ফিলিস্তিনের ছোট্ট একটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ড. আব্দুল্লাহ ইউসুফ আযযাম রহিমাহুমুল্লাহ। এই ছোট্ট গ্রামের বালকই একদিন হয়ে উঠেন জিহাদি আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব। যাকে পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা “বৈশ্বিক জিহাদ আন্দোলনের জনক” বলেই পরিচয় করিয়ে দেয়।
সাম্প্রতিক ইতিহাসে রাজনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সামরিক উভয় দিক থেকেই তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছেন। তিনি শুধু একজন যুগশ্রেষ্ঠ আলেমই ছিলেন না বরং একজন যুগশ্রেষ্ঠ মুজাহিদও ছিলেন। যার বক্ত্রিতা, ফতোওয়া ও লিখনী পড়ে লক্ষ লক্ষ তরুণ আলোর দিশা পেয়েছে। যিনি অনান্য আলেমের মত শুধু এসি রুমে বসে লিখনি ফতোওয়া আর লেকচার দিয়েই ক্ষান্ত ছিলেন না বরং স্বশরীরে অংশ নিয়েছেন এক রণাঙ্গণ থেকে অন্য রণাঙ্গণে। ইনশাআল্লাহ্! আজ আপনাদের সাথে এমন একজন আলেমকেই পরিচয় করিয়ে দিব।
জন্ম ও প্রাথমিক শিক্ষা :
নাম আবদুল্লাহ ইউসুফ আজম, ১৯৪১ সালে দখলদার ইসরাইলী ইহুদীদের পদভারে রক্তাক্ত ও পরাধীন ফিলিস্তিনের আসবাহ আল হারতিয়াতে জন্মগ্রহণ করেন, যা এখনো ফিলিস্তিনের সীমানার মধ্যেই রয়েছে। আসবাহ আল হারতিয়া ফিলিস্তিনের জেনিন প্রদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী গ্রাম। পারিবারিকভাবে তিনি ইসলামী আকীদা-বিশ্বাসের উপর লালিত হন। ভালোবাসতে শিখেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে, আল্লাহর পথে জিহাদে রত বীর বাহাদুরদেরকে, সৎকর্মপরায়ণ ব্যক্তিদেরকে। আখিরাতের চিন্তা-ফিকির আর শাহাদাতের তামান্না শৈশব থেকেই তার চরিত্রে ফুটে উঠতে থাকে। আর এভাবেই তিনি শৈশব থেকেই বুদ্ধিবৃত্তিক দিক দিয়ে সামনে আসতে থাকেন।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের লেখাপড়া সুনামের সাথেই শেষ করেন তিনি। এরপর তিনি এগ্রিকালচারাল কাদরী কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই ডিপ্লোমা ডিগ্রি লাভ করেন। যৌবনে, তিনি অধ্যয়নরত অবস্থায় মুসলিম ব্রাদারহুডের জর্ডান শাখায় যোগদান করেন। তিনি ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলনের সংগঠন প্রতিষ্ঠায়ও ভূমিকা রাখেন। এদিকে ১৯৬৭ সালে ইহুদীরা পশ্চিম তীর দখল করে নেয়, রক্তে রঞ্জিত হয় পশ্চিমতীর, ফলে আযযাম এবং তাঁর পরিবার ঐবছরের তীব্র যুদ্ধের পরে সম্পূর্ণরূপে ফিলিস্তিন ছেড়ে জর্ডানে বসতি স্থাপন করতে বাধ্য হন।
দামেস্ক থেকে প্যালেস্টাইন :
আবদুল্লাহ আযযাম রহ. ফিলিস্তিন এবং জর্ডানে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ করেন এবং ১৯৬৩ সালে দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি শরিয়ার উপর অধ্যয়ন করতে শুরু করেন। ১৯৬৬ সালে তাঁর স্নাতক অর্জন পর্যন্ত, তিনি দামেস্কে গুরুত্বপূর্ণ অনেক ব্যক্তির সাথে দেখা করেন এবং তাদের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলেন।
স্নাতক শেষ করে তিনি পূণরায় দেশে ফিরে আসেন। তবে এসময় তিনি ফিলিস্তিনের জাতিয়তাবাদী প্রতিরোধ বাহিনী ও মার্কসবাদী কাঠামো থেকে দূরে থাকেন। তাদের থেকে নিজেকে নিরাপদ রেখেই তিনি দখলদার ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আধাসামরিক যুদ্ধে জড়িত হন। তবে তখন তিনি ফিলিস্তিনে মুসলিম ব্রাদারহুডের অধীনে থাকতে এবং এই সংগঠনের মধ্যমে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পছন্দ করেছিলেন। এই মনোভাব পরবর্তীতে তাকে ফিলিস্তিনী প্রতিরোধ বাহিনী হামাস প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা পালন করতে পরিচালিত করে।
