নাইজার: প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ দেশটি কেন এত গরীব?

0
734

পশ্চিম আফ্রিকার একটি স্থলবেষ্টিত দেশ নাইজার। দেশটির প্রায় ৮০% ভূমি সাহারার তপ্ত মরু। তবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই দেশটি প্রাকৃতিক সম্পদের আধার। এখানে একদিকে যেমন আছে কৃষি শস্য ও প্রাণী সম্পদের প্রাচুর্য, তেমনি আছে ইউরেনিয়াম, স্বর্ণ, কয়লা এবং তেলের মতো মহা মূল্যবান খনিজ সম্পদ। এসব শুনে মনে হতে পারে দেশটি অনেক ধনী হবে হয়তো। কিন্তু, তিক্ত বাস্তবতা হচ্ছে, বিশ্বের গরীব দেশগুলোর তালিকায় শুরুর দিকেই আছে নাইজারের নাম। আইএমএফের তথ্যের ভিত্তিতে সবচেয়ে গরীব দেশগুলোর তালিকায় নাইজারকে রাখা হয়েছে সাতে। ২০২১ সালের তথ্য মতে, দেশটির ৪১.৮% মানুষ চরম দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করে। কিন্তু কেনো? এত সম্পদ থাকতেও কেনো তারা গরীব?

দখলদার ফরাসি আগ্রাসন

ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে নাইজারে আগ্রাসন চালায় ফরাসি বাহিনী। প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে নাইজারে দখলদারিত্ব চলে সাম্রাজ্যবাদী ফ্রান্সের। ১৯৬০ সালে ফ্রান্স থেকে স্বাধীনতা পায় দেশটি। কিন্তু প্রকৃত স্বাধীনতা অধরাই থেকে যায়। নাইজারের নামের পাশে স্বাধীন দেশ অভিধাটি যুক্ত হলেও, দখলদার ফ্রান্সের কবল থেকে প্রকৃত স্বাধীনতা মেলেনি তাদের। স্বাধীনতা লাভের পরও ফরাসি ভাষা থেকে যায় নাইজারের অফিসিয়াল ভাষা হিসেবে। ফরাসি সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদও দূর করা যায়নি দেশটি থেকে।

এমনকি নাইজারের ক্ষমতায় যারা এসেছে, সবাই-ই থেকেছে ফ্রান্সের আজ্ঞাবহ হিসেবে। নাইজারের এসব শাসকদের কাছে দেশের মানুষের স্বার্থের চেয়ে ফরাসিদের স্বার্থ বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। আর এ কারণেই প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ হওয়ার পরও নাইজারের মুসলিমরা রয়ে গেছে বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর তালিকায়। তাদের ইউরেনিয়াম-স্বর্ণ নিয়ে ফ্রান্সের উন্নয়ন হয়েছে, ফ্রান্সের ঘরে ঘরে আলো জ্বলছে, আর এদিকে না খেয়ে রয়েছে নাইজারের জনগণ, অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছে তাদের ঘরগুলো।

ওয়ার্ল্ড নিউক্লিয়ার অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য মতে, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ইউরেনিয়াম উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে নাইজার ৭ম; অনেকে ৪র্থও বলে থাকেন। নিউক্লিয়ার এনার্জি তৈরিতে ব্যবহৃত হয় এই মূল্যবান ইউরেনিয়াম। ফ্রান্সের ৭০% বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয় নিউক্লিয়ার এনার্জি থেকে। আর ফ্রান্সের নিউক্লিয়ার এনার্জির সিংহভাগ নাইজারের ইউরেনিয়ামের উপর নির্ভরশীল। সাম্রাজ্যবাদী ফ্রান্স নাইজার থেকে এই মূল্যবান ইউরেনিয়াম নামমাত্র মূল্যে নিয়ে যায়, সেটাও আবার নিজস্ব মুদ্রায়, মার্কিন ডলারে নয়। কেমন যেন ইউরেনিয়াম নাইজারে উৎপন্ন একটি ফরাসি শিল্প! ফ্রান্স এমনভাবেই নাইজারের এই প্রাকৃতিক সম্পদকে একচেটিয়াভাবে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে যাচ্ছে।

নাইজারিয়ান নেটওয়ার্ক অব অরগানাইজেশনস ফর বাজেট ট্রান্সপারেন্সি অ্যান্ড অ্যানালাইসিসের আলি ইদরিসসা নামের একজন সদস্য বলেন, “এখানে আসলে কোনো সমান-সমান অংশীদারিত্ব নেই। ইউরেনিয়াম খনন থেকে নাইজার কোনো উপকার পায়নি।”

