মাশরুফ সুলতান : কাশ্মীরি ছাত্রদের টার্গেট কিলিং মিশনের এক টুকরো বাস্তবতা

3
1904
মাশরুফ সুলতান : কাশ্মীরি ছাত্রদের টার্গেট কিলিং মিশনের এক টুকরো বাস্তবতা

ভারত দখলকৃত কাশ্মীরে ছাত্ররা হচ্ছে ভারতীয় সেনাদের অন্যতম টার্গেট। কারণ তারা জানে যে, আজ হোক কিংবা কাল, এই মেধাবি ছাত্ররা একে একে সকলেই হিন্দুত্ববাদীদের পড়িয়ে দেওয়া কথিত ‘অসাম্প্রদায়িকতার’ ছেলে ভুলানো চশমা একেবারে খুলে ফেলবে। তখন তাঁরা বাস্তবতাকে একবারে নিরপেক্ষে দৃষ্টি দিয়ে দেখবে; আর তখন তারা সকলেই হয়তো কাশ্মীরকে মুক্ত করতে দখলদার ভারতের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নিজেদের নিয়োজিত করবে।

কাশ্মীরি ছাত্রদের টার্গেট কিলিং করার একটি ঘটনা ঘটেছিলো ২০ বছর বয়সী এক যুবকের সাথে। সেদিন দুপুরে সে হেঁটে হেঁটে স্কুলে যাচ্ছিলো। ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি ট্রাক তখন তাঁর সামনে দিয়ে যাচ্ছিলো। তাদের হাতে ছিলো মেশিন গান। ট্রাকটি তাঁর সামনে থামানো হয় এবং সেনারা তাঁকে তাদের দিকে তাকানোর নির্দেশ দেয়। ছেলেটি তাদের দিকে তাকাতেই তাঁর গলা বরাবর গুলি করে দেয় সেনারা। পরে তাঁকে সেখানে রেখেই চলে যায় তারা।

স্থানীয়রা তাঁকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানের একজন ডাক্তার ছেলেটির ব্যপারে বিবৃতি দেয় এমন যে ‘বুলেটটি যুবকের শ্বাসনালী এবং খাদ্যনালী ভেদ করে অবশেষে তার মেরুদণ্ডকে ভেঙ্গে দিয়েছে’। সুদর্শন সেই কাশ্মীরি যুবকটি কথা বলতে অক্ষম ছিলো। ডাক্তারটি সেই একটি বুলেটের প্রভাব বর্ণনা করতে থাকে- ” ছেলেটি খেতে পারে না, শ্বাস নিতে পারে না, এমনকি নড়াচড়াও করতে পারে না এবং সে এখন শুধুই মৃত্যুর জন্য অপেক্ষমাণ।” ছেলেটির পরিণতির ব্যপারে সেই ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করা হলে তাঁর উত্তর ছিলো- “সে খুব দ্রুতই মারা যাবে”। দুর্ভাগ্যবশত, সেই নিষ্পাপ ছেলেটি তার কয়েক দিন পরেই মারা যায়।

উনিশ বছর বয়সী (তৎকালীন বয়স) মাশরুফ সুলতান তাঁর শরীরের ক্ষত দেখানোর জন্য নিজের শার্ট খুলে রাখে। তাঁর শরীরে ছিলো দশটি বুলেটের আঘাত এবং সেই সাথে বৈদ্যুতিক শকের ক্ষত। ডাক্তারি রিপোর্টে বলা হয় যে তাঁর ডান উরু, বাম উরু, উভয় হাত, ঘাড়, বুক ও মাথায় গুলির আঘাত লেগেছে। এরপরেও তিনি বেঁচে গেছেন। এবং সেটা অবশ্যই তাদের জন্য লজ্জাজনক- যারা এমনটি তাঁর সাথে করেছে।

