বিজয়ের পদধ্বনি- ৪ | সমাজতন্ত্রের পতন ও তালেবানদের নতুন ইসলামিক সম্রাজ্যের উত্থান-১

    3
    2405
    বিজয়ের পদধ্বনি- ৪ | সমাজতন্ত্রের পতন ও তালেবানদের নতুন ইসলামিক সম্রাজ্যের উত্থান-১

    আফগানিস্তানে পরাজিত হয়ে সোভিয়েত ইউনিউয়ন পালিয়ে যায়। ক্ষমতালোভীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয় আফগানিস্তান। ৩টি শক্তিশালী গ্রুপ হেকমতিয়ার, মাসুদ ও নজিবুল্লাহ’সহ আবদুর রশিদ-দোস্তমদের মত লোকদের হাতে গড়ে উঠা ছোট ছোট ৯টি মিলিশিয়া গ্রুপের ফলে বিভক্ত হয়ে পড়ে আফগানিরা। এসব ক্ষমতালোভীদের ফলে ৯০ দশকের আফগানিস্তান নিপীড়ন, স্বৈরাচার এবং দুর্নীতিতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠে। ১৯৯২ সালে যার তীব্রতা আরো কয়েকগুন বেড়ে যায়।

    এসময় হেকমতিয়ার এবং দোস্তুমের বাহিনীসহ আফগানিস্তানের বিভিন্ন দল পাকিস্তানের পেশোয়ারে বৈঠক করে।উদ্দেশ্য জোটসরকার গঠন করে প্রশাসনের দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়া। বৈঠকের আগেই ১৯৯২ সালের মার্চ মাসে হেকমতিয়ারসহ অন্যদলগুলো এই বৈঠক বয়কট করে। তাদের দাবি কিছু নেতা, বিশেষ করে রব্বানী এবং মাসুদ, হিজব-ই-ইসলামীকে খুব ছোট জায়গা দেবার পরিকল্পনা করছে। আবার এই প্রক্রিয়ায়, ইরান-সমর্থিত শিয়া গোষ্ঠীগুলো নতুন প্রশাসনে তাদের প্রাপ্যের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতার দাবি করেছিল। এসব কারণে জোট সরকারের মাঝে শুরু হয় তীব্র সংঘর্ষ। এসময় রাজধানী কাবুল অনেকাংশে মাসুদ-দোস্তমের নিয়ন্ত্রণে ছিল। হেকমতিয়ার, শহরের দক্ষিণে ছিল, আর হিজব-ই-বাহাদেত শহরের পশ্চিমে শিয়া বসতিগুলো নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল। রাজধানীতে সায়াফের অনুগত বাহিনীও ছিল। এসময় কাবুলে সায়াফ গ্রুপ এবং হিজব- ই- বাহাদেতের মধ্যে শুরু হয় সংঘর্ষ। ফলে দিনে এক গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করলেও রাতের কাবুল নিয়ন্ত্রণ করত অন্য গ্রুপ।

    অপরদিকে হেকমতিয়ার, রব্বানী, মাসুদ ও দোস্তুম একে অপরকে অভিযুক্ত করতে থাকে যে, তারা কাবুলে অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্র করছে। ফলে ১৯৯২ সালের মে মাসে, হিজব-ই-ইসলামী দক্ষিণের পাহাড় থেকে কাবুলে গোলাবর্ষণ শুরু করে। দোস্তুম ও মাসুদের বাহিনীও এসময় হিজব-ই-ইসলামীর নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলগুলোতে বোমা বর্ষণ করে। উভয় পক্ষই বলেছিল যে তারা জনগণকে নয়, শত্রু সামরিক বাহিনীকে টার্গেট করছে। কিন্তু তাদের এই বোমাবর্ষণের কারণে কাবুলের জনগণ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। বেসামরিক আবাসস্থল ধ্বংস হয়ে যায়, হাজার হাজার বেসামরিক মানুষ প্রাণ হারান। এই দলগুলোর মাঝে এভাবে ক্ষমতার লড়াই চলতে থাকে ১৯৯৩ সালের মে মাস পর্যন্ত। এরপর পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত থাকলেও ১৯৯৪ সালের জানুয়ারিতে পুনরায় কাবুলে যুদ্ধ শুরু হয়। এ যুদ্ধ ছিল পূর্বের তুলনায় আরো বেশি সহিংস। এই যুদ্ধ কাবুলকে বিধ্বস্ত, কর্তৃত্বহীন এবং অশান্তির নগরে পরিণত করে। এসব ডাকাত আর দুর্নীতিবাজ মিলিশিয়ারা আফগানদের একটি স্বাচ্ছন্দ্যময় স্বাধীন জীবন থেকে বঞ্চিত করে। ক্ষমতালোভীদের কারণে আফগানিস্তান জুড়ে শুরু হয় ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ।

