মহারাষ্ট্রের আহমেদনগর জেলার সংগমনের এলাকায় পাঠান সাহেবের একটি রেস্তোরাঁ রয়েছে। ৬ জুন সকাল ৯ টার দিকে প্রায় ১০০-১৫০ জনের একটি হিন্দু গুণ্ডা বাহিনী রেস্তোরাঁ প্রাঙ্গণের বাইরে জড়ো হয়, এবং “জয় শ্রী রাম” ও “লান্ড্যাদের মারধর কর” এমন স্লোগান দিতে শুরু করে। (মহারাষ্ট্রের মুসলমানদের জন্য একটি অবমাননাকর শব্দ হিসেবে হিন্দুরা লান্ড্যা শব্দটি ব্যবহার করে।)
হিন্দু আক্রমণকারীদের কিছু লোক পাঠান সাহেবকে রেস্তোরাঁ বন্ধ করতে বললে তিনি ভয় পেয়ে গ্রাহকদের জানিয়ে রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেন। তিনি জানান যে, রেস্তোরাঁ বন্ধ করতে শুরু করলেও হিন্দু আক্রমণকারী বাহিনী রেস্তোরাঁয় ভাঙচুর শুরু করে। তারা কাউন্টার উল্টে দেয়, চেয়ার ভাংচুর করে এবং খাবারের জিনিসপত্র নষ্ট করে। তারা রেস্তোরাঁর কর্মচারীর পায়ে ফুটন্ত তেলের একটি কড়াই ফেলে দেয়। এভাবে ভাঙচুর চালিয়ে হিন্দুরা চলে যায়।
ঘটনার সূত্রপাত :
এই সহিংসতাটির সূত্রপাত হয় হিন্দু সমাজ কর্তৃক আয়োজিত একটি ‘ভাগওয়া মোর্চা’ নামক মিছিল থেকে। সেই মিছিলের পটভূমি ছিল, গত ২৮ মে সংগঠিত একটি ট্রাফিক সম্পর্কিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে। এই মিছিলের বিক্ষোভকারীরা মুসলিমদের দিকে পাথর নিক্ষেপ করে, মুসলিমদের বাড়িতে প্রবেশ করে এবং তাদের বাড়িঘর ও দোকান ভাঙচুর করে।
সংগমনের এলাকায় রাস্তার আশেপাশে মুসলিমদের বেশ কয়েকটি স্টল ও দোকান আছে। এই রাস্তায় প্রায়শই যানজট লেগে যায়, যা এখানকার মানুষের কাছে এক প্রকার নিত্য সঙ্গী হয়ে গেছে।
আব্দুল আজিজ নামের একজন সমাজকর্মী জানান, “২৮ মে একটি টেম্পো ওই এলাকা দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। জ্যামে আটকে সেটি বারবার হর্ন বাজাতে থাকে। এক স্টল মালিক তাকে হর্ন বাজাতে নিষেধ করলে এটা নিয়ে তর্ক বেঁধে যায়। এক পর্যায়ে তর্ক কিছুটা উত্তপ্ত হয়ে উঠলে চালক সেখান থেকে চলে যায়। এর মিনিট পনের পরে ঐ চালক সাথে ছয়-সাতজন লোক নিয়ে সেখানে ফিরে এলে তাদের মাঝে তর্ক উত্তপ্ত হয়ে উঠে। পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠলে স্টল মালিকরা তাদেরকে মারধর করে তাড়িয়ে দেয়।”
তখন টেম্পো চালক পুলিশে অভিযোগ দায়ের করেন এবং “প্রায় ১০০-১৫০ জনের একটি হিন্দু গুণ্ডা বাহিনী জড়ো করে,” আজিজ বলেন, “তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে গালাগালি শুরু করে এবং আক্রমণও করে। তখন পুলিশ হস্তক্ষেপ করলে তাদের দিকেও পাথর ছোড়া হয়।”
হিন্দুরা অপরাধ করে আইন নিজের হাতে তুলে নিলেও এ ঘটনাকে “হিন্দু বিরোধী” নানা রূপ দিয়ে প্রতিবাদ মিছিলের ডাক দেয়া হয়। কথিত ‘হিন্দু সমাজ’ এর সদস্যরা এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে আশেপাশের গ্রামের হিন্দুদের মাঝে মুসলিম বিদ্বেষ উসকে দেয়, হিন্দুদেরকে একত্রিত হয়ে তাদের মিছিলে অংশগ্রহণের জন্য উৎসাহিত করে। গ্রাম পঞ্চায়েত এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা মোর্চাকে সমর্থন করার জন্য প্রস্তাব পাস করে।
হিন্দুদের ভগওয়া মোর্চা ৬ জুন সকাল ৯ টায় শুরু হয়। স্থানীয়রা মুসলিমরা জানান, তখনই সহিংসতার ঢেউ শুরু হয়। অংশগ্রহণকারী হিন্দুরা স্লোগান তুলে “লাঠি তুলুন এবং ল্যান্ডা তাড়ান। সব মসজিদ ধ্বংস কর! তবেই হিন্দুদের শক্তি প্রকাশ পাবে। মুসলিমদের সব কিছু বন্ধ করাই হিন্দুদের শক্তি। কিছু দিন পর, আমরা তাদের ঘর থেকে টেনে বের করে মারব।”
উল্লেখ্য, পাঠান সাহেব জানিয়েছেন, তার দোকান “একজন পুলিশ সদস্যের সামনে” ভাংচুর করা হয়েছে। “আমার ৪০,০০০ টাকার ক্ষতি হয়েছে। আমি বিকেল ৫টার দিকে থানায় গিয়েছিলাম কিন্তু এফআইআর দায়ের করতে রাত ১০টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। আমি একজন ব্যবসায়ী। রাজনীতির সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।
