
রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় ঈদগাহ সংলগ্ন ফুটপাতের পাশে দুটি নীল রঙের প্লাস্টিকের ড্রামের ভেতর থেকে কাঁচামাল ব্যবসায়ী আশরাফুল হকের (৪৩) খণ্ড-বিখণ্ড লাশ উদ্ধারের ঘটনার জট খুলেছে। ত্রিভুজ পরকীয়ার জেরে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে জানা গেছে।
এ ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার প্রধান আসামি জারেজুল মিয়াকে শুক্রবার (১৪ নভেম্বর) দিবাগত রাতে কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার নাসিরুল ইসলাম জানায়, গ্রেপ্তার হওয়ার পর জারেজুল ডিবির প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, ‘বিগো লাইভ’ অ্যাপস-এর মাধ্যমে জারেজুল ও শমীমার পরিচয় হয়। জারেজুলের গ্রামের বাড়ি রংপুরে আর শামীমার বাড়ি কুমিল্লায়। দুজনই বিবাহিত। শামীমা দুই সন্তান নিয়ে কুমিল্লায় বাস করত। স্বামী থাকে বিদেশে। জারেজুলের স্ত্রী-সন্তান থাকে রংপুর। অ্যাপসে পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব হয় জারেজুল-শামীমার। বন্ধুত্ব থেকে পরকীয়া। পরে পরকীয়া আরো গভীর হয়ে শারীরিক সম্পর্কে গড়ায়। এভাবেই চলছিল। জারেজুল যখনই মালয়েশিয়া থেকে দেশে আসতো, তখন শামীমার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎসহ সবই হতো। জারেজুল প্রায় ১০ বছর ছিল মালয়েশিয়ায়। মাঝে মাঝে দেশে আসত। সর্বশেষ দেশে আসে গত ২৩ অক্টোবর। দেশে এসে অনেকটা অবসর জীবন কাটাচ্ছিল। জাপান যাওয়ার চেষ্টাও করছিল।
এদিকে আশরাফুল একসময় গোপনে বন্ধু জারেজুলের মোবাইল থেকে নম্বর নেয় শামীমার। পরে কথা চলতে থাকে তাদের। একপর্যায়ে আশরাফুল-শামীমা পরকীয়ায় জড়িয়ে যায়। সম্পর্ক গভীর হয়। তবে বিপত্তি বাধে ২৩ অক্টোবর জারেজুল দেশে আসার পর থেকে। জারেজুল শামীমাকে রাজধানীর শনির আখড়া এলাকায় একটি বাসা ভাড়া করে দেয়। সেখানে স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে থাকা শুরু করে তারা।
১১ নভেম্বর রংপুর থেকে ঢাকায় আসে জারেজুল ও আশরাফুল। ওঠে শামীমার বাসায়। জারেজুল জানত না আশরাফুলের সঙ্গে শামীমার পরকীয়া চলছে। গত ১৩ নভেম্বর আশরাফুলের সঙ্গে দেখা হলেও শামীমা চুপ থাকে। পরে সেখানে জারেজুলের সঙ্গে শামীমার শারীরিক সম্পর্ক হয়। একপর্যায়ে আশরাফুলও শামীমার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করতে চায়। আর তখনই বাধে বিপত্তি। আশরাফুল তখন জানায় তার সঙ্গে শামীমার সম্পর্ক রয়েছে। এ কথা শুনে ঝগড়া করে বের হয়ে যায় জারেজুল। কিন্তু ভুলে আশরাফুলের মোবাইল নিয়ে যায় সে।
পরে নিজের মোবাইল নিতে ফিরে এসে দেখে শামীমার সঙ্গে আশরাফুল শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত। তখন ক্ষুব্ধ হয়ে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করলে অচেতন হয়ে পড়ে আশরাফুল। পরে আশরাফুলের মৃত্যু নিশ্চিত করতে আরো কয়েকবার আঘাত করে। মৃত্যু নিশ্চিত হলে শামীমা আর জারেজুল আশরাফুলের লাশ বাথরুমে সারা দিন রেখে দেয়। রাতে দুজনে ওই লাশ কয়েক টুকরো করে। বৃহস্পতিবার দুপুরে দুটি ড্রামে করে লাশের টুকরোগুলো শাহবাগে জাতীয় ঈদগাহ সংলগ্ন ফুটপাতের পাশে রেখে চলে যায় জারেজুল ও শামীমা।
ডিবি জানায়, আশরাফুলকে হত্যার পর লাশ কী করবে তা নিয়ে পরিকল্পনা করেন জারেজুল ও শামীমা। একপর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেয় লাশ টুকরো করে ড্রামের মধ্যে নিয়ে কোথাও ফেলে দিয়ে আসবে। সে অনুযায়ী দা দিয়ে লাশ ২৬ টুকরো করে ড্রামে ভরে হাইকোর্টের সামনে ফেলে যায়।
এদিকে নিহত আশরাফুলের ছোট বোন আনজিরা বেগম বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলা দায়ের করেন। মামলায় জারেজুলকে প্রধান আসামি করা হয়। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান এর আগে জানিয়েছিল, বৃহস্পতিবার দুপুর ২টা থেকে আড়াইটার মধ্যে কে বা কারা একটি ভ্যানগাড়িতে করে ড্রাম দুটি ফেলে রেখে গিয়েছিল।
নিহত আশরাফুল হক রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের নয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। তার বাবার নাম মো. আব্দুর রশিদ এবং মায়ের নাম এছরা বেগম। দিনাজপুরের হিলি বন্দর থেকে পুরো বাংলাদেশে পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ, আলুসহ কাঁচামাল সরবরাহ করত সে। আশরাফুল হকের স্ত্রী লাকি বেগম। তাদের দুই সন্তান আব্দুল্লাহ (৭) ও আসফি (১০)।
গত মঙ্গলবার রাতেই আশরাফুলের সঙ্গে তার স্বজনদের শেষ কথা হয়। তখন আশরাফুল তার বোনকে বলেছিল সে নারায়ণগঞ্জে এক পাওনাদারের কাছে টাকা নিতে অপেক্ষা করছে। জারেজ তার সঙ্গেই আছে। এরপর থেকে আশরাফুলের মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়। আশরাফুলের স্ত্রী লাকী বেগম একাধিকবার স্বামীর মুঠোফোনে কল দিলে জারেজ মিয়া ধরত। বলত আশরাফুল ব্যস্ত আছে। বুধবারও লাকী বেগমের সঙ্গে জারেজের কথা হয়। তখনও জারেজ একই কথা বলে।
বৃহস্পতিবার দুপুরে লাকী বেগম যখন আবার কল দেয়, তখনও জারেজই ফোন ধরে। এতে সন্দেহ হলে আশরাফের বোন আনজিরা বেগম জারেজের স্ত্রীর কাছে যায়। তার কাছে জানতে চান তার ভাইয়ের কী হয়েছে।
তথ্যসূত্র:
1. ত্রিভুজ পরকীয়ার জেরে আশরাফুলকে হত্যা, প্রেমিকা শামীমাসহ জারেজুল গ্রেপ্তার
– https://tinyurl.com/yc4bx876