    আর এমন এক নাজুক পরিস্থিতেই ১৯৯৪ সালে উত্থান ঘটে তালেবান আন্দোলন নামে নতুন এক ইসলামিক শক্তির। দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম কান্দাহার প্রদেশে জন্মগ্রহণকারী মাদ্রাসা শিক্ষক মোল্লা মোহাম্মদ ওমর মুজাহিদ রহিমাহুল্লাহ’র (মৃত্যু ২০১৩ সাল) নেতৃত্বে শুরু হয় সাধারন ছাত্রদের নিয়ে তালেবানদের ‘আফগান সংস্কার’ আন্দোলন। মোল্লা ওমর রহিমাহুল্লাহ সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় সামনের সারি থেকে যুদ্ধ করেছিলেন। কান্দাহারে বেশ কিছু ফ্রন্টের নেতৃত্বও দিয়েছিলেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন পরাজিত হয়ে আফগানিস্তান ত্যাগ করলে এবং আফগান মিলিশিয়াদের একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে শুরু করলে তিনি নিজ এলাকায় ফিরে যান। গৃহযুদ্ধে না জড়িয়ে স্থানীয় মাদ্রাসায় ছাত্রদের কুরআন,হাদীসের দারস দিতে থাকেন।

    কিন্তু অন্যান্য অঞ্চলের মতো, সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো কান্দাহারেও সাধারণ মানুষের উপর জুলুম করতে থাকে। কান্দাহারে দিন দিন ডাকাতি, হত্যা এবং ধর্ষণের মতো অপরাধ বাড়তে থাকে। এক সন্ত্রাসী দলের নেতা কর্তৃক ধর্ষণের ঘটনায় মোল্লা ওমর রহিমাহুল্লাহর মনে ঝড় বয়ে যায়। এসময় মোল্লা ওমর তাঁর ছাত্র এবং সাথীদের নিয়ে সন্ত্রাসীদের শায়েস্তা করতে শুরু করেন। ধর্ষণের শিকার নারীকে উদ্ধার করা হয়। এবং ধর্ষক গ্যাং লিডারকে পাকড়াও করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। জনসাধারণের আহ্বান ও সহযোগিতায় কান্দাহার জুড়ে অনুরূপ অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেন মোল্লা ওমর। আর এভাবেই শুরু হয় তালেবান আন্দোলনের পথচলা।

    আফগানিদের ভয়ংকর দুঃসময়ে হাল ধরেন মোল্লা মোহাম্মদ ওমর। চারিদিকে যখন অন্যায়, অত্যাচার, জুলুম তখন তিনি এক পশলা ইনসাফের বৃষ্টি হয়ে আবির্ভূত হন। তালেবান মুজাহিদের আগমন আফগান জনগণের কাছে আল্লাহর পক্ষ হতে আসা করুণার ফেরেশতার চেয়ে কম ছিল না বলেও মন্তব্য করেন অনেকেই।

    মোল্লা ওমরের একের পর এক সফল সিদ্ধান্তের ফলে কান্দাহারের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা মোল্লা ওমরকে তাঁর “সুশৃঙ্খল ছাত্রদের নিয়ে শহর শাসন করতে বলেন। শত শত উপজাতীয় নেতা এবং আলিমগণ মোল্লা ওমরকে তাঁদের শাসক হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। এভাবে, ১৯৯৪ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে কান্দাহার পুরোপুরি তালেবানদের অধীনে চলে আসে।

    অনুরূপ পরিস্থিতিতে আশেপাশের অঞ্চলগুলোর আমন্ত্রণ ও সহযোগিতায় তালেবানরা দক্ষিণ আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নিতে শুরু করে, প্রায় বিনা যুদ্ধে। কাবুলে তখন ক্ষমতালোভীদের মাঝে যুদ্ধ চলছিল। অন্যদিকে তালেবান তখন তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলে মানুষের বিরুদ্ধে এতদিন যাবত মিলিশিয়াদের কারণে সৃষ্ট নৈরাজ্যের অবসান ঘটিয়ে সামনে অগ্রসর হতে থাকে। এরপর পশ্চিম আফগানিস্তানের ঐতিহাসিক ও কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ শহর হেরাতে তালেবান মুজাহিদদের আমন্ত্রণ জানান স্থানীয়রা।

