মাওলানা আতাহার আলী (রহ.): উপমহাদেশের ইসলামী সংগ্রামের এক অনবদ্য নাম

0
462

উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম দ্বীন মাওলানা আতহার আলী রহমাতুল্লাহি আলাইহি ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ১৩০৯ হিজরিতে সিলেটের বিয়ানীবাজার থানার গোঙ্গাদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কথিত আছে, তাঁর পূর্ব পুরুষগণ উত্তর ইরান থেকে প্রাচীন মুসলিম শাসকদের আমলে সিলেটে এসে বসবাস শুরু করেন। রাজনৈতিক জীবনে তিনি নেজামে ইসলাম পার্টির সাবেক সভাপতি ছিলেন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন এবং আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলন ছাড়াও তিনি তৎকালীন প্রতিটি জাতীয় সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছেন। সিলেট অঞ্চলকে পাকিস্তানভুক্ত করার পেছনেও তাঁর ভূমিকা ছিল অপরিসীম।

আজ মহান এই আকাবিরে দ্বীনের মহান কর্মময় জীবনের সংক্ষিপ্ত চিত্র আল-ফিরদাউসের পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি।

উন্নত শিক্ষাজীবন

মাওলানা আতাহার আলী (রহ.) নিজ এলাকাতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করার পর মুরাদাবাদের কাসেমিয়া মাদরাসায় ও রামপুর মাদরাসায় বিভিন্ন শাস্ত্রে জ্ঞান অর্জন করেন। এরপর সাহারানপুর মাদরাসা এবং পরবর্তীতে উম্মুল মাদারিস দারুল উলুম দেওবন্দে অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে সর্বোচ্চ লেখাপড়া শেষ করেন। তার উস্তাদদের মধ্যে ছিলেন আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরি (রহ.)-সহ পাকিস্তানের অন্যতম প্রবক্তা মাওলানা শাব্বির আহমাদ উসমানি (রহ.) ও জাফর আহমাদ উসমানি (রহ.) এর মতো বিখ্যাত আলেমে দ্বীন ও মনিষীগণ।

উস্তাদদের প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধার কিছুটা প্রকাশ পায় স্বীয় পুত্রের নাম আনোয়ার শাহ্‌ রাখার মাধ্যমে, যিনি নিজেও পরবর্তীতে বাবার আদর্শের অনুসরণে দেশের একজন স্বনামধন্য আলেমে দ্বীন হয়ে উঠেন। আর নিজ দাদাপীর হাজী এমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কি (রহ.)-এর নামে আতাহার আলী (রহ.) তাঁর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামকরণ করেন জামিয়া ইমদাদিয়া।

এছাড়াও লেখাপড়া শেষ করে আতহার আলী (রহ.) আত্মশুদ্ধির জন্য উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলামি সংস্কারক, আধ্যাত্মিক সাধক ও হাজারোর্ধ্ব গ্রন্থের প্রণেতা হাকিমুল উম্মাহ্‌ মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ.)-এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন। তাঁর সান্নিধ্যে থেকে কঠোর মুজাহাদার মাধ্যমে অল্প সময়েই খেলাফত লাভ করেন মাওলানা আতাহার আলী (রহ.)।

বর্ণাঢ্য কর্মজীবন

হাকিমুল উম্মাহ্‌ মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ.)-এর নির্দেশে ইসলামি তাহজিব-তামাদ্দুন ও শিক্ষা বিস্তারের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি সিলেট এবং কুমিল্লার জামিয়া মিল্লিয়া (বর্তমানে কাসেমুল উলূম), ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জামিয়া ইউনুসিয়াসহ একাধিক মাদরাসায় শিক্ষকতা করেন। তিনি কিশোরগঞ্জের একটি মাদরাসায়ও শিক্ষকতা করেন এবং কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক শহীদী মসজিদের ইমাম হিসেবেও নিযুক্ত ছিলেন। পাশাপাশি একজন ধর্মীয় আধ্যাত্মিক রাহাবার হিসাবে ইসলামের যাবতীয় শিক্ষা ও আদর্শ প্রচারে নিরলস কাজ করে গেছেন।

