
কাশ্মীর, এক সময় যাকে বলা হতো ভূস্বর্গ, আজ তা যেন পরিণত হয়েছে একটি সশস্ত্র সেনানিবাসে। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) যখন কাশ্মীরের সীমান্তবর্তী গ্রামে সাধারণ মানুষকে একে-৪৭ এবং হ্যান্ড গ্রেনেড চালনার প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেছে, তখন প্রশ্ন উঠেছে—এটি কি সত্যিই আত্মরক্ষার জন্য, নাকি উগ্র হিন্দুত্ববাদী শাসন ও দমন পীড়ন মজবুত করার আরও একটি পদক্ষেপ?
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি সরকার বিগত এক দশকে দেশটিকে একটি উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। ইন্ডিয়ার উপর জেঁকে বসেছে সংখ্যাগরিষ্ঠের উগ্র জাতীয়তাবাদ। কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা বাতিলের মধ্য দিয়ে শুরু হয় আরেক অধ্যায়—একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং জনসংখ্যাগত কাঠামো বদলে দেওয়ার প্রক্রিয়া।
তারই ধারাবাহিকতায় এখন দেখা যাচ্ছে, বিএসএফ ‘গ্রাম প্রতিরক্ষা রক্ষী’ (ভিডিজি) কর্মসূচির নামে সাধারণ মানুষকে অস্ত্র চালাতে শিখাচ্ছে। স্কুল শিক্ষক, পঞ্চায়েত সদস্য, এমনকি কিশোর-কিশোরী—কাউকেই বাদ দেওয়া হচ্ছে না। এটি কেবল একটি প্রতিরক্ষা কর্মসূচি নয়, বরং এক ধরনের মিলিশিয়া গড়ে তোলার সূচনা। এর মাধ্যমে মুসলমানদের ওপর নজরদারি, তথ্য সংগ্রহ, এমনকি ভবিষ্যতে ‘রাষ্ট্রের পক্ষে’ দমননীতিতে অংশ নেওয়ার উপযোগী বাহিনী তৈরি করা হচ্ছে।
ধর্মের নামে ভয়-ভীতির রাজনীতি
ভারতের সাম্প্রতিক ইতিহাস ঘাঁটলেই দেখা যায়, মুসলমানদের প্রতি বিজেপি সরকার ও তাদের অনুগত সংগঠনগুলোর বৈরিতা নতুন কিছু নয়। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA), মুসলিমদের বিরুদ্ধে দাঙ্গায় প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা এবং ক্ষেত্রবিশেষে সহযোগিতা, গরুর মাংস খাওয়ার অভিযোগে পিটিয়ে হত্যা—এসব কাহিনি ক্রমাগত একটি বার্তা দিচ্ছে: ভারতের মুসলমানরা আজ দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হয়েছে, তারা এখন গণহত্যা ও জাতিগত নিধনের হুমকিতে রয়েছে।
কাশ্মীরের অস্ত্র প্রশিক্ষণ এই নীতির আরেক ধাপ। মুখে বলা হচ্ছে আত্মরক্ষা, বাস্তবে এটি মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলে হিন্দু গ্রামবাসীদের সশস্ত্র করে একটি ‘ভয়ভীতির পরিবেশ’ গড়ে তোলার চেষ্টা।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীরবতা
কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা একাধিক আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। কিন্তু ভৌগোলিক, কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক কারণে সেক্যুলার রাষ্ট্রগুলো বিষয়গুলোকে নির্লিপ্ত ভাবে উপভোগ করছে। ভারতের সঙ্গে সামরিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক রক্ষা করতে গিয়ে তারা ভুলে যাচ্ছে, কাশ্মীরে আজ তথাকথিত গণতন্ত্রের নামে যা চলছে, তা একটি নির্মম দমননীতি ছাড়া আর কিছু নয়।
উপসংহার
কাশ্মীরের অস্ত্র প্রশিক্ষণ কর্মসূচি নিছক একটি নিরাপত্তামূলক পদক্ষেপ নয়। এটি হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দর্শনের আরেকটি প্রকাশ, যার মূল লক্ষ্য হলো—মুসলমান জনগোষ্ঠীকে কোণঠাসা করা, দমন করা এবং ভয় দেখিয়ে রাখার মাধ্যমে একটি নিয়ন্ত্রিত সমাজ গঠন করা। মোদি সরকার যদি সত্যিই শান্তি ও নিরাপত্তা চায়, তবে প্রয়োজনে রাজনৈতিক সমাধানের পথ বেছে নিতে হবে, অস্ত্রের নয়। কারণ হিন্দু জনগোষ্ঠীর হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে তা কখনও শান্তি বয়ে আনে না—আনে আরও সংঘাত, আরও বিভাজন, আরও মুসলিমের খুন।