তিনি ছিলেন ভীত। কারণ তিনি মনে করছিলেন যে, ভারতীয় সৈন্যরা হয়তো তাদের অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করতে আবার আসবে। সুলতানের গল্প কাশ্মীরে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর কৌশল সম্পর্কে অনেক কিছুরই ইঙ্গিত দেয়।

কিন্তু ভারতীয় সেনাদের অফিশিয়াল বিবৃতি ছিলো ভিন্ন। তাদের বিবৃতি ছিলো যে, সুলতান ক্রসফায়ারের শিকার হয়েছেন। কিন্তু যে কোনও সুস্থ মস্তিষ্কের ব্যক্তিই সুলতানের শরীরের ক্ষত চিহ্নগুলো দেখে বলতে পারবে যে, সেটি কোন ক্রসফায়ার ছিলো না। বরং সেটি ছিলো একটি অমানবিক নির্যাতন।

সুলতানের ভাষ্য ছিলো যে, তাঁকে বিএসএফের লোকেরা একটি গাছের সাথে বেঁধে তাঁর ওপর গুলি চালায়। তিনি বলেন, তাঁকে যখনই জীবিত অবস্থায় দেখা যাচ্ছিলো, তখনই তাঁর ওপর গুলি চালানো হচ্ছিলো এবং তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত তারা এমন গুলি চালাতে থাকে।
“আমার মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে কিনা তা জানার জন্য একজন অফিসার আমার মুখে হাত রাখে। আমি নিঃশ্বাস ধরে রাখি। তখন আমি আধা সচেতন ছিলাম”- বলছিলেন সুলতান।

ডাক্তার বলছিলেন যে ইতোমধ্যেই তাঁর চারটি অপারেশন করা হয়েছে এবং আরও দুটি অপারেশন বাকী আছে। জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাঁকে লাঠি দিয়ে পেটানো হয় যার কারণে তাঁর উরু ভেঙ্গে গিয়েছে এবং তাঁর হাঁটুতে প্রচন্ড আঘাত লেগেছে। যার দরুন তিনি এখন হাঁটতে পারছেন না। তাঁর রিপোর্ট দেখে ডাক্তার বলেন যে তিনি ‘সারাজীবনের জন্য পঙ্গু’ হয়ে গিয়েছেন।

তিনি ছিলেন বিজ্ঞানের একজন ছাত্র। কিন্তু সেনারা তাঁকে বাস থেকে নামানোর সময় ‘জঙ্গি’ ট্যাগ দেয় এবং জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁকে আলাদা জায়গায় নিয়ে যায়। কারণ শ্রীনগর থেকে ফেরার সময় তাঁকে জঙ্গি সন্দেহ করা হয়। যদিও তাঁকে “বিড়ালরা” (কাশ্মীরে ভারতীয় গোয়েন্দাদের হয়ে কাজ করে যারা তাদের ইংরেজীতে ‘ক্যাট্স’ নামে ডাকা হয়) জঙ্গি হিসেবে চিহ্নিত করেনি। তাদেরকে ‘বিড়াল’ নামে অভিহিত করা হয় কারণ তাদের সারা শরীর ঢাকা থাকে এবং শুধু তাদের দুই চোখ দেখা যায়।

জম্মু ও কাশ্মীরের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি এবং বর্তমানে একজন মানবাধিকার কর্মী হিসেবে কর্মরত মুফতি বাহাউদ্দিন ফারুকী বলেন যে- “এই বিড়ালদের হাতে জীবন এবং মৃত্যুর শক্তি আছে” (আস্তাগফিরুল্লাহ্)। তিনি আরও বলেন, “সে শুধুমাত্র তার আঙ্গুলের ইশারায় যাকে ইচ্ছা তাকেই গ্রেপ্তার কিংবা হত্যা করাতে পারে”। এই ‘বিড়ালরা’ সাধারণত হুমকি কিংবা নির্যাতনের কারণে এমন তথ্যদানকারী হিসেবে কাজ করে থাকে। তবে এও সত্যি যে, তাদের কিছু কিছু টাকার জন্যেও কাজ করে।

