গত মঙ্গলবার পাকিস্তান সরকার প্রায় ১.৭৩ মিলিয়ন আফগান শরণার্থীকে পাকিস্তান ত্যাগ করার নির্দেশ দিয়েছে। আগামী ১ নভেম্বরের মধ্যেই পাকিস্তান ত্যাগ করতে হবে তাদের। সাম্প্রতিক সময়ে আফগান শরণার্থীদের উপর পাকিস্তান সরকারের নির্যাতনের যে অভিযোগ আসছে, পাক সরকারের এই সিদ্ধান্ত সেখানে নতুন সংযোজন।
পাকিস্তান বলছে, যাদের কাছে বৈধ কাগজপত্র পাওয়া যাবে না, তাদেরকে পাকিস্তান ছাড়তে হবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা বৈধ কাগজপত্র থাকার পরেও আফগানদের গ্রেফতার করছে।
৪৫ বছর বয়সী বিবি লায়লা ৪০ বছর ধরে পাকিস্তানে বাস করছেন। সম্প্রতি পাকিস্তানী পুলিশ তার ২৪ বছর বয়সী বড় ছেলে আত্তাউল্লাহকে গ্রেফতার করেছে।
গ্রেফতার হওয়া আফগান শরণার্থীর চাচা কুরবান নাজার বলেন, “তার পরিচয়পত্রের ডকুমেন্ট থাকা সত্ত্বেও পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছে । যদি সে কোনো অপরাধ করে থাকে, তবে তাদের উচিত আইনী প্রক্রিয়া অনুসরণ করা। যদি তার সাথে (পাকিস্তান সরকার প্রদানকৃত) কোনো পরিচয়পত্র না থাকতো, তবে একটা কথা ছিল। আমরা বহু প্রচেষ্টার পর সরকারের কাছ থেকে ডকুমেন্ট পেয়েছি। কিন্তু এভাবে যদি আমাদের গ্রেফতার করা হয়, তবে আমাদের পকেটে থাকা এই ডকুমেন্টের কী মূল্য আছে?”
পাকিস্তান সরকার মানবিকতাবোধ ও নিয়মনীতির কোনো তোয়াক্কা না করে যুদ্ধকালীন সময়ে আশ্রয় নেওয়া আফগানিস্তান শরণার্থীদেরকে নিজ দেশে ফিরে যেতে বাধ্য করছে এবং গ্রেফতার করে নির্যাতন করছে। শরণার্থীদের কাছে কথিত বৈধ কাগজপত্র থাকুক বা না-থাকুক, তাদেরকে আশ্রয় দেওয়া-ই নিয়ম। তার উপর মুসলিমদেরই একটি ভূখণ্ডে মুসলিমরা আশ্রয় নিতে গিয়েছে, এখানে কাটাতারের সীমান্ত বাঁধা হয়ে দাঁড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা বা বৈধতা নেই বলে মনে করেন হক্কানি উলামায়ে কেরাম। বরং সেই ভূখণ্ডের মুসলিমদের উপর আবশ্যক হলো তাদের বিপদগ্রস্ত মুসলিম ভাই-বোনদের সাহায্যার্থে নিজের সামর্থ্যের সবটুকু নিয়ে এগিয়ে আসা। কিন্তু পাকিস্তানের জালিম সরকার এসবকিছুর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।
পাকিস্তানের এমন সিদ্ধান্তের বিষয়ে ইমারতে ইসলামিয়া আফগানিস্তানের নেতৃবৃন্দ তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। ইমারতে ইসলামিয়ার মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ বলেন, আফগান শরণার্থীদের প্রতি পাকিস্তানের আচরণ অগ্রহণযোগ্য। ইসলামাবাদকে তাদের পরিকল্পনা পুনর্বিবেচনা করার আহ্বানও জানান তিনি।
মুজাহিদ বলেন, “আফগান শরণার্থীরা পাকিস্তানের নিরাপত্তার জন্য হুমকিমূলক কোনোকিছুতে জড়িত নন। যতদিন না তারা স্বেচ্ছায় পাকিস্তান ত্যাগ করেন, পাকিস্তানের উচিত তাদেরকে মেনে নেওয়া।”
পাকিস্তানের এমন সিদ্ধান্ত পাক-আফগান রাজনীতিতে নতুন করে উত্তাপ ছড়িয়েছে। দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কে এটি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন ইমারতে ইসলামিয়া আফগানিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মোল্লা মুহাম্মাদ ইয়াকুব মুজাহিদ। তিনি পাকিস্তানের এমন সিদ্ধান্তকে অন্যায় আখ্যায়িত করে এর নিন্দা জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, “এটি একটি অন্যায় ও অনুচিত সিদ্ধান্ত। আফগানদের প্রতি যেসব পাকিস্তানী কর্মকর্তা সন্ত্রাস ও নিষ্ঠুরতা দেখাচ্ছে, তাদেরকে থামাতে আমরা পাকিস্তানি নাগরিক, ধর্মীয় আলেম এবং প্রবীণ রাজনীতিবিদগণের কাছে আবেদন জানাই।”