সুরেশ চাভানকের উপস্থিতি ও উস্কানি:
৬ জুনের সমাবেশে চরম মুসলিম বিদ্বেষী এক উচ্চ-পদস্থ হিন্দু নেতা সুরেশ চাভানকে উপস্থিত ছিল। সে সুদর্শন নিউজের প্রধান সম্পাদক এবং বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের জন্য কুখ্যাত। বক্তৃতার এক পর্যায়ে, সে “লাভ জিহাদ” এর বিরুদ্ধে সতর্ক করে মোর্চায় উপস্থিতদের সম্বোধন করে বলেছে, সংগমনা “শীঘ্রই পাকিস্তানে পরিণত হতে পারে”। সে আরও বলেছে যে, মুসলিম মেয়েদের যৌনদাসী বানিয়ে রাখতে “হিন্দু পুরুষদেরকে তাদের বিয়ে করতে হবে।”
সমাবেশে অংশ নেওয়া অনুরাগ তাজানে অভিযোগ করে, “আমাদের ছেলেরা ফিরে যাওয়ার সময় সামনাপুরে কিছু মুসলমান গালি শুরু করে এবং পাথর ছুঁড়তে শুরু করে। আমাদের ছেলেরা সংখ্যায় কম ছিল বলে তারা এটা করতে সাহস করে। ২৮ মে আমাদের লোকদের উপর হামলা হয়।”
সে ২৮ মে ট্র্যাফিক সমস্যাটির জন্য মুসলিম সম্প্রদায়কেই অভিযুক্ত করেছে।
হিন্দু নেতাদের বক্তৃতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সমাবেশের পরেই হিন্দুরা সহিংসতা শুরু করে। সহিংসতা শহরের সীমানা ছাড়িয়ে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে সামনাপুর গ্রামেও পৌছেঁ যায়।
সহিংসতার কিছু বর্ণনা:
স্থানীয় একজন ৭০ বছর বয়সী মুসলিম, হোসেন ফকির মোহাম্মদ শেখ তার বাড়ির বাইরে একটি বিছানায় শুয়ে ছিলেন। মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা তার উপর আক্রমণ করে। তার ৬৩ বছর বয়সী স্ত্রী রাশিদাও আক্রমণের শিকার হন। তিনি জানিয়েছেন, “আমার স্বামী বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। তারা আমাদের ল্যান্ড্যা বলে ডাকতে শুরু করে। আমরা চুপ করে ছিলাম এবং সাড়া দেইনি।
“তারা পাথর ছুঁড়ে, ঘরে ঢুকে আমাদের মারধর করে। তারা আমার স্বামীর মাথায় কোদাল দিয়ে আঘাত করে। আমাকে লাথি মেরে নিচে ফেলে দেয়। আমরা কোন অন্যায় বা ভুল করিনি – আমরা দুজনেই চুপচাপ আমাদের ঘরে বসে ছিলাম।”
রাশিদা বলেছিলেন যে, তিনি অতটা গুরুতর আহত হননি, তবে তার স্বামী বর্তমানে হাসপাতালে আইসিইউতে রয়েছেন। আর আক্রমণকারীরা পুলিশের সামনেই এসব করেছে বলেও জানান তিনি।
শেখের ভাই চাঁদ ফকির মোহাম্মদ ঘটনার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। সামনাপুরের আরেকজন বাসিন্দাও বলেছেন যে, মিছিলটি তাদের গ্রামের মধ্য দিয়ে গিয়েছিল এবং অংশগ্রহণকারীরা “ঢিল ছুড়েছিল এবং ‘লান্ডে মুর্দাবাদ’ এর মতো স্লোগান দেয়”। “পুলিশ সেখানে ছিল। পুলিশ তাদের থামানোর চেষ্টা করেনি।”
সমনাপুরের বাসিন্দা হুসেন শেখ বলেছেন, গ্রামীণ পুলিশ অলসভাবে দাঁড়িয়ে ছিল এবং শহরের পুলিশ বিলম্ব করে আসে। ততক্ষণে আক্রমণকারী হিন্দুরা সেখান থেকে চলে যায়। “আমরা মার্চের তিন দিন আগে কালেক্টর ও পুলিশের কাছে অভিযোগ জানিয়েছিলাম। আমরা বলেছিলাম যে, মোর্চার একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করা এবং আমরা তাদের এটি বন্ধ করার জন্য অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু কেউ আমাদের অনুরোধে কর্ণপাত করেনি। মন্ত্রী রাধাকৃষ্ণ ভিখে পাতিল এবং কংগ্রেস বিধায়ক বালাসাহেব থোরাতকেও চিঠিও পাঠানো হয়েছিল।”
এভাবে মুসলিমদের বিরুদ্ধে একের পর এক ছোট-বড় সহিংসতা চালানো কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বরং মুসলিমদের ভারত থেকে বিতাড়িত করতে এবং মুসলিম-মুক্ত অখণ্ড ভারত গড়তে ব্যাপক মুসলিম গণহত্যা চালানোর পূর্ব-প্রস্তুতি হিসেবেই এসব ঘটনা ঘটানো হচ্ছে বলেই প্রতীয়মান হয়।
তথ্যসূত্র:
1. ‘Destroy all mosques to show Hindu strength’: Unravelling the June 6 violence in Sangamner
– https://tinyurl.com/uj6kynhc