সুলতানের জীবন বদলে যায় চিরতরে। বাস থেকে নামানোর কয়েক ঘন্টা পর তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। সুলতান বলেন, “সেই কক্ষের উপরে একটি বড় দড়ি ঝুলানো ছিলো। একটি বড় রোলার ছিলো, যেটি সাধারণত মানুষের শরীরের ওপর চালানো হয়। এবং কাশ্মীরে ভারতীয় সেনাদের কাছে মুসলিমদের নির্যাতনের জন্য এটি খুবই ‘জনপ্রিয়’ একটি জিনিস। আরো ছিলো একটি যন্ত্র- যা বৈদ্যুতিক শকের জন্য ব্যবহৃত হতো। সুলতান বলেন যে, খোলা তারগুলি তাঁর লিঙ্গ এবং দুই পায়ের বড় আঙ্গুলের সাথে সংযুক্ত ছিল, আর তাঁর উপর ক্রমাগত পানি নিক্ষেপ করা হচ্ছিলো।

সুলতান বলেন- “আমাকে তিনবার শক দেওয়া হয়। আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। আমার নাক-মুখ থেকে রক্ত বের হতে থাকে। তারা লাঠি দিয়ে আমার হাঁটুতে মারতে থাকে”। নির্যাতনের পর তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) কর্তৃক ব্যবহৃত একটি ভবনের বাইরে নিয়ে তাঁকে গুলি করা হয়।

সেই ৯০-এর দশক থেকে আজ পর্যন্ত, কাশ্মীরের কোন যুবকই নিরাপত্তা বাহিনীর (বিএসএফ) হাত থেকে নিরাপদ নয়। যার কারণে তাদের অনেকেই কাশ্মীরের পাকিস্তান অংশে শরণার্থী শিবিরে বাস করে।

তাই, শিশু থেকে বৃদ্ধ- আজ কাশ্মীর ভ্যালীতে বসবাসকারী সকলেরই অভিপ্রায় “আজাদি”, “একটি স্বাধীন কাশ্মীর”।


ক্রিস্টোফার থমাসের প্রবন্ধ থেকে
দ্যা টাইমস, লন্ডন, ১০ আগস্ট, ১৯৯৩


অনুবাদক :   আবু উবায়দা

3 মন্তব্যসমূহ

  1. জুলুমের এক লোমহর্ষক কাহিনী, আল্লাহ এই জালিমদের মোজাহিদ দের পদপিষ্ট করে ধ্বংস করবেন ইনশাল্লাহ।।

    হে আহলে কাশমির! তুমাদের ভাইয়েরা তুমাদের ভুলে যায়নি, এইত্ত খুব দ্রুত দেখা হচ্ছে … মুশরিকদের পাওনা বুঝিয়ে দিতে আমরা ছুটে আসছি দাবানলের ন্যায়-ইনশাল্লাহ।

    একটু ধৈর্য ধরো…

  2. জুলুমের এক লোমহর্ষক কাহিনী, আল্লাহ এই জালিমদের মোজাহিদ দের পদপিষ্ট করে ধ্বংস করবেন ইনশাল্লাহ।।

    হে আহলে কাশমির! তুমাদের ভাইয়েরা তুমাদের ভুলে যায়নি, এইত্ত খুব দ্রুত দেখা হচ্ছে … মুশরিকদের পাওনা বুঝিয়ে দিতে আমরা ছুটে আসছি দাবানলের ন্যায়-ইনশাল্লাহ।

    একটু ধৈর্য ধরো…

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধএবার আশ-শাবাবকে রুখতে মোগাদিশু সরকারকে সামরিক সহায়তা দিল চীন
পরবর্তী নিবন্ধদেশে দেশে ইসলাম বিদ্বেষ | শুধু মুসলিমরা চলাচল করায় বন্ধ করে দেয়া হলো শতবর্ষী পুরাতন সড়ক