সংগ্রামী রাজনৈতিক জীবন

আতহার আলী (রহ.) নিজ শিক্ষাজীবনে যেসকল মহামনীষীর সংস্পর্শে এসেছিলেন, তাঁরা সকলেই ইসলামি জ্ঞানে বিশেষজ্ঞ ও উঁচু স্তরের ব্যক্তিত্ব হওয়ার পাশাপাশি বিশ্ব পরিস্থিতির ব্যাপারেও সচেতন জ্ঞান রাখতেন। পাশাপাশি, ইংরেজবিরোধী আন্দোলনে ও রাজনীতিতেও তাঁরা ছিলেন সক্রিয়। তাঁর উস্তাদদের মধ্যে শাব্বির আহমাদ উসমানি, জাফর আহমাদ উসমানি, আনোয়ার শাহ কাশ্মীরি এবং আধ্যাত্মিক গুরু আশরাফ আলি থানভি (রহ.) অবিভক্ত ভারতের আজাদি আন্দোলনের ত্যাগী ও সংগ্রামী সিপাহসালার ছিলেন। মহান এই শিক্ষকদের প্রভাবে হমাওলানা আতহার আলীর মধ্যেও ছাত্রজীবন থেকেই রাজনৈতিক ভাবধারা ও সচেতনতার উন্মেষ ঘটেছিল।

কর্ম জীবনের শুরুতে শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি ইসলামি আন্দোলন তথা রাজনীতির ভিত্তি নির্মাণে আত্মনিয়োগ করেন। পাশাপাশি মানুষকে নসিহতের মাধ্যমে ধর্মপরায়ণ করে তোলার কাজেও তিনি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন স্থানে মাদরাসা-মক্তব স্থাপন করেছেন। ফলত তাঁকে কেন্দ্র করেই কিশোরগঞ্জ এলাকায় একটি সুন্দর ইসলামি পরিবেশ গড়ে ওঠে। তাঁর সুনাম ও সুখ্যাতি তখন অন্যান্য জেলাতেও ছড়িয়ে পড়ে।

তিনি যখন ধর্মীয় ও সামাজিক বিভিন্ন সংস্কার কর্মে ব্যস্ত ছিলেন, ঠিক সেই মুহুর্তে পাকিস্তান আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। তখন স্বীয় উস্তাদ আল্লামা শিব্বীর আহমদ উসমানী (রহ.)-এর নিকট হতে এই মর্মে আদেশ প্রাপ্ত হন যে, “পাকিস্তান আন্দোলনে সর্বশক্তি নিয়োগ কর।” ফলে, তিনি শহীদী মসজিদ থেকেই জমীয়তে উলামায়ে ইসলামের প্রোগ্রাম ও কর্মসূচী পরিচালনা করতে থাকেন।

এছাড়াও বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত প্রতিটি সংগ্রামেই তিনি প্রত্যক্ষভাবে ইসলাম ও মুসলিমদের পক্ষে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছেন। গড়ে তুলেছেন স্বৈরাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিরোধ।

মুসলিমদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের জন্য আন্দোলন

ব্রিটিশদের অনুসরণে উপমহাদেশের ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুরা চেয়েছিল গোটা ভারতকে একসাথে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে মুসলিমদের তাহজিব-তামাদ্দুন ও দ্বীনদারিতা ধ্বংস করে তাদেরকে নিজেদের গোলামে পরিণত করতে। কিন্তু তাদের এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেন উপমহাদেশের উলামা-মাশায়েখ ও ইসলামপ্রেমী রাজনৈতিক নেতাগণ। নিজ উস্তাদদের যোগ্য উত্তরসুরি হিসেবে সেই আন্দোলনে দৃঢ় ভূমিকা রাখেন মাওলান আতহার আলীও (রহ.)।

