ভারতে মুসলিমদের প্রতি হিন্দুদের জিঘাংসা ও সহিংসতা দিনদিন বেড়ে তীব্র আকার ধারণ করছে। বিশেষ করে হিন্দুদের প্রায় প্রতিটি উৎসবেই মুসলিমদের উপর সহিংসতা বহুগুণে বেড়ে যায়।
হিন্দুদের অন্যতম একটি উৎসব হলো রাম নবমী। ১৯৭৯ সালে রাম নবমী উপলক্ষে প্রথম বড় দাঙ্গার খবর পাওয়া গিয়েছিল। জামশেদপুরে তখন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) বালাসাহেব দেওরাসের তীব্র উস্কানিমূলক বক্তৃতার ফলে সৃষ্ট দাংগায় ১১৬ জন নিহত হয়েছিল।
এরপর ১৯৯২ সালে ‘আরএসএস পরিবার’ তথা আরএসএস-এর আদর্শের অধীনে একত্রিত বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের সম্মিলিত প্লাটফর্ম অযোধ্যা অভিমুখে রথ যাত্রা উৎসবের আয়োজন করেছিল। এটিই মূলত বাবরি মসজিদ ধ্বংসের জন্য দায়ী, যে ঘটনা তখন সমগ্র ভারতে মুসলিমদের প্রতি সহিংসতার সূত্রপাত করেছিল।
ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এই আরএসএস পরিবারের অংশ। তারাও বছরের পর বছর ধরে সহিসংতা চালিয়ে আসছে।
উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা রাম নবমীর আয়োজনে প্রায়শই খোলা অস্ত্র এবং ইচ্ছাকৃত উস্কানিমূলক বিভিন্ন প্রদর্শনী করে, ঘনবসতিপূর্ণ মুসলিম এলাকার মধ্য দিয়ে মিছিল করে এবং মুসলিমদের মসজিদ, পবিত্র স্থান এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে উস্কানিমূলক স্লোগান দেয়। এসব কাজে আরএসএস ও বিজেপি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।
আরএসএস কী এবং ক্ষমতাসীন বিজেপির সাথে এটি কতটা জড়িত?
আরএসএস একটি মুসলিম-বিরোধী হিন্দু সশস্ত্র আধা-সামরিক সংগঠন। আরএসএস এবং বিজেপি উভয়ই একে অপরের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তারা একই আদর্শ এবং দৃষ্টিভঙ্গি লালন করে। তারা একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। বর্তমান বিজেপি সরকারের প্রতি চার মন্ত্রীর মধ্যে তিনজনই আরএসএস-এর। আর, আরএসএস-এর মতো উগ্র হিন্দু সংগঠনগুলিই ভারতের মুসলিমদের প্রতি সহিংসতাকে উস্কে দিচ্ছে।
এই বছর (২০২৩) রমজানে ভারতের ১০ টি রাজ্যে অন্তত ২৮টি স্থানে রাম নবমীর মিছিলের সময় উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ড, ভাংচুর এবং সহিংস সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। হিন্দু মিছিলকারীরা ইচ্ছাকৃতভাবে ঘনবসতিপূর্ণ মুসলিম এলাকায় প্রবেশ করেছে (কখনও কখনও মিছিলের রুটের অনুমতি ছাড়াই) এবং উচ্চ-আওয়াজে উস্কানিমূলক স্লোগান এবং সাউন্ড বক্সে হাই ভলিওমে হিন্দুত্ববাদী পপ গান বাজিয়েছে। এ বিষয়গুলোই তাদেরকে পাথর নিক্ষেপ, ছুরি এবং তরবারি দিয়ে হামলা চালাতে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
তাছাড়া দিল্লি পুলিশ যেভাবে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পরিস্থিতি মোকাবেলা করে, তা কোনো ভাবেই প্রশংসনীয় নয়। সাধারণত, নির্বাহী কর্তৃপক্ষ যে সরকার ক্ষমতায় থাকে তার অধীনস্থ থাকে। ফলস্বরূপ, সাম্প্রদায়িক সংঘাতের সময় তাদের নিরপেক্ষতা প্রায়শই প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এমনকি সহিংসতার সময় পুলিশ প্রত্যক্ষ এবং প্ররোক্ষভাবে হিন্দুদের পক্ষ নিয়ে মুসলিমদের উপর হামলাও চালিয়েছে।
মুসলিম গণহত্যার প্রেক্ষাপট তৈরী
মুসলিম গণহত্যার মাঠ প্রস্তুত করতে হিন্দুরা একের পর এক মুসলিম বিদ্বেষী ইস্যু তৈরী করছে। প্রোপাগান্ডামূলক সিনেমা বানিয়ে হিন্দু মুসলিমদের মাঝে মেরুকরণ করছে।
‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ সিনেমাটি মুক্তির পর যেভাবে মুসলিমদের উপর সহিংসতা হয়েছিল, সেভাবে ‘দ্য কেরালা স্টোরির’ কুপ্রভাবও পড়তে শুরু করেছে সমাজে।
মনগড়া তথ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক আগুন ছড়ানো সিনেমাগুলোর মাধ্যমে হিন্দুত্ববাদীরা সহিংসতাকে উস্কে দিচ্ছে। হিন্দুত্ববাদীদের অতৃপ্ত তৃষ্ণা মেটাতে নির্দোষ মুসলিমদের রক্ত ঝরানো হচ্ছে। হিন্দুত্ববাদীরা রাম রাজ্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিকল্পিতভাবে ধীরে ধীরে মুসলিম গণহত্যার দিকে যাচ্ছে। এর ঘোষণা এখন হিন্দুত্ববাদী উগ্র নেতারা প্রকাশ্যেই দিচ্ছে।
মুসলিমদেরকে জাতিগত নির্মূল করার যে প্রক্রিয়া তার পূর্ব ধাপগুলো সম্পন্ন করে মূল নিধন পর্বে প্রবেশের প্রস্তুতি নিচ্ছে হিন্দুত্ববাদীরা। ক্রমবর্ধমান সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ডকে বিশ্লেষকগণ গণহত্যার পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। এগুলোকে গণহত্যার অশনি সংকেত হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন তারা।
এ ব্যাপারে প্রফেসর গ্রেগরি এইচ স্ট্যান্টন বিগত (১০/০১/২২ সালে) টুইটারে ভারতে মুসলিমদের উপর গণহত্যা শুরু হওয়ার ব্যাপারে জরুরী সতর্ক বার্তা দিয়েছেন।
জেনোসাইড ওয়াচের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক স্ট্যান্টন বলেছেন, ভারত মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর গণহত্যা চালানোর ৮ম ধাপে আছে। আর এক ধাপ পরেই শুরু হতে পারে মুসলিম গণহত্যা।
প্রফেসর স্ট্যান্টন হলেন “গণহত্যার ১০ ধাপ” তত্ত্বের স্থপতি এবং অলাভজনক সংস্থা জেনোসাইড ওয়াচের প্রতিষ্ঠাতা। এই সংগঠন গণহত্যার পূর্বাভাস জানায় এবং গণহত্যাসহ আরও অন্যান্য উপায়ে মানুষ হত্যা প্রতিরোধে কাজ করেন৷
তথ্যসূত্র :
1. Why violence towards India’s minorities is increasing (Qantara.de)
– https://tinyurl.com/58pb6abx