নাইজারিয়ান বিশেষজ্ঞ টিচিরোমা আইসামি মামাদু বলেন, “ইউরেনিয়াম আমাদের জন্য কেবল ঊষরতা (প্রকৃতির ধ্বংস) নিয়ে এসেছে, আর সব লাভ চলে গিয়েছে ফ্রান্সে।”

সাম্প্রতিক সেনা অভ্যুত্থান

সাম্রাজ্যবাদী ফ্রান্সের নানা জুলুমে অতিষ্ঠ নাইজারের জনগণ। ফ্রান্সবিরোধী মনোভাব তাদের হৃদয়ে প্রোথিত। আর জনসাধারণের এমন মনোভাবকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে ব্যস্ত আরেকটি দল। গত ২৬শে জুলাই এক সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এই দলটি পশ্চিমাপন্থী রাষ্ট্রপতি মুহামেদ বাজুমকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে নিজেরা ক্ষমতায় আসে। ক্ষমতায় এসেই তারা আবার রাশিয়ার ভাড়াটে বাহিনী ওয়াগনারকে নাইজারে আমন্ত্রণ জানায়।

এই ওয়াগনার বাহিনী পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালিতে দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ মুসলিমদের হত্যা করছে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, আগস্টের প্রথম সপ্তাহেও ওয়াগনার বাহিনী দেশের মধ্যাঞ্চলের কৌলিকোরো প্রদেশের ৭টি গ্রামে বর্বরোচিত হামলা চালিয়েছে। ভাড়াটে বাহিনী ওয়াগনারের বর্বরোচিত এই হামলায় কমপক্ষে ৩৬ জন নিহত হয়েছেন এবং আরও কয়েক ডজন বেসামরিক লোক আহত হয়েছেন। এছাড়াও ৪০ জনেরও বেশি বেসামরিক লোককে আটক করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

অ্যাসিলেড (ACLED- The Armed Conflict Location & Event Data Project)-এর তথ্যানুযায়ী, ২০২২ সালে ওয়াগনার গ্রুপের চালানো হামলায় মালিতে অন্তত ৭২৫জন সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক হামলাটি চালানো হয়েছিল ২০২২ সালের মার্চে। সপ্তাহব্যাপী চালানো ঐ হামলায় নিহত হয়েছিলেন প্রায় ৩০০ জন সাধারণ মানুষ।

এই ভাড়াটে খুনি বাহিনী সাধারণ মুসলিমদের হত্যা করার বিনিময়ে মালির সরকারের কাছ থেকে নেয় মাসিক ১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

রাশিয়ান এই মিলিশিয়া বাহিনী যেখানেই গেছে, তাদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যবস্তু হয়েছে জনসাধারণ। তারা সাধারণ মানুষকে হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ করেছে। আর মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত এই রাশিয়ান ভাড়াটে বাহিনীকেই নাইজারের সদ্য ক্ষমতাসীন জান্তা সরকার দেশটিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। এতদিন ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্র নাইজারের মানুষের উপর জুলুম করতো, এখন রাশিয়ান ভাড়াটে সেনারা জুলুম করবে।

পশ্চিমাদের স্বার্থ ও দ্বিচারিতা

নাইজারে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হয় পশ্চিমাদের অনুগত রাষ্ট্রপতি মুহামেদ বাজুম। সদ্য ক্ষমতায় আসা জান্তা সরকার ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে রাশিয়াকে প্রাধান্য বিস্তারের সুযোগ দিচ্ছে নাইজারে। এর ফলে নাইজারে নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষিত রাখতে তৎপর হচ্ছে ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট।

নাইজার এতদিন কার্যত ফ্রান্সের অনুগত একটি নামমাত্র স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল। আর এখানকার প্রাকৃতিক সম্পদগুলো ব্যবহার করতো ফ্রান্স। এদিকে, আফ্রিকায় অপারেশন পরিচালনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সর্ববৃহৎ ড্রোন ঘাঁটি নির্মাণ করা হয়েছে নাইজারে। ১০০ মিলিয়ন ডলারের অধিক মূল্যে নির্মিত এই ঘাঁটিটি ২০১৮ সাল থেকে আফ্রিকান দেশগুলোতে অপারেশন পরিচালনার জন্য ব্যবহার করছে যুক্তরাষ্ট্র। নাইজারে জান্তা সরকারের আগমনে যুক্তরাষ্ট্রের এই গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটিটি হুমকির মুখে পড়েছে।

এছাড়া, নাইজারে ফ্রান্সের প্রায় ১৫০০ ও যুক্তরাষ্ট্রের ১১০০ সেনাও মোতায়েন রয়েছে। জান্তা সরকারের পক্ষ থেকে সেনা সরিয়ে নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। এমনকি ফরাসি দূতাবাসে হামলাও করেছে বিক্ষুব্ধ জনগণ।