ইমারতে ইসলামিয়ার পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শের মুহাম্মাদ আব্বাস স্টানিকজাই বলেন, পাকিস্তানের এই সিদ্ধান্ত প্রতিবেশী দেশের আচরণ এবং আন্তর্জাতিক আইনের সীমারেখা লঙ্ঘন করেছে। তিনি পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের আহ্বান জানান আফগানদের বিরুদ্ধে অযথা অভিযোগ উত্থাপন করে দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের ক্ষতি না করতে।
তিনি বলেন, “আমরা আমাদের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করেছি। এই বিষয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা আছে। পাকিস্তান যদি চায়, তবে আমরা তাদেরকে এই সমস্যাগুলো সমাধান করার ব্যাপারে পরামর্শ দিতে পারি।”
আব্বাস স্টানিকজাই আরও বলেন, আফগানরা সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসন থেকে পাকিস্তানকে মুক্ত রেখেছে। যদি মুজাহিদিন যুদ্ধ না করতেন, তবে সোভিয়েত ইউনিয়ন গাওয়াদার (পাকিস্তানের একটি শহর) দখল করে নিতো।
পাকিস্তান সরকার ও কর্মকর্তারা বহুদিন ধরে সুস্পষ্ট প্রমাণ ছাড়া অভিযোগ করছে যে, বিদেশি মদদপুষ্ট পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উপর চালানো হামলা আফগানিস্তান থেকে পরিচালনা করা হয়। ইমারতে ইসলামিয়া আফগানিস্তানের পক্ষ থেকে এমন অভিযোগ বার বার নাকচ করে দেওয়া হয়েছে। তারা পাকিস্তানকে পরামর্শ দিয়েছেন যেন অন্যদেরকে অভিযুক্ত করার বদলে পাকিস্তান নিজেদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার দিকে মনোযোগ দেয়।
পাকিস্তানী বাহিনীগুলোর উপর হামলাকারী তেহরিকে তালেবান পাকিস্তানও আফগানিস্তান থেকে এসে হামলা করার বিষয়টিকে অস্বীকার করেছে। চিত্রালে এক অভিযানের পর জারি করা বিবৃতিতে টিটিপি বলেছে, “চিত্রালে পাকিস্তানের বাহির থেকে হামলা চালানোর কোনো কারণ নেই। অন্য কোনো দেশ থেকে এসে এমনভাবে নিয়মিত ও বড় ধরনের হামলা চালানো সম্ভব নয়।”
এদিকে পাকিস্তান থেকে নতুন করে ফিরে আসা শরণার্থীদের দেখভালের জন্য একটি প্রতিনিধি দল গঠন করেছেন ইমারতে ইসলামিয়া কর্তৃপক্ষ। প্রতিনিধিদল বলেছেন, নানগারহার প্রদেশের লালাপুরে জেলায় একটি নতুন শরণার্থী শিবির গড়ে তোলা হবে। ইতোমধ্যে প্রতিনিধিদলের সদস্যরা সেখানে পৌঁছেছেন।
প্রতিনিধি দলের একজন সদস্য ফজল বারি ফজলি বলেন, “যেসব পরিবারের দায়িত্বভার নারীদের কাঁধে অথবা যাদের কোনো আশ্রয় নেই বা যাদেরকে দেখাশোনা করার মতো কেউ নেই, তাদের যাতায়াতের ব্যবস্থা করা হবে। ইমারতে ইসলামিয়া আফগানিস্তান তাদের জন্য লালপুরে একটি ক্যাম্প তৈরি করতে চায়।”
উল্লেখ্য, অফিসিয়াল পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে জানা যায়, গত দুই বছরে তুরখাম সীমান্তগেট পার হয়ে পাকিস্তান থেকে আফগানিস্তানে ফিরে এসেছেন প্রায় দেড় লক্ষ আফগান শরণার্থী।
তথ্যসূত্র:
1. Islamic Emirate: Pakistan’s Decision to Expel Afghan Refugees ‘Unjust’
– https://tinyurl.com/32xs9ctn
2. Concerns Mount About Pakistani Arrests, Deportations of Afghans
– https://tinyurl.com/bdhavw8y
3. Kabul Reacts to Pakistan’s Forcing Afghan Refugees to Leave
– https://tinyurl.com/3ctm34tf
4. Camp to Be Established for Returning Refugees in Nangarhar
– https://tinyurl.com/38zyxzkc
5. TTP accuses Pakistan Govt of crimes against Afghan migrants
– https://tinyurl.com/mzezpxx