১৯৪৫ সনে আতহার আলী (রহ.) বঙ্গীয় ওলামা-মাশায়েখদেরকে নিয়ে নিখিল ভারতীয় ওলামা কনফারেন্সের আয়োজন করেন। ২৫ মে কোলকাতা মুহাম্মাদ আলী পার্কে আল্লামা আযাদ সোবহানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মহাসম্মেলনে মাওলানা শিব্বির আহমাদ উসমানীকে প্রধান করে গঠিত হয় জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম। এই সম্মেলন আয়োজনে আল্লামা আতাহার আলী (রহ.)-এর পাশাপাশি মাওলানা নেসার উদ্দীন আহমাদ (পীর সাহেব শর্ষীনা), মাওলানা সৈয়দ মুসলেহ উদ্দীন, মুফতি দ্বীন মুহাম্মাদ খাঁ এবং মাওলানা শামসুল হক্ক ফরিদপুরী (রহ.) প্রমুখ আলেমদের ভূমিকা ছিল।

অতঃপর আল্লামা আতহার আলী (রহ.) মুসলিমদের জন্য পৃথক ভূমি তথা পাকিস্তান কায়েমের লক্ষ্যে উপমহাদেশের সর্বত্র চষে বেড়ান। তিনি প্রধান প্রধান শহরসমূহে সভা-সম্মেলনের আয়োজন করেন। স্বীয় উস্তাদদের পাশাপাশি তিনিও বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে পাকিস্তানের পক্ষে জনমত গড়ে তোলেন এবং মুসলমানদের মাঝে ঐক্যের প্রাচীর তৈরি করেন। তিনি মুসলিম লীগের ঐতিহাসিক সিমলা কনফারেন্স ও বাংলার প্রতিনিধিত্বকারী নেতৃবৃন্দের অন্যতম ছিলেন, যাঁদের মধ্যে ছিলেন শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক, মাওলানা আকরম খাঁ, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, খাজা নাজিমুদ্দীন ও তাজুদ্দীন খান প্রমুখ নেতৃবৃন্দ।

উল্লেখ্য, ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবে শেরে বাংলা এ.কে ফজলুক হক কর্তৃক পঠিত প্রস্তাব প্রণয়নে তাঁর অবদান ছিল সিংহভাগ। এবং তা তিনি করেছিলেন হাকিমুল উম্মাহ্ মাওলানা আশরাফ আলি থানভি (রহ.)-এর বিশেষ ইঙ্গিতে।
লাহোর প্রস্তাব ঘোষণার ঐতিহাসিক সেই ছবিতে শেরে বাংলার পাশেই আল্লামা আতহার আলী ছিলেন।

তাছাড়া সিলেট রেফারেন্ডামে পাকিস্তানের পক্ষে তাঁর ভূমিকা ছিল অনবদ্য। এক কথায় বলা যায় তাঁর এবং মাওলানা সৈয়দ মুসলেহ্‌ উদ্দীন (রহ.)-এর দৃঢ় ভূমিকা ও নিরলস প্রচেষ্টার ফলেই সিলেট প্রথমে পাকিস্তান ও পরে বাংলাদেশের অংশ হিসেবে যুক্ত হয়েছে। এক্ষেত্রে উপমহাদেশের সকল আলেম, রাজনীতিবিদ ও সমাজ সচেতন নাগরিকবৃন্দও ভূমিকা রাখেন।

পাকিস্তান রাষ্ট্রে শরিয়া কায়েমের আন্দোলন

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মুসলিম লীগ ইসলামি হুকুমত কায়েম করতে ব্যর্থ হয়। দলটিতে ঘাপটি মেরে থাকা ব্রিটিশ ভাবধারার সেক্যুলাররা এবং একই ভাবধারার আমলারা ইসলামি হুকুমত কায়েম পথে মূল বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। এর মধ্যে আবার মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ্‌ আর মাওলানা শাববীর আহমাদ উসমানী উভয়ই মৃত্যুবরণ করলে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলিমদের ইসলামি নিজামের স্বপ্ন আরও সুদূর পরাহত হয়ে যায়। এর মধ্যে অন্যান্য আরও ঘটনাচক্র সংঘটিত হতে থাকে। একপর্যায়ে উলামায়ে কেরামের বড় অংশও ইসলামি হুকুমতের প্রশ্নে সাময়িক আশাহত হয়ে পরেন।

