ভারতীয় মিডিয়া নিউজ চ্যানেলগুলোই আসল ‘টুকরে টুকরে’ গ্যাঙ!

0
1027

দিল্লির সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় ৪০ জনের বেশি নিহত হচ্ছিল, বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের সম্পত্তি ধ্বংস ও লুণ্ঠিত হচ্ছিল, তখন ভারতের টিভি নিউজ চ্যানেলগুলো যে বিষ ছড়ানোর ভূমিকা পালন করেছিল, তা বিস্তারিতভাবে আলোচনাযোগ্য।

ভারত সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ভারতে টিভি নিউজ চ্যানেলের সংখ্যা ৪০৩টি। সার্বক্ষণিক চলমান এসব চ্যানেলের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয় হচ্ছে স্পর্শকাতর ‘ব্রেকিং ও এক্সক্লুসিভ নিউজ’ দিয়ে তাদের পর্দাকে উত্তেজনাকর রাখা।

বিজেপি-নেতৃত্বাধীন সরকারের গণবিরোধী এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে রটওয়েলার জাতের কুকুরে পরিণত হওয়া ভারতীয় টিভি নিউজ মিডিয়া সহিংসতায় ইন্ধন দেয়া, মুসলিমদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের ক্ষেপিয়ে তোলা, মুসলিমদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভও সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনসাধারণ ও ভারতের অখণ্ডতার প্রতি হুমকি হিসেবে প্রদর্শন করার নতুন ভূমিকায় দায়িত্ব পালনকে নিজের কাঁধে গ্রহণ করে নিয়েছে। এরা মুসলিম ও তাদের সহানুভূতিশীলদেরকে ‘টুকরে টুকরে গ্যাঙ’ হিসেবে অভিহিত করছে।

‘টুকরে টুকরে গ্যাঙ’ হলো ক্ষমতাসীন বিজেপি ও তাদের সহানুভূতিশীলদের অতি ব্যবহৃত অবমাননাকর রাজনৈতিক পরিভাষা। তারা তাদের সমালোচকদেরকে ভারতকে খণ্ড বিখণ্ড করার প্রয়াসে লিপ্ত বলে প্রচার করতে চায়।

গত মাসে পুলিশ যখন দিল্লির জামিয়া মিল্লিয়া ইসলামিয়ার লাইব্রেরিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে ছাত্রদের ওপর লাঠি কিংবা ব্যাটন চার্জ করছিল, তখন পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন না তুলে টিভি নিউজ চ্যানেলগুলো পুলিশের নৃশংসতাকে বৈধ করতে প্রাণান্তকর চেষ্টা চালায়।

যে সিসিটিভি ফুটেজে লাইব্রেরিতে পুলিশের তাণ্ডব প্রকাশ করে দিচ্ছিল, তাতে দেখা যায় যে এক কোণে একটি ছাত্র তার মুখ রুমালে ঢেকে বসে আছে। ফুটেজে দেখা যায়, পুলিশ কিভাবে ছাত্রদের ওপর ব্যাটন হাতে নির্মমভাবে আক্রমণ করেছিল। ফুটেজটি যখন টিভি নিউজ চ্যানেলগুলোতে পৌঁছাল, তখন তারা পুরো বিষয়টিই উল্টে দেয়ার চেষ্টা করল।

বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির ঘটনার জন্য পুলিশকে দায়ী করার বদলে টিভি সাংবাদিকেরা মুখে ঢেকে রাখা ছাত্রটির দিকে আঙুল তুলল।

জি নিউজের অ্যাঙ্কর সুধীর চৌধুরী বলেন, নিকাব পরে কে লাইব্রেরিতে বসে আছে? পুলিশ খারাপ কী করেছে? ক্যাম্পাসে শিক্ষা নয়, অন্য কিছু আমদানি করা হয়েছে। এখানে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পাকানো হচ্ছে।

মোদিপন্থী ও মুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষমূলক রিপাবলিক টিভি ও টাইমস নাও মিডিয়া হাউসগুলোও একই ধরনের বক্তব্য প্রচার করে।

অবশেষে  পুরো কাহিনীর কেন্দ্রে থাকা ছাত্রটিকে শনাক্ত করে জানা যায় যে নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করার সময় ক্যাম্পাসে তীব্র টিয়ার গ্যাস ছড়ানো হয়েছিল, তা থেকে রক্ষা পেতে অনেক ছাত্র তাদের মুখ ঢেকেছিল।

এর এক দিন পর আরেকটি টিভি নিউজ চ্যানেল ইন্ডিয়া টুডে লাইব্রেরির ঘটনা নিয়ে ৭১ সেকেন্ডের একটি ভিডিও প্রকাশ করে। তাতে দাবি করা হয় যে তারা পুরো ঘটনার সম্পাদনাহীন ভিডিও দেখাচ্ছে। চ্যানেলটি এমনকি লাইব্রেরির ভেতরে এক ছাত্রের হাতে পাথর পর্যন্ত দেখানো হয়। পরে দেখা যায়, ছাত্রটি তার ওয়ালেট ধরে ছিল এবং ফুটেজটি ছিল দ্বিতীয় ফ্লোরের, অথচ পুলিশের তাণ্ডব ঘটছিল প্রথম ফ্লোরে।

