দক্ষিণ ভারতের ব্যাঙ্গালুরু শহরে হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসী পুলিশ ও পৌরসভা কর্তৃপক্ষ মিলে ‘অবৈধ বাংলাদেশিদের বস্তি’ সন্দেহে প্রায় শ দুয়েক বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দিয়েছে। তবে প্রতিবাদকারীরা বলছেন, পুলিশ এই উচ্ছেদ অভিযানে যাদের বাড়িঘর ভেঙে দিয়েছে তারা সকলেই ভারতের নাগরিক এবং তাদের কাছে এদেশের বৈধ পরিচয়পত্রও আছে।
তাদের আরো অভিযোগ, শহরের বিজেপি বিধায়ক অরবিন্দ লিম্বাভালি-ই সোশ্যাল মিডিয়াতে তথাকথিত অবৈধ বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে লাগাতার উসকানিমূলক পোস্ট করে চলেছেন। আর তার ভিত্তিতেই সন্ত্রাসী পুলিশ বাংলাভাষী মুসলিমদের বিরুদ্ধে নির্বিচারে এই অভিযান শুরু করেছে।
ব্যাঙ্গালুরুর বেলান্ডার শহরতলিসহ আরো কয়েকটি জায়গায় তথাকথিত অবৈধ বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে এই অভিযান শুরু হয় শনিবার রাতে, দফায় দফায় তা চলতে থাকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টা ধরে।
শহরের একটি এনজিওকর্মী কলিমুল্লা বিবিসি বাংলাকে বলেন, কুন্দনহাল্লি, মোনেকালাসহ মোট চারটি জায়গায় একসঙ্গে বুলডোজার নিয়ে পুলিশ হানা দেয়।
কলিমুল্লা বলেন, বাংলাদেশীদের দু’ঘণ্টার মধ্যে ঘর খালি করে দিতে হবে। আমি ও আমাদের টিম তাদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে কোনো লাভ হয়নি। পুলিশ ঘরে ঢুকে খাবার পানির পাত্রও লাথি মেরে উল্টে দেয়, কেটে দেয় বিদ্যুৎ সংযোগ। সঙ্গে চলতে থাকে বাংলাদেশিদের নামে গালাগালি।
স্থানীয় একটি টিভি চ্যানেল সুবর্ণা নিউজেও দাবি করা হতে থাকে তাদের স্টিং অপারেশনেই ফাঁস হয়েছে যে ওই বস্তির বাসিন্দারা বাংলাদেশি। ওই চ্যানেলটি বলে, পুলিশকে ঘুষ দিয়েই তারা ভারতের কাগজপত্র বানিয়েছে, এটা প্রকাশ হওয়াতেই না কি পুলিশ সেখানে অভিযান চালায়।
এদিকে, ব্যাঙ্গালুরুর পুলিশ কমিশনার ভাস্কর রাও যদিও দাবি করেছেন নির্দিষ্ট খবরের ভিত্তিতেই তারা ব্যবস্থা নিয়েছেন, আইনজীবী ও সমাজকর্মী দর্শনা মিত্র কিন্তু বিবিসিকে অন্য ছবিই তুলে ধরলেন।
দর্শনা মিত্র বলেন, আসলে ব্যাঙ্গালোরের অর্থনীতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মারাথাল্লিসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রচুর নতুন ফ্ল্যাট তৈরি হয়েছে। অনেক অফিস গড়ে উঠেছে। ফলে ইনফর্মাল সেক্টরে গৃহকর্মী, আবাসন খাতের শ্রমিক, স্বুলবাসের চালক- এরকম অসংখ্য কাজের সুযোগও সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা থেকে দলে দলে লোকজন সেখানে যাচ্ছেনও। এদের মধ্যে প্রচুর লোকই বাঙালি, আর মাইগ্রেশন প্যাটার্নটা স্টাডি করলেই দেখা যাবে এরা বেশিরভাগই গেছেন পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া, মালদা, মুর্শিদাবাদের মতো মুসলিম অধ্যুষিত জেলাগুলো থেকে। এখন বাঙালি মুসলিমদের মধ্যে কে পশ্চিমবঙ্গের বা কে বাংলাদেশি, কর্নাটকের পুলিশ বা একজন কান্নাডিগা আপাতদৃষ্টিতে সেই ফারাক যেহেতু করতে পারছে না, তাই তাদের অ্যাপ্রোচাটাই হলো, মুসলিম হলেই তাদের বাংলাদেশি বলে চালিয়ে দাও।
এখানে কোনো বাছবিচারের ব্যাপারই নেই। এবারের ঘটনায় লোকজন তো তাদের পরিচয়পত্র বা আইডি প্রুফ দেখাতেও চেয়েছিল, কিন্তু ব্যাঙ্গালোর পুলিশ তা চেক করারও প্রয়োজন বোধ করেনি, বলেন দর্শনা মিত্র।
এদিকে শনি ও রবিবারের এই বস্তি ভাঙচুরের পেছনে অনেকেই তুলে ধরছেন গত সপ্তাহে টুইটারে শাসক দল হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসী বিজেপি’র অত্যন্ত প্রভাবশালী বিধায়ক ও কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা অরবিন্দ লিম্বাভালির একগুচ্ছ পোস্টকে।
লিম্বাভালির পোস্ট করা একটি ভিডিওতে শহরের একটি বস্তিকে দেখিয়ে দাবি করা হয়, ওটাই না কি ব্যাঙ্গালোরে ‘অবৈধ বাংলাদেশিদের মূল কেন্দ্র’। পোস্টে বলা হয়, সেখানে তাদের আলাদা রাস্তা আছে। মাসে পাঁচ থেকে আট হাজার রুপিতে বস্তিতে ঘরভাড়া নিয়ে থাকছে তারা। আলাদা বিদ্যুৎ সংযোগ, জলের লাইন, নিজস্ব দোকানপাটও বানিয়ে নিয়েছে।
ভিডিওটিতে আরো বলা হয়, রোজই সেখানে তারা নতুন লোকজনও নিয়ে আসছে, বাংলাদেশিদের রমরমা বেড়েই চলেছে।
এই পোস্টের পর সাতদিনও যেতে না যেতেই ঠিক সেই বস্তিটিই মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে ব্যাঙ্গালোর সন্ত্রাসী পুলিশ।
প্রতিবাদকারী জকি সোমান বিবিসিকে বলছিলেন, সন্ত্রাসী বিজেপির ওই বিধায়ক গত তিন বছর ধরেই এই একই জিনিস করে আসছে, অভিবাসী শ্রমিকদের বাংলাদেশি বলে তাদের তাড়ানোর জিগির তুলছে। ভারতের বৈধ নাগরিকদের এভাবে অপমান করার জন্য তার বিরুদ্ধে আমরা এখন মানহানির মামলাও করতে যাচ্ছি।
ভারতে জাতীয় নাগরিকপঞ্জী বা এনআরসি তৈরির নামে মুসলিমরা যে হয়রানি ও ভোগান্তির আশঙ্কা করছেন, ব্যাঙ্গালোরে তা এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে বলেও এই সমাজকর্মীদের বক্তব্য।
সূত্র: বিবিসি বাংলা