তবে বসে থাকেননি আতহার আলী (রহ.)। তাঁর একান্ত প্রচেষ্টা এবং মাওলানা সৈয়দ মুসলেহ উদ্দীন (রহ.)-এর সহযোগিতায় ১৯৫০ সনের ১৮, ১৯ ও ২০ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার মাছিহাতায় (মাওলানা সৈয়দ মুসলেহ উদ্দীন রহ.-এর নিজ বাড়িতে) সাবেক পূর্বপাকিস্তান জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের কাউন্সিল এবং ওলামা কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। এদেশে ইসলামি রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রথম সক্রিয় উদ্যোগ ছিল এই কনফারেন্স। যাতে সর্বমহলে আলেম-ওলামা শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবিসহ সাধারণ জনগণের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

এখান থেকেই জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম নতুন প্রত্যয় ও অঙ্গীকার নিয়ে ইসলামি নিজাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। উক্ত কনফারেন্সে শর্ষিনার মরহুম পীর সাহেব মাওলানা নেসার উদ্দীন (রহ.) ও আল্লামা আতহার আলী (রহ.)-কে যথাক্রমে সভাপতি ও কার্যকরী সভাপতি এবং মাওলানা শেখ আব্দুর রহীমকে (প্রফেসর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) মহাসচিব করে ৫২ সদস্য বিশিষ্ট পূর্বপাকিস্তান জমিয়তের কমিটি গঠন করা হয়। শুরু হয় ইসলামি শাসন কায়েমের আন্দোলনের নব উন্মেষ, নতুন যাত্রা।

আল্লামা আতহার আলী এর পরপরই তদানিন্তন সমস্ত পাকিস্তানব্যাপী ইসলামি শাসন কায়েমের আন্দোলনকে রাজনৈতিক রূপ দিয়ে ঝটিকা সফর শুরু করেন। গুরুত্বপূর্ণ ও বড় বড় শহরগুলোতে বিরাট বিরাট সভা-সম্মেলন আয়োজন করেন। সর্বস্তরের লোকজনকে উক্ত আন্দোলনে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেন এবং আদর্শ প্রস্তাব অনুযায়ী সংবিধান প্রণয়ন না করার দায়ে মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে প্রবল জনমত গড়ে তোলেন।

এর মধ্যে ৫০ থেকে ৫২-এর ভেতরে তিনি সিলেট ও করাচিতে দুটি জাতীয় পর্যায়ের ইসলামি কনফারেন্সের আয়োজন করেন, যা থেকে পরবর্তীতে প্রণয়নকৃত ইসলামি সংবিধানের ২২ দফা রূপরেখা বা প্রস্তাবনা পেশ করা হয়েছিল।

১৯৫২ সালের ১৮, ১৯ ও ২০ মার্চ তারিখে কিশোরগঞ্জে পূর্বপাকিস্তান জমিয়তের কনফারেন্স আহ্বান করেন আতহার আলী (রহ.)। দেশের গণমানুষের দাবি ও শ্লোগান ‘আমরা চাই নেজামে ইসলাম’ অনুসারে নেজামে ইসলাম পার্টি গঠন করা হয়। এর প্রথম সভাপতি ও সেক্রেটারী নির্বাচিত হন আল্লামা আতহার আলী (রহ.) নিজে এবং তার অন্যতম সহযোগী মাওলানা সৈয়দ মুসলেহ উদ্দীন (রহ.)। অতঃপর দলীয় দাবি ও শ্লোগান অনুযায়ী এবং পার্লামেন্টারি দলের নামেই প্রসিদ্ধি লাভ করে তাঁর দল, এবং জনগণের কাছে দ্রুত সময়ের মাঝেই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠে।

এরপর আতহার আলী (রহ.) একাধারে শুরু করেন জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও নেজামে ইসলাম পার্টির নামে ইসলামি শাসনতন্ত্র কায়েমের রাজনৈতিক কর্মসূচি। তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, মুসলিম লীগের বর্তমান নেতৃত্বের মাধ্যমে দেশে ইসলামি নেজাম কায়েম করা কখনও সম্ভব হবে না। অতএব তিনি মুসলিম লীগের সরকার পতনের ডাক দিলেন এবং ৫৩ সনে নেজামে ইসলাম দিবস পালনের আহ্বান করলেন।