এমন পরিস্থিতিতে পশ্চিমা বাহিনী নিজেদের স্বার্থ রক্ষার্থে নাইজারে সামরিক আগ্রাসন চালানোর হুমকি দিয়েছে। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাঁখো এর আগে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রাশিয়াকে বলেছিল, “এখন যুদ্ধের যুগ নয়।” কিন্তু নিজের এই নীতিবাক্য আজ ভুলে গিয়ে নাইজারে সামরিক হস্তক্ষেপ করতে চাচ্ছে ম্যাঁখো।

পশ্চিমাপন্থী আফ্রিকান জোট ইকোয়াস (ECOWAS) কথিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে নাইজারে হামলা চালানোর হুমকি দিয়েছে। যদিও ইকোয়াসের সদস্য কয়েকটি রাষ্ট্র এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছে। মালি ও বুর্কিনা ফাসো ঘোষণা করেছে যে, নাইজারের ওপর যেকোনো আক্রমণকে তারা তাদের নিজেদের ওপর যুদ্ধ ঘোষণা হিসেবে বিবেচনা করবে। নাইজারের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র চাদ ফ্রান্সের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ মিত্র। কিন্তু চাদও ঘোষণা করে যে, তারা নাইজারে ইকোওয়াসের সামরিক হস্তক্ষেপকে সমর্থন করবে না।

তবে ইকোওয়াসের বর্তমান সভাপতি নাইজেরীয় রাষ্ট্রপতি বোলা তিনুবু একজন পশ্চিমাপন্থী রাজনীতিবিদ। এ কারণেই নাইজারের অভ্যুত্থানের প্রতি নাইজেরিয়া ও ইকোওয়াসের পক্ষ থেকে তীব্র নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়েছে বলে মনে করা হয়। তদুপরি, নাইজেরিয়া ও নাইজারের মধ্য দিয়ে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত ট্রান্স-সাহারান গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। উক্ত পাইপলাইনটি নির্মিত হলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার ওপর তাদের জ্বালানি নির্ভরশীলতা কমাতে পারবে। কিন্তু নাইজারে সংঘটিত অভ্যুত্থানের ফলে উক্ত পাইপলাইন নির্মাণের সম্ভাবনা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। এ কারণেও পশ্চিমা মদতপুষ্ট নাইজেরিয়ান প্রশাসন এই অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে।

এদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স নাইজারে ইকোওয়াসের সামরিক হস্তক্ষেপের প্রতি তাদের সমর্থন ঘোষণা করেছে, কিন্তু রাশিয়া এর বিরোধিতা করছে। অবশ্য সদস্য রাষ্ট্রগুলোর বিরোধিতার কারণে এখন পর্যন্ত ইকোয়াস নাইজারে সামরিক আক্রমণ চালাতে পারেনি।

তবে এভাবেই পশ্চিমা ও তাদের মিত্র শক্তি এবং রাশিয়াপন্থীরা মুসলিমদের সম্পদগুলো নিজেদের মাঝে ভাগবাটোয়ারা করতে ব্যস্ত। আর তাদের নিজেদের স্বার্থোদ্ধারের লড়াইয়ে বিধ্বস্ত হচ্ছে মুসলিম অধ্যুষিত নাইজার। পশ্চিমাদের উনুনে আগুন জ্বলছে মুসলিমদের জ্বালানি নিয়ে, আর এদিকে মুসলিমদের ঘরগুলো পুড়ছে পশ্চিমাদের ফেলা বোমার আঘাতে।


তথ্যসূত্র:

1. The 15 Poorest Countries in the World – https://tinyurl.com/2s3ejw6x
2. How Important is Niger’s Uranium For France? – https://tinyurl.com/mry35acz
3. Uranium-rich Niger struggles despite nuclear resurgence – https://tinyurl.com/4cmhhfdf
4. Lavrov in Africa: Have Wagner mercenaries helped Mali’s fight against jihadists? – https://tinyurl.com/u7ha98tt
5. Wagner Group Operations in Africa: Civilian Targeting Trends in the Central African Republic and Mali – https://tinyurl.com/3jr5r4h9
6. Ukraine invasion: Macron and US cite Modi’s ‘not era of war’ remark to Putin | India News – https://tinyurl.com/bdhm995c
7. How the US and France created a Niger mess for themselves – https://tinyurl.com/7psx9pzh
8. নাইজার সঙ্কট: পশ্চিম আফ্রিকায় আঞ্চলিক যুদ্ধের সম্ভাবনা? – https://tinyurl.com/3ramc7h6

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধশাবাবকে নির্মূলের ঘোষণা দিয়ে ৩ দিনে ৮ শহর হাতছাড়া সোমালি সরকারের
পরবর্তী নিবন্ধফটো রিপোর্ট || শাবাবের সুইপিং অপারেশনে ২০০ সোমালি সেনা নিহত