    হেরাত নিয়ন্ত্রণে আসার পর কান্দাহার থেকে ইরান পর্যন্ত বিশাল সীমান্ত তালেবানদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এই অগ্রগতি সাধনের পর, তালেবান এবং শিয়া হিজব-ই-বাহাদেত মিলিশিয়াদের মাঝে সংঘর্ষ শুরু হয় ১৯৯৫ সালে। সংঘর্ষে তালেবান মুজাহিদদের হাতে হিজব-ই-বাহাদতের নেতা আব্দুল আলী মাজারী নিহত হয়।

    তালেবানদের অগ্রযাত্রায় দেশে স্থিতিশীলতা ফিরে আসতে শুরু করে। তালেবানরা ইসলামি শরিয়াহ্ ফিরিয়ে আনার দৃঢ় প্রত্যয় গ্রহণ করে। ফলে কমান্ডার ইউনুস হালিম, জালাউদ্দিন হাক্কানি এবং নুরিস্তানের মোল্লা ইফদালের মতো নেতারা তাঁদের বাহিনী নিয়ে তালিবানে যোগদান করেন। এতে তালেবানের শক্তি কয়েকগুণ বেড়ে যায় এবং তাঁরা রাজধানী কাবুলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
    একের পর এক অঞ্চল বিজয় করতে করতে ১৯৯৬ সালে তালেবানরা কাবুলে পৌঁছে যায়। কাবুলের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় মাসুদ-রাব্বানী-হিকমতিয়ারের মধ্যে মতবিরোধের সুযোগ নিয়েছিল তালেবানরা। তবে ১৯৯৬ সালের মে মাসে, হেকমতিয়ার এবং রাব্বানী একমত হয়, যে শক্তি আর ক্ষমতার জন্য তারা চার বছর ধরে লড়াই করে আসছিল, তা তালেবানদের কারণে ধীরে ধীরে দূর্বল হয়ে যাচ্ছে। ফলে তারা উভয়েই তালেবানদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়।এদিকে ১৯৯৬ সালের এপ্রিলেই বিশাল এক উলামা সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে মোল্লা ওমরকে “ইমারতে ইসলামিয়া আফগানিস্তান’ এর আমীর বা আমীরুল মু’মিনিন ঘোষণা করা হয়েছিল।

    যাইহোক, ক্রমবর্ধমান শক্তিশালী তালেবান হেকমতিয়ার-রব্বানী-মাসুদের বাহিনীকে অল্প সময়ের মধ্যেই পরাজিত করে ফেলে। কেননা এই দলগুলো পূর্বেই ক্রমাগত লড়াইয়ের মাধ্যমে একে অপরের শক্তি নিঃশেষ করে দিয়েছিল।
    সেপ্টেম্বর মাসে সালে রাজধানী কাবুল বিজয়ের জন্য সর্বশক্তি নিয়ে লড়াই শুরু করে তালেবান। এসময় তারা স্থলপথে সাঁজোয়া যান আর ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অগ্রসর হওয়ার পাশাপাশি কাবুলে বিমান হামলাও চালায়। তালেবানদের আক্রমণের মুখে কাবুলের ক্ষমতালোভীদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা একেবারেই ভেঙে পড়ে। তালেবানরা রাজধানী কাবুল বিজয় করে নেয়।
    সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের হাতের পুতুল সরকার, গাদ্দার নজিবুল্লাহকে গ্রেফতার করা হয়। তাকে জনসম্মুখ মৃত্যুদণ্ড দিয়ে তার লাশ রাস্তায় ঝুলিয়ে রাখে তালেবান।

    চলবে ইনশা আল্লাহ…


    লেখক: ত্বহা আলী আদনান, প্রতিবেদক: আল ফিরদাউস নিউজ।

    পড়ুন আগের পর্বগুলো-

    বিজয়ের পদধ্বনি-১

    বিজয়ের পদধ্বনি- ২

    বিজয়ের পদধ্বনি- ৩

    3 মন্তব্যসমূহ

    Leave a Reply to কায়েম প্রতিউত্তর বাতিল করুন

    দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
    দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

    পূর্ববর্তী নিবন্ধনারায়ণগঞ্জের তল্লা মসজিদ বছর পার হলেও খুলে দেয়া হয়নি : মুসুল্লিদের ক্ষোভ
    পরবর্তী নিবন্ধধর্মীয় গোষ্ঠীকে দাঁতভাঙা জবাব দেওয়ার হুমকি ও আসিফ নজরুলকে ‘কুকুর’ সম্বোধন লেখক ভট্টাচার্যের