মিশর সফর ও আল-আজহার :
তাঁর পিপাসার্ত মন তখনো ছিল অস্থির-উতলা। তাই তিনি কিছুদিন পর আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা চালিয়ে যাওয়ার জন্য মিশরে যান। এখানে শরিয়ার উপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করার পর তিনি আবারো জর্ডানে ফিরে আসেন এবং আম্মান বিশ্ববিদ্যালয়ে তার শিক্ষাজীবন শুরু করেন। আবদুল্লাহ ইউসুফ আযযাম ১৯৭১ সালে আল-আজহারে তার শিক্ষাজীবন অব্যাহত রাখেন এবং ১৯৭৩ সালে ফিকাহ বিষয়ে ডক্টরেট সম্পন্ন করেন।
এরপর তিনি আবারো ফিলিস্তিনী ফিরে আসেন এবং দেড় বছর ফিলিস্থিনের জিহাদে অতিবাহিত করেন। অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে জিহাদের কার্যক্রম চালিয়ে যান তিনি। কিন্তু তিনি এখানে এসে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। কারন তিনি দেখতেন, যারা ফিলিস্তিনের জিহাদে রত তাদের অনেকেই ইসলাম থেকে দূরে সরে আছে। মাঝে মধ্যেই তিনি দুঃখ করে বলতেন, ফিলিস্তিনকে মুক্ত করার জন্য এটা কোন ধরনের জিহাদ হচ্ছে, যেখানে মুজাহিদ ভাইয়েরা প্লেইং কার্ড, গান শোনা আর টেলিভিশনের অশ্লিল ছবি দেখে রাত কাটিয়ে দিচ্ছে! তাই তিনি তাদেরকে ইসলামের পথে পরিচালিত করতে চেষ্টা করেন। কিন্তু তারা তাকে প্রতিহত করত এবং বাধা দিত। যার ফলে শাইখ আব্দুল্লাহ আযযাম রহ. খুবই দুঃখ-ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে ফিলিস্তিনের রনাঙ্গন ত্যাগ করেন।
সেই বছরগুলিতে, তিনি সৌদি আরবে চলে যান, যেখানে সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান এবং মিশরের মতো অনেক দেশ থেকে আগত প্রশিক্ষক এবং শিক্ষাবিদদের থেকে তিনি ইলম গ্রহণ করেন; ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত সেখানে তিনি শিক্ষাজীবন চালিয়ে যান। এরপর জেদ্দার কিং আব্দুল আজিজ ইউনিভার্সিটিতে তিনি শিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত হন, আর সেখানে শিক্ষক থাকাকালীন তিনি ওসামা বিন লাদেনের সাথে দেখা করেন, যিনি সেখানে একজন ছাত্র ছিলেন।
আফগানিস্তান :
১৯৭৯ সালে আবদুল্লাহ আযযামের জন্য একটি টার্নিং পয়েন্ট ছিল, যেমনটি ছিল সমগ্র ইসলামী বিশ্বের জন্য। ইরান বিপ্লব, আফগানিস্তান যুদ্ধ এবং কাবা রেইডের মতো ঘটনাগুলি দেখিয়েছিল যে, বিশ্বে একটি নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। বিশেষ করে কাবা রেইডের পর সৌদি আরব সরকার পবিত্র ভূমি থেকে জিহাদী ধারণা পোষণকারীদের অপসারণকে ত্বরান্বিত করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আবদুল্লাহ আযযামকেও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়।
এর পরে, আযযাম আফগানিস্তানের যুদ্ধকে ঘনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করার জন্য পাকিস্তানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, যা ২৫ ডিসেম্বর, ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের আক্রমণের সাথে একটি ভিন্ন মাত্রায় পরিণত হয়। এসময়েই তিনি তাঁর ঐতিহাসিক “মুসলিমদের ভূমির প্রতিরক্ষা” নামে একটি ফতোয়া জারি করেন, যেখানে তিনি বলেছিলেন যে “দাখলদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ প্রতিটি মুসলমানের জন্য ফরজ”।
তার পরেই তিনি পাকিস্তানে হিজরত করেন এবং ইসলামাবাদের ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটিতে প্রথমে শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন। পরে তিনি আফগানিস্তানের আরও কাছাকাছি হওয়ার চিন্তায় পেশোয়ারে চলে আসেন। এই বছরগুলিতে পেশোয়ার ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র যা “মুজাহিদিন” বাহিনীর পিছনের অংশ তৈরিতে বড় ভূমিকা পালন করেছিল, যেখানে আফগান যুদ্ধের প্রতিধ্বনি সবচেয়ে স্পষ্টভাবে শোনা গিয়েছিল। এর কয়েক বছর পর, আবদুল্লাহ আযযাম তার শিক্ষকতা জীবনকে একপাশে রেখে শুধুমাত্র আফগান যুদ্ধে আত্মনিয়োগ করেন। আযযাম এখন সেই ব্যক্তি হিসাবে সামনে আসতে থাকলেন, যিনি এই অঞ্চলে আরব-অনরাব মোটকাথা বিদেশী যোদ্ধাদের পরিচালনা ও প্রশাসনিক কাঠামো পরিচালনা করেছিলেন।
মাকাতিব আল-খাদমাহ :
পেশোয়ারে অবস্থানকালে তিনি এই অঞ্চলে আসা বিদেশী মুজাহিদদের বসতি স্থাপন, অর্থায়ন, প্রশিক্ষণ এবং প্রশাসনিক কাজে সহায়তা করার জন্য পেশোয়ারে “মাকাতিব আল-খাদমাহ” গঠন করেন। এরপর শাইখের প্রতিষ্ঠিত মাকাতিব আল-খাদমাহ আফগানিস্তানে হাজার হাজার বিদেশী যোদ্ধা প্রেরণে এবং আফগানিস্তান যুদ্ধে আর্থিকভাবে সহায়তা করতে বড় ভূমিকা পালন করতে শুরু করে।
১৯৮১ সালে এই অঞ্চলে শাইখ ওসামা বিন লাদেনের আগমনে শাইখ আযযাম ও তার প্রতিষ্ঠিত মাকাতিব আল-খাদমাহ-এর তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। কেননা বিন লাদেন অনেক ধনী হওয়ায় তিনি মাকাতিব আল-খাদমাহকে প্রচুর পরিমাণে আর্থিক এবং যৌক্তিক সবধরণের সাহায্য করতে শুরু করেছিলেন।
শাইখ আব্দুল্লাহ আযযাম ও তার প্রিয় শিষ্য উসামা বিন লাদেন পেশোয়ারে অবস্থানকালে মাকাতিব আল খিদমাহ-এর অধিনে আফগান মুজাহিদদের সব ধরনের সাহায্য সহযোগিতা করতে থাকেন এবং নতুন মুজাহিদদের পাকিস্তানে প্রশিক্ষণ দিয়ে আফগানিস্থানে সম্মুখ যুদ্ধে প্রেরণ করতেন।
আফগান রণাঙ্গন :
এর পরবর্তীতে সায়েখ আরও অগ্রসর হয়ে জিহাদের প্রথম কাতারে গিয়ে শামিল হন, হাতে তুলে নেন অস্ত্র। ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন সম্মুখ লড়াইয়ে। অসীম সাহসিকতায় তিনি তখন বীরের মত যুদ্ধ করতে লাগলেন। ছুটে চললেন এক ফ্রন্ট থেকে আরেক ফ্রন্টে। এসময় তিনি আফগানিস্তানের অধিকাংশ প্রদেশে ছুটে যান। লোগার, কান্দাহার, হিন্দুকুশ পর্বতমালা, পাঞ্জশির উপত্যকা, কাবুল আর জালালাবাদে ছুটে চললেন বিরামহীন গতিতে। ফলে আফগান রণাঙ্গনের সাধারণ যোদ্ধা ও মুজাহিদদের সাথে তার পরিচয় হয়, সখ্যতা হয়, বন্ধুত্ব হয়। সবাই তাকে তাঁর হৃদয়ের উদারতা, জিহাদী জযবা, আল্লাহর রাহে জীবন দেয়ার আকুতি, মুসলিম উম্মাহর দরদী ব্যাক্তিত্ব্যের কারণে মনপ্রাণ দিয়ে ভালবাসতে থাকে। মহব্বত করতে থাকে।
এরপর তিনি আবার ফিরে আসেন পেশোয়ারে। বাস্তব অভিজ্ঞতায় এবার তিনি একেবারে টইটুম্বুর। গোটা আফগান রণাঙ্গনের সমস্যা-সমাধান তাঁর মস্তিষ্কের কোষে কোষে। জিহাদের এই কাফেলাকে সঠিক পথে পরিচালনার ও চুড়ান্ত বিজয়ের পথে নিয়ে যাওয়ার তামান্নায় তিনি অধীর অস্থির। তাই মুজাহিদদের মাঝে সংস্কারমূলক বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন। মুজাহিদদের পরিশুদ্ধ করতে লাগলেন। জিহাদের পথে নানা বিভ্রান্তির আলোচনা করতে লাগলেন। বিভক্ত মুজাহিদদের গ্রুপগুলোকে একই কাতারে নিয়ে আসতে আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলেন। কেঁদে কেঁদে দুআ করতে লাগলেন। যারা কখনো জিহাদের কাতারে শামিল হয়নি, সম্মুখ লড়াইয়ে অংশ নেয়নি তাদের প্রথম কাতারে শামিল হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে লাগলেন।
আফগান মুজাহিদ নেতাদের মাঝে তাঁর প্রভাব ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ, অত্যন্ত প্রশংসনীয়। তাই সবাই তাকে হৃদয় দিয়ে ভালবাসতেন। তাঁর প্রস্তাব, পরিকল্পনাকে কেউ অগ্রাহ্য করতে পারত না।
এরপর তিনি মুসলিম উম্মাহকে আফগান জিহাদের ব্যাপারে জাগ্রত করার দিকে মনোনিবেশ করেন। আফগান জিহাদের পবিত্র আহবানকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে ছুটে যান বিশ্বের বহু দেশে। সাক্ষাৎ করেন জাতীয় নেতৃবৃন্দ, রাজনীতিবীদ, চিন্তাবীদ, দার্শনিক ও সমাজসেবক ব্যক্তিত্বদের সাথে। সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে অগ্নিঝরা বক্তৃতা দিতে থাকেন। চারদিকে ছুটতে থাকে অনল প্রবাহ। তিনি দ্বীনের হেফাজতের জন্য, শত্রুদের হাত থেকে মুসলমানদের লুণ্ঠিত ভূমিকে উদ্ধারের জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। এর ফাঁকে সমান তালে ছুটতে থাকে তার কলমও। তিনি জিহাদ বিষয়ে বেশ কয়েকটি পুস্তকও রচনা করেন, যা এখনো পাঠককে আন্দোলিত করে, আলোড়িত করে, জিহাদের পথে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করে।
শহীদ ড. আব্দুল্লাহ আযযামের অবিরাম প্রচেষ্ঠা, মেহনত-মুজাহাদা সফলতার আলো দেখতে পায়। তিনি বিশ্বের মুসলমানদেরকে আফগান জিহাদের ব্যাপারে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করাতে সক্ষম হন। ফলে আফগান জিহাদ শুধু আফগান জনতার মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে না। বরং তা আন্তর্জাতিক রুপ লাভ করে এবং বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মুসলমানরা আফগান জিহাদে অংশগ্রহণ করতে ছুটে আসতে থাকে। তারা ইহুদী-খৃস্টানদের হাতে নিপীড়িত-নির্যাতিত মুসলিম মা-বোনদের উদ্ধারে শপথ গ্রহণ করতে থাকে এবং প্রত্যেক লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করতে থাকে।
তিনি তার মানসপটে একটি চিত্রই এঁকেছিলেন। তা হল, জিহাদের মাধ্যমে খিলাফতের পুন:প্রতিষ্ঠা করা। তিনি বিশ্বাস করতেন এবং বারবার বলতেন, পৃথিবীর বুকে খিলাফত প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত জিহাদ চালিয়ে যেতে হবে। তাই তিনি বহুবার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার প্রস্তাবকে অকুণ্ঠ চিত্তে প্রত্যাখান করেছেন। আর দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন, তিনি ততণ পর্যন্ত জিহাদ চালিয়ে যাবেন যতণ পর্যন্ত হয় তিনি শহীদ হবেন, নতুবা তাকে হত্যা করা হবে।
আফগান রণাঙ্গন ছিল তাঁর স্বপ্নের চারণভূমি। তাই তিনি বলতেন, আমি কখনো জিহাদের ভূমি পরিত্যাগ করব না, তিনটি অবস্থা ছাড়া। হয় আমি আফগানিস্তানে নিহত হব, নতুবা পেশোয়ারে নিহত হব, নতুবা হাত বাঁধা অবস্থায় আমাকে পাকিস্তান থেকে বহিস্কার করা হবে।
একদিন মিম্বরে খুতবা দানকালে তিনি বললেন, “আমি মনে করি আমার প্রকৃত বয়স হচ্ছে নয় বছর। সাড়ে সাত বছর কেটেছে আফগান জিহাদে আর দেড় বছর কেটেছে ফিলিস্তিনের জিহাদে। এছাড়া আমার জীবনের বাকী সময়গুলোর কোন মূল্য আমার কাছে নেই।”
শাইখ আব্দুল্লাহ আযযাম একজন উত্তম চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তি ছিলেন। ধর্মানুরাগ, আল্লাহর উপর নির্ভরশীলতা, সংযমশীলতা ছিল তাঁর চারিত্রিক অলংকার। তিনি কখনো কারো সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করতেন না। তরুণদের তিনি ভিন্ন চোখে দেখতেন। তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। সব ধরনের ভয়-ভীতি মাড়িয়ে হৃদয়ের সুপ্ত প্রতিভাকে জাগ্রত করতে উদ্বুদ্ধ করতেন। তিনি নিয়মিত সিয়াম পালন করতