ইসলামের তারকাগণ || পর্ব-২৫ || শামিল বাসায়েভ রাহিমাহুল্লাহ; আগ্রাসী রাশিয়ার ঘুম কেড়ে নেওয়া এক চেচেন বীর || (দ্বিতীয় কিস্তি)

লিখেছেন: মুফতি আব্দুল্লাহ মুনতাসির

0
900

❝আমার মুসলিম ভাইদের উদ্দেশ্যে বলছি: আল্লাহর অনুগ্রহে অচিরেই ইসলাম বিজয়ী হবে। এ বিজয়ে প্রত্যেক মুসলিম অংশগ্রহণ করতে পারবে। এজন্য সবাইকে চেচনিয়া আসতে হবে না। প্রত্যেকেই আপন আপন জায়গা থেকে ইসলামের মাহাত্ম্যকে উঁচিয়ে ধরুন।
জিহাদের এই দুর্গম পথে যারা আমাদের সাহায্য করছেন, আল্লাহ তা’আলা আপনাদের সর্বোত্তম প্রতিদান দান করেন৷ বিশ্বের সকল অসহায় মুসলিমের সার্বিক সহযোগিতার উপলব্ধি আমাদের পূর্ণমাত্রায় আছে। আমরা এটা নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি যে, নির্যাতিত নিপীড়িত মুসলিমদের দুআর বদৌলতে আমরা অবশ্যই বিজয়ী হবো-ইনশাআল্লাহ। আমাদের ভাইয়েরা আমাদের জন্য দুআ করবে, তাদের থেকে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।❞ — শামিল বাসায়েভ।

১৯৯৪ সালে রাশিয়া নতুনভাবে চেচনিয়ার উপর আক্রমণ শুরু করার পর চেচেনদের সঙ্গে রুশদের এক চরম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সূচনা হয়৷ এতে শামিল বাসায়েভ আফগানিস্তান থেকে চেচনিয়া চলে আসেন এবং চেচেনদের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। রাশিয়ার সাথে চেচেনদের এই যুদ্ধ ইতিহাসে “প্রথম চেচেন যুদ্ধ” নামে প্রসিদ্ধি পায়।

প্রথম চেচেন যুদ্ধ:

১৯৯৪ সালের ১১ ডিসেম্বর রুশ বাহিনীর চেচনিয়া আক্রমণের মধ্য দিয়ে প্রথম চেচেন যুদ্ধের সূচনা হয়। ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৯৬ সালের আগস্ট পর্যন্ত ছিল এ যুদ্ধের স্থায়িত্বকাল। প্রাথমিকভাবে রুশ-বাহিনী চেচনিয়ার পার্বত্য অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ দখলে নেওয়ার চেষ্টা করে। দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৯৯৪ সালের ১১ ডিসেম্বর রুশ বাহিনী যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে চেচনিয়ার রাজধানী গ্রোজনি অভিমুখে নিয়ে যায়। চতুর্দিক থেকে গ্রোজনি অবরোধ করে রুশ বাহিনী। দীর্ঘ এক সপ্তাহব্যাপী বিমান হামলা ও অনবরত গোলাবর্ষণ চলতে থাকে পুরো গ্রোজনি জুড়ে। এর ফলে গ্রোজনির হাজার হাজার নিরীহ মানুষ নিহত হয়। অসংখ্য বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়। স্বয়ং রাষ্ট্রপতির প্রাসাদও বাদ যায়নি রুশ সেনাদের বোমাবর্ষণের কবল থেকে।

পরবর্তী সময়ে ১৯৯৬ সালের মার্চ থেকে স্বাধীনতাকামীরা রুশদের বিরুদ্ধে গেরিলা পদ্ধতিতে জোরদার আক্রমণ শুরু করে। রুশদের অধিকৃত অনেক অঞ্চল তারা ফিরিয়ে নিতে সক্ষম হয়। একই বছরের ১৬ এপ্রিল আরব জিহাদী নেতা আমীর খাত্তাবের (১) যোদ্ধারা শাতোয়ে একটি বৃহৎ রুশ আর্মার্ড কলামকে ধ্বংস করে এবং কমপক্ষে ৭৬ জন রুশ সৈন্যকে হত্যা করে। শামিল বাসায়েভের জন্মভূমি ভেদেনোর নিকট আরেকটি আক্রমণে কমপক্ষে ২৮ জন রুশ সৈন্য নিহত হয়। এভাবে একের পর এক শক্তিশালী আক্রমণের সামনে রাশিয়ান সৈন্যরা পিছু হটতে বাধ্য হয়।

রুশ বিরোধী তীব্র জনমত, চেচেন গেরিলা যোদ্ধাদের প্রাণপণ লড়াইয়ের ফলে প্রচুর জনবল ও অস্ত্রবল থাকা সত্ত্বেও রুশ বাহিনী পরাজিত হয়। অবশেষে ১৯৯৬ সালের আগস্টে বোরিস ইয়েলৎসিনের সরকার চেচেনদের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। পরবর্তী বছর রাশিয়া ও চেচনিয়ার মাঝে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এভাবেই প্রথম চেচেন যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে।

প্রথম চেচেন যুদ্ধ ও শামিল বাসায়েভ:

প্রথম চেচেন যুদ্ধে চেচেন রাষ্ট্রপতি জোখার দুদায়েভ শামিল বাসায়েভকে রাশিয়া বিরোধী যুদ্ধক্ষেত্রে ফ্রন্টলাইন প্রতিরক্ষা কমান্ডার হিসাবে নিযুক্ত করেন। যুদ্ধ ক্রমাগত তীব্র আকার ধারণ করে। সেই সাথে শামিল বাসায়েভ একজন অভিজ্ঞ ফ্রন্ট-লাইন কমান্ডার হয়ে ওঠেন। আবখাজিয়ার যুদ্ধে তিনি ও তার ব্যাটালিয়ন সফল ভূমিকা পালন করেন এবং গ্রোজনির যুদ্ধে রাশিয়ান বাহিনীর ব্যাপক ক্ষতি সাধন করেন।

যুদ্ধ চলাকালীন শামিল বাসায়েভ একটি অভিনব কৌশল আবিষ্কার করেন। তিনি নিজ বাহিনী নিয়ে বড় বড় রুশ সেনাপতি ও সাধারণ সৈনিকদের ব্যাপকহারে জিম্মি করার অভিযানে নেমে পড়েন। এতে রুশ সেনাপতি ও সাধারণ সৈনিকদের অন্তরে আতঙ্ক ঢুকে যায়। এক অনিশ্চিত আতঙ্কে তাদের স্বাভাবিক জীবন-যাপন বিপন্ন হয়ে উঠে।

১৯৯৫ সালের জুনের মাঝামাঝি সময়ে শামিল বাসায়েভের নেতৃত্বে একদল চেচেন যোদ্ধা দক্ষিণ রাশিয়ার বুদিয়োন্নোভস্ক শহরের একটি হাসপাতালে ১,৫০০ জনেরও বেশি মানুষকে জিম্মি করে। এর উদ্দেশ্যে ছিল, রাশিয়া যেন গ্রোজনি অবরোধ তুলে নেয়। কেননা, তখন চেচেনিয়ার রাজধানী গ্রোজনি অবরুদ্ধ ছিল। অনবরত বোমাবর্ষণ চলছিল। ফলে হাজার হাজার নিরীহ মানুষ হতাহত ও বাস্তুচ্যুত হচ্ছিল। এমন কঠিন পরিস্থিতিতে শামিল বাসায়েভের এমন সময়োপযোগী কৌশল ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছিল। (২) বাসায়েভ ও রুশ প্রধানমন্ত্রী ভিক্তর চের্নোমির্দিনের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রায় ১২০ জন রুশ নিহত হয়েছিল। শামিল বাসায়েভের এই আক্রমণের ফলে রুশরা সাময়িকভাবে চেচনিয়ায় তাদের সামরিক কার্যকলাপ বন্ধ রাখতে এবং গ্রোজনির অবরোধ তুলে নিতে বাধ্য হয়েছিল। এই সুযোগে চেচেনরা তাদের শক্তিবৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়।

শামিল বাসায়েভ চেচেন সমস্যার প্রতি বিশ্বের অন্য মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। সে লক্ষ্যে ১৯৯৬ সালের ৬ মার্চ তার বাহিনী জার্মানিগামী একটি সাইপ্রিয়ট যাত্রীবাহী বিমান জিম্মি করেন। একই উদ্দেশ্যে সে বছরের ৯ জানুয়ারি চেচেন মুজাহিদরা কৃষ্ণসাগর থেকে ২০০ রুশ যাত্রীসহ একটি তুর্কি জাহাজ জিম্মি করেন। উভয় ক্ষেত্রে চেচেনদের সঙ্গে রুশ সেনাপতিরা আলোচনায় বসতে বাধ্য হয়।

রাশিয়া যখন বুঝতে পারে শামিল বাসায়েভ এ যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন তখন তারা বাসায়েভকে হত্যা করার পরিকল্পনা করতে থাকে। সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৫ সালের ৩ জুন চলমান যুদ্ধের ফ্রন্টলাইন কমান্ডার শামিল বাসায়েভকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে তার চাচার বাড়িতে দুটি বোমা নিক্ষেপ করে রাশিয়া। কিন্তু দ্বীনের এই মহান খাদেমকে আল্লাহ তা’আলা বাঁচিয়ে রাখেন। তবে তার স্ত্রী, সন্তান ও বোনসহ তার পরিবারের ১২ জন সদস্য নিহত হন এবং পরে এক যুদ্ধে তার এক ভাইকেও হত্যা করা হয়।

যুদ্ধের ময়দানে শামিল বাসায়েভের অভিজ্ঞ নেতৃত্বের ফলে রাশিয়া গ্রোজনি থেকে অবরোধ তুলে নিতে বাধ্য হয়। চেচেন-অচেচেন, প্রজাতন্ত্রের সমর্থক ও ইসলামী শরীয়াহর সমর্থক- সকলেই শামিল বাসায়েভকে দ্বিধাহীনচিত্তে রুশ বিরোধী যুদ্ধের কমাণ্ডার হিসেবে মেনে নেয়। শেষ পর্যন্ত এ যুদ্ধে শামিল বাসায়েভ জয়লাভ করেন এবং রাশিয়ান সরকারকে চেচনিয়ার সাথে একটি শান্তিচুক্তি করতে বাধ্য করেন। এর মধ্য দিয়ে চেচেনরা বিজয়ী হয় এবং রাশিয়া থেকে তাদের স্বাধীনতা অর্জিত হয়।

চলবে ইনশাআল্লাহ…


নোট:

(১) আমীর খাত্তাব। মূল নাম: সামির ইবনে সালেহ ইবনে আব্দুল্লাহ। জন্ম: সৌদি আরবে। শাহাদাত: ২০ মার্চ, ২০০২ সালে মাত্র ৩২ বছর বয়সে চেচনিয়ার রণাঙ্গনে। লড়েছেন: আফগানিস্তান, তাজিকিস্তান, দাগিস্তান, আজারবাইজান ও চেচনিয়ার রণাঙ্গনে। ইসলামের তারকাগণ সিরিজের পরবর্তী কোনো পর্বে আমরা এই অকুতোভয়, শাহাদাতের নেশায় উন্মাদ ও শাহাদাতের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে জান্নাতের সবুজ পাখি হয়ে উড়ে বেড়ানো (ইনশাআল্লাহ্‌) মানুষটিকে নিয়ে কিছু লেখার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।

(২) তবে সেক্যুলাররা বরাবরের মতোই এজাতীয় আক্রমণকে মানবতাবিরোধী আখ্যা দিয়ে শামিল বাসায়েভকে সন্ত্রাসী হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করে। বিপরীতে গ্রোজনিতে বোমাবর্ষণ করে হাজার হাজার নিরীহ মুসলিমদের হত্যা করেও এসকল সেক্যুলারদের কাছে রাশিয়া নিষ্পাপ-ই থেকে যায়। যদিও যুদ্ধকৌশল সম্পর্কে যাদের কিঞ্চিত ধারণা আছে তারা বিষয়গুলো সহজেই ধরতে পারার কথা।


তথ্যসূত্র:

(১) https://tinyurl.com/3hp747yz
(২) https://tinyurl.com/yckv8tpv
(৩) https://tinyurl.com/4584hmcd
(৪) https://tinyurl.com/mr4j74he
(৫) https://tinyurl.com/2d7tvmus


ইসলামের তারকাগণ || পর্ব-২৪ || শামিল বাসায়েভ রাহিমাহুল্লাহ; আগ্রাসী রাশিয়ার ঘুম কেড়ে নেওয়া এক চেচেন বীর। (প্রথম কিস্তি)

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধফটো রিপোর্ট || শাবাবের নিয়ন্ত্রণে আরেক শহর; অন্তত ২১৭ উগান্ডান সেনা নিহত
পরবর্তী নিবন্ধআমরা পাকিস্তানকেও হিন্দু জাতিতে পরিণত করব: হিন্দু ধর্মগুরু