৫০ সনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাছিহাতায়, ৫১ সনে করাচিতে, ৫২ সনে কিশোরগঞ্জের হয়বতনগরে এবং ৫৩ সনে ঢাকায় ইসলামি কনফারেন্সগুলো অত্যন্ত সফলভাবে আয়োজন করার মাধ্যমে আল্লামা আতহার আলী (রহ.) দেশের সর্বস্তরের আলেম-ওলামা, শিক্ষাবিদ ও ইসলামি বুদ্ধিজীবিদের নিয়ে ইসলামি শাসনতন্ত্রের ২২ দফা মূলনীতি প্রকাশ করেন। যা প্রণয়নেও আতহার আলী রহ.-এর অবদান সিংহভাগ। ইসলামি নেজাম কায়েমের লক্ষ্যে আল্লামা আতহার আলী সেদিন সমস্ত বিরোধীদল থেকেই সম্মতি ও সমর্থন আদায় করেছিলেন এবং তিনি শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হকের কৃষক শ্রমিক পার্টি, মাওলানা ভাসানির আওয়ামী মুসলিম লীগ (সোহরাওয়ার্দী) ও খেলাফতে রাব্বানী পার্টি নিয়ে ৫৪ সনে ‘যুক্তফ্রন্ট’ গঠন করেন। ফলে ৫৪-এর সাধারণ নির্বাচনে ‘হক-আতহার-ভাসানী’ ফ্রন্টের কাছে পূর্বপাকিস্তানে মুসলিম লীগ শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করে।

পক্ষান্তরে যুক্তফ্রন্ট বিপুল ব্যবধানে বিজয়ী হয়। সে নির্বাচনে নেজামে ইসলাম পার্টি প্রাদেশিক পরিষদে লাভ করে ৩৬টি আসন এবং কেন্দ্রে পায় ৪টি। পূর্ব পাকিস্তানে শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টের কোয়ালিশন সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। পক্ষান্তরে ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী বিরোধী দলে অবস্থান নেন। যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভায় নেজামে ইসলাম পার্টির পক্ষ থেকে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন যথাক্রমে আশরাফ উদ্দীন চৌধুরী শিক্ষামন্ত্রী, অ্যাডভোকেট নাসির উদ্দীন আহমাদ আইনমন্ত্রী এবং অ্যাডভোকেট ফরিদ আহমাদ কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রী।

সংসদে নেজামে ইসলাম পার্টির আসন সংখ্যাধিক্যের হিসাবে তেমন বেশি না হলেও, আল্লামা আতহার আলী রহ.-এর ব্যক্তিত্বের দরুণ সেখানে নেজামে ইসলাম পার্টির প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে নেজামে ইসলাম পার্টির সংসদ সদস্য এবং আতহার আলী রহ.-এর আশির্বাদপুষ্ট চৌধুরী মোহাম্মাদ আলীর প্রধানমন্ত্রীত্বে নেজামে ইসলাম পার্টির কেন্দ্রীয় সরকার গঠন এবং ৫৬ সনের ইসলামি শাসনতন্ত্র বিল পাশ করানো ও অনুমোদনের মাধ্যমে।

আল্লামা আতহার আলীর সবচেয়ে বড় সাফল্য সংসদে ইসলামী সংবিধান প্রণয়ন এবং পাশকরণ, যে সংবিধানের বদৌলতে পাকিস্তান হয়েছিল একটি কল্যাণমুখী ইসলামি প্রজাতন্ত্র। এ ছিল তাঁর অনন্য অমর কীর্তি, যা ছিল হাজার বছরের মুসলিম আশা-আকাঙ্ক্ষার ও শত চেষ্টার চূড়ান্ত সফলতা। তাঁর হাতেই জনমানুষের এই আকাঙ্ক্ষা পূর্ণতা এবং বাস্তবরূপ লাভ করেছিল।