রিপাবলিক টিভির প্রধান অর্নব গোস্বামী একতরফা রিপোর্টিংয়ের জন্য পরিচিত। তিনি শাহিন বাগের বিক্ষোভের বিরুদ্ধে লোকজনকে ক্ষেপিয়ে তুলতে সবকিছুই করেছেন। উল্লেখ্য, গত দুই মাস ধরে শাহিন বাগে শান্তিপূর্ণভাবে সিএএবিরোধী বিক্ষোভ চলছে।

তিনি প্রতিবাদকে চিহ্নিত করেন এভাবে: পুরো শাহিন বাগের ঘটনা আসলে টাকার খেলা। আর তা করা হচ্ছে বিশ্বব্যাপী ভারতকে কলুষিত করার জন্য। শাহিন বাগ হলো ভারতবিরোধী, হিন্দুবিরোধী, টাকা লিপ্সু, সুযোগসন্ধানী ও পুরোপুরি রাজনৈতিক আন্দোলন। শাহিন বাগের সহিংস বিক্ষোভ দিল্লিতে লোকজনকে সন্ত্রস্ত্র করে ফেলছে, আর আমরা পুরোপুরি নীরব থাকব? শাহিন বাগ থেকেই সবচেয়ে সাম্প্রদায়িকতাপূর্ণ বিবৃতি প্রকাশিত হয়।

প্রাইম টাইমে টিভি নিউজ অ্যাঙ্করেরা এমন ভূমিকা পালন করার পর গেরুয়া সন্ত্রাসীরা যা করার কথা, তাই করেছে। ২৭ জানুয়ারি বিজেপি নেতা ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর এক নির্বাচনী সমাবেশে সিএএবিরোধী বিক্ষোভের বিরুদ্ধে প্ররোচনা সৃষ্টিকারী স্লোগান দেন ‘গোলি মারো সা…কো’ (গুলি মারো বিশ্বাসঘাতকদেরকে)। কেন্দ্রীয় অর্থ প্রতিমন্ত্রীও একই ধরনের স্লোগান দেন।

পরের দিন, ২৮ জানুয়ারি বিজেপি এমপি পরবেশ ভার্মা বলেন, কাশ্মিরে কাশ্মিরি পণ্ডিতদের প্রতি যা হয়েছে, দিল্লিতে তাই ঘটছে। তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, শাহিন বাগের লাখ লাখ সিএএবিরোধী বিক্ষোভকারী বাড়ি বাড়ি ঘুরে নারীদের হত্যা ও ধর্ষণ করতে পারে।

অবশেষে ২৩ ফেব্রুয়ারি ভারতের রাজধানীতে গেরুয়া সন্ত্রাসীদের মুসলিমদের গণহত্যায় নেমে আসে।এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছে ৪৬ জনের উপরে, আহত হয়েছে ৪০০-এর বেশি। হাজার হাজার লোক চাকরিহীন হয়ে পড়েছে, আশ্রয় পর্যন্ত নেই।

দিল্লি মাইনরিটি কমিশনের প্রধান ড. জাফরুল ইসলাম খান বলেন, অনুরাগ ঠাকুর, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও পরবেশ ভার্মা সাম্প্রতিক রাজ্য বিধান সভার নির্বাচনের সময় শান্ত ও শান্তিপূর্ণ দিল্লিতে বিষবাস্প ছড়িয়ে দেন। কপিল মিশ্রের হুমকি ও আলটিমেটাম সহিংসতা ছড়িয়ে দেয়, আর তাতে নিরীহ কয়েক ডজন লোকের প্রাণ যায়, শত শত লোক আহত হয়েছে, নিরীহ লোকদের কোটি কোটি রুপির সম্পত্তি ধ্বংস হয়েছে। আবার এসব অপরাধী অবাধে ঘুরে বেড়ালেও তাঁদের কোন বিচার হচ্ছে না।

আর যখন পরিস্থিতি শান্ত হবে, তখন টিভি নিউজ চ্যানেলগুলো কি অনৈক্যের বীজ বপণ আর বিভেদ রেখা সৃষ্টির পথেই ধরবে? টিভি অ্যাঙ্করদের (যেমনটা করেছেন ইন্ডিয়া টুডের সাংবাদিকেরা) প্রিয় বিষয় যতক্ষণ নির্মম মুসলিমবিরোধী বাগাড়ম্বড়তা থাকবে, তত দিন মুসলিমদের মাথার ওপর খগড় ঝুলতেই থাকবে, এবং তা নানাভাবে দেশের জন্য বিপর্যয়করই প্রমাণিত হবে। একদিন হয়তো দেশের জনগণ ভাবতে বসবে আসল ‘টুকরে টুকরে গ্যাঙ’ কারা?

 

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধ‘প্রতিবেশী দেশে ঢুকে হামলা চালানোর ক্ষমতা এখন ভারতেরও রয়েছে’ বলে মন্তব্য করল মালাউন অমিত
পরবর্তী নিবন্ধকোনো শক্তি মোদিসহ ভারতের অতিথিদের আসা রুখতে পারবে না: নাসিম