মে মাসে ক্রুসেডারদের শক্তিতে বলিয়ান এই সেক্যূলাররা মুজাহিদদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। তারা মুজাহিদদের থেকে রাজধানী মোগাদিশু দখল করতে এবং সেখানে প্রতিষ্ঠিত ইসলামী শাসনের অবসান ঘটাতে ব্যাপক আক্রমণ চালায়। এই সময়টাতে মার্কিন বাহিনী স্থল পথে সরাসরি যুদ্ধে না জাড়ালেও, আকাশ পথে বিমানযোগে মুজাহিদদের উপর হামলা চালাতে থাকে। আর স্থল পথে তাদের গোলামদের সামরিক সহায়তা দিতে থাকে। এরফলে সোমালিয়ার এই যুদ্ধ পূর্বের যেকোনো সময়ের চাইতে আরও বেশি তীব্র আকার ধারণ করে।

    যুদ্ধের এই কঠিন পরিস্থিতি সামাল দিতে আল-কায়েদার পরামর্শে সোমালিয়ার অন্যতম বৃহত্তম ইসলামী সশস্ত্র প্রতিরোধ বাহিনী “ইত্তিহাদুল ইসলামিয়া ও ইসলামিক কোর্ট” এর উমারাগণ জুরুরি বৈঠকে বসেন। উভয় দলের মধ্যকার মতানৈক্য নিষ্পত্তি করতে এবং তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করতে এই বৈঠকে আল-কায়েদার সিনিয়র কমান্ডাররাও অংশ নেন।

    অবশেষে দীর্ঘ আলোচনার পর এই বৈঠক সফলতার মুখ দেখে এবং দলগুলো নিজেদের মধ্যকার মতানৈক্য ভুলে গিয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে সম্মত হয়। সেই ধারাবাহিকতায় ইত্তিহাদুল ইসলামিয়া তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়ে ইসলামিক কোর্টে একীভূত হয়। দলগুলোর এই একীভূতকরণ ইসলামিক কোর্টসের ক্ষমতা এবং প্রতিরোধ যুদ্ধকে অনান্য এক উচ্চতায় নিয়ে যায়।

    তখনকার সর্বশেষ পরিস্থিতি, নভেম্বর-২০০৬ :

    এরপর, জুন-ডিসেম্বর ২০০৬ সময়কালে, মহান আল্লাহ তাআ’লার সাহায্যে ইসলামিক কোর্টস ইউনিয়নের বীর যোদ্ধারা মার্কিন সমর্থিত গোলামদের বিরুদ্ধে ব্যাপক আক্রমণ শুরু করেন।

    প্রতিরোধ যোদ্ধাদের দীর্ঘ ৭ মাসের ব্যাপক অভিযানে রাজধানী মোগাদিশুর কেন্দ্রীয় শহর ও আশেপাশের এলাকাগুলো প্রথম বারের মতো মার্কিনপন্থী যুদ্ধবাজদের কাছ থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত করেন মুজাহিদগণ। আলহামদুলিল্লাহ্।

    এভাবে, ইসলামিক কোর্টস ইউনিয়ন ২০০২ সালে রাজধানীতে ঢুকার পর প্রথমবারের মতো মোগাদিশু এবং এর আশেপাশের গুরুত্বপূর্ণ সরকারি সব স্থাপনা ও সংস্থার অফিসগুলোর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন। মার্কিন-সমর্থিত যুদ্ধবাজ এবং সমস্ত পশ্চিমা-সমর্থিত সংস্থাগুলো সম্পূর্ণভাবে পরাজিত না হওয়া পর্যন্ত মুজাহিদদের এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত ছিল।

    মহান রবের সাহায্যে আসা এই বিজয়ের পর মুজাহিদগণ আরও ঐক্যবদ্ধ এবং শক্তি সঞ্চয় করতে থাকেন। মোগাদিশু বিমানবন্দর এবং শহরের অন্যান্য বন্দর জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এই বছরই মুজাহিদগণ প্রথমবার সোমালিয়ায় ইমারাতে ইসলামিয়া প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন।

    এই ঘোষণার পর নতুন প্রশাসন দেশে মাদককে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে এবং অর্থনীতির উন্নয়নে পদক্ষেপ নিতে শুরু করে। সোমালিয়া উপকূলে জলদস্যুতা কার্যক্রম কঠিন হস্তে পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়।

    চলবে ইনশাআল্লাহ…



    লেখক : ত্বহা আলী আদনান



    আগের কিস্তিসমূহ পড়ুন
    ——————————-

    ১। সোমালিয়ায় উদয়ের পথে নিকটবর্তী বিজয়ের নতুন সূর্যোদয়
    https://alfirdaws.org/2022/07/17/58043/
    ২। সোমালিয়ায় উদয়ের পথে নিকটবর্তী বিজয়ের নতুন সূর্যোদয় ||দ্বিতীয় কিস্তি|| বৃহত্তর সোমালিয়ায় আশ-শাবাবের ঐতিহাসিক উত্থান ও পটভূমি
    https://alfirdaws.org/2022/07/25/58162/
    ৩। সোমালিয়ায় উদয়ের পথে নিকটবর্তী বিজয়ের নতুন সূর্যোদয় ||তৃতীয় কিস্তি|| আশ-শাবাবের গঠন ও শায়েখ ওসামা’র (রাহি.) প্রভাব
    https://alfirdaws.org/2022/07/31/58288/

    মন্তব্য করুন

    দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
    দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

    পূর্ববর্তী নিবন্ধভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র আর মুসলিমদের হিন্দু বানানোর উসকানিমূলক মন্তব্য হিন্দুত্ববাদী সুরেন্দ্রর
    পরবর্তী নিবন্ধআবারো উত্তপ্ত বুয়েট : ছাত্রলীগের ‘চেতনাবাজি’ আর গায়ের জোরের খেলার শেষ কোথায়?