নেজামে ইসলাম পার্টি কর্তৃক ইসলামপন্থীদের অভূতপূর্ব সাফল্যে দেশ-বিদেশের ইসলামবিরোধী মহল ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ে, সেই ধারাবাহিকতায় ৫৮ সনে আইয়ূব খানকে দিয়ে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ইসলামি সংবিধানকে বাতিল করে দেয়া হয়। আইয়ূব খান এক নিমিষেই এক ঘোষণাতেই এতদিনের মুসলিম হৃদয়ের একান্ত কামনা এবং শত কষ্ট-প্রচেষ্টার ফসল স্বপ্নের ইসলামি হুকুমততন্ত্র নস্যাত করে দেয়, বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমানের ঈমানে প্রচণ্ডভাবে আঘাত হানে সে। ইসলামি নেজাম কায়েমের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন হয়ে যায় চুর্ণবিচুর্ণ। ইসলামি রাজনীতি পিছিয়ে পড়ে আবারও অনেক দূর।

আতহার আলী (রহ.) আইয়ূব খানের ইসলামবিরোধী পারিবারিক আইনসহ যাবতীয় ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ড ও মৌলিক গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলেন, ফলে ১৯৬৫ সনে নির্বাচন দিতে বাধ্য হয় আইয়ুব খান। সেসময় তিনি সকল বিরোধীদলীয় নেতৃবৃন্দকে নিয়ে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে মুহতারামা ফাতেমা জিন্নাহকে একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী মনোনীত করেন এবং দেশব্যাপী নির্বাচনী প্রচারণা চালান। কারচুপির কারণে নির্বাচনে আইয়ুব খান বিজয়ী হবার পর সর্বপ্রথম আতহার আলী (রহ.)-কেই কারারুদ্ধ করা হয়। ১৯৬৫ সনের পাক-ভারত যুদ্ধ শেষের সামান্য পূর্বে তাঁকে মুক্তি দেয়া হয়।

৫৯ সালে কিছু বিপথগামী এবং দিল্লী ও মধ্যপন্থী কিছু রাজনৈতিক দল যখন ৫৬-এর ইসলামি সংবিধানের বিরুদ্ধে প্রপাগাণ্ডা চালিয়েছিল, তখন তিনি শারীরিক অক্ষমতা ও বার্ধ্যক্যজণিত অসুস্থতা সত্ত্বেও ৫৬- এর সংবিধান পুনরুদ্ধার আন্দোলনে বলিষ্টভাবে নেতৃত্ব দেন। কিন্তু আইয়ুব খানের মার্শাল ‘ল’-এর দশকে পানি অনেক দূর গড়িয়েছে। ইসলামবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো অনেক মজবুত ভিত গড়ে নিয়েছে। ফলে অনিবার্যভাবে ৭০-এর নির্বাচনে ইসলামপন্থীদের পেছনে হঠতে হয় এবং ইসলামবিরোধী সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রপন্থী দলগুলো বিজয়ী হয়। এরই মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানিদের স্বৈরতন্ত্রের কারণে শুরু হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ। অবশেষে অনেক রক্তের বিনিময়ে পশ্চিম পাকিস্তানি স্বৈরাচারীদের কবল থেকে ৭১ সনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়।

স্মরণীয় কাজসমূহ

আল্লামা আতহার আলী রহ. এর জনসেবা, সংস্কার তথা ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অবদান এ সংক্ষিপ্ত নিবন্ধে আলোচনা করা সম্ভব নয়; কেবল দু’একটি অমর কীর্তির প্রতি আমরা ইঙ্গিত করছি মাত্র।

আল–জামিয়াতুল ইমদাদিয়া

হযরত আতহার আলী রহ. এর দৃষ্টিতে ধর্মীয় শিক্ষা ব্যতিরেকে যেহেতু জাতি গঠন সম্ভব নয়, তাই তিনি ইসলামী আন্দোলনের অগ্রসৈনিকের ভূমিকা পালন করার পাশাপাশি কিশোরগঞ্জ শহরের প্রাণকেন্দ্রে ১৯৪৫ সালে ইসলামী শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে “ইমদাদুল উলূম” নামে একটি ছোট মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর উন্নত চিন্তাধারা, পুতপবিত্র মানসিকতা ও অক্লান্ত পরিশ্রমের বদৌলতে মাত্র কয়েক বছরের ভিতরেই এ ছোট মাদরাসাটি “আল-জামিয়াতুল ইমদাদিয়া” নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ নেয়। এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হতেই অসংখ্য উলামায়ে কিরাম, অগণিত সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও ইসলামী চিন্তাবিদ গড়ে উঠেন।

শহীদী মসজিদ

আতহার আলী রহ. কিশোরগঞ্জ শহরের পুরান থানা এলাকায় যে ছোট মসজিদটিতে স্থায়ীভাবে অবস্থান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সেই শহীদী মসজিদ থেকেই তাঁর জীবনের বিরাট কীর্তিসমূহের সূচনা হয়। একটি পূজা উপলক্ষ্যে স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায় উক্ত মসজিদের সম্মূখ দিয়ে বাদ্য বাজিয়ে মূর্তিসহ যাওয়ার চেষ্টা করলে মুসল্লিরা তাতে বাধা দেন। ঐ সময় পুলিশের গুলিতে একাধিক মুসল্লী শহীদ হন। সে সময় থেকেই এ মসজিদটি শহীদী মসজিদ নামে খ্যাতি লাভ করে।

সমাজসেবা

হযরত আতহার আলী রহ. সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অসংখ্য খেদমত ও অবদান রেখে গেছেন। তিনি কিশোরগঞ্জ শহর ও এর আশে পাশে অনেক মসজিদ ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাছাড়া কিশোরগঞ্জ শহরের বিদ্যুৎ, পানি, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ও পাকা রাস্তাঘাটের ভিত্তিপ্রস্তর একমাত্র মাওলানারই নিরলস প্রচেষ্টার ফল ও তাঁর অমর কীর্তির নিদর্শন।

জামিয়া ইসলামিয়া

জীবনের শেষভাগে মোমেনশাহী শহরের চরপাড়া মোড়ে নির্মিত একটি ছোট দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে তিনি অতি অল্প সময়ের মধ্যেই জামিয়া (বিশ্ববিদ্যালয়) স্তরে উন্নীত করেন এবং কয়েক কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিয়ে বিদ্যুৎ বেগে কাজ চালিয়ে যান। তবে উনার জীবদ্দশায় জামিয়া ইসলামিয়ার কাজ পুরাপুরি শেষ করে যেতে পারেননি।

রচনাবলী

আল্লামা আতহার আলী রহ. বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বই লিখেছেন। তার লেখা বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু বই হচ্ছে- পর্দা ও ইসলাম, আল-ওজরু ওয়ান নুযরু, ইসলামী শাসন কেন চাই?, বাস্তব ক্ষেত্রে সমাজতন্ত্র, ইসলামে অর্থবন্টন ব্যবস্থা ইত্যাদি।

ইন্তেকাল

স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে হিন্দুঘেষা আওয়ামী কর্তৃপক্ষও আইয়ুব খানের মতো মাওলানা আতহার আলীকেই সবচেয়ে বড় হুমকি মনে করতে থাকে। ফলে তাঁকে বিনা কারণে ৭১ থেকে ৭৪ পর্যন্ত প্রায় তিন বছর কারাভোগ করতে হয়। পরে হাইকোর্টের নির্দেশে তাঁকে মুক্তি দেয়া হয়। অত্যধিক পরিশ্রম, দীর্ঘ কারাভোগ এবং বয়সের ভারে নূব্জ্য হয়ে যাওয়ায় তার স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙে পড়ে। অতঃপর প্রায় দুই বছর বার্ধ্যক্যজনিত রোগে ভোগার পর ১৯৭৬ সালের ৫ অক্টোবর এই মহান ইসলামী ব্যক্তিত্ব ইন্তেকাল করেন।
ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।


তথ্যসূত্র:
———
১. মাওলানা আতহার আলী রহ. এর বর্ণাঢ্য জীবন
https://tinyurl.com/bddbufw6
২. হযরত আতহার আলী (র)
https://tinyurl.com/y2yy6haj
৩. মাওলানা আতহার আলী: বৃহত্তর মোমেনশাহীর ধর্মীয় অভিভাবক
https://tinyurl.com/4wftcr26

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধরোজার আগে আবারও বাড়লো চিনির দাম
পরবর্তী নিবন্ধআল-ফিরদাউস বুলেটিন || ফেব্রুয়ারি ৩য় সপ্তাহ, ২০২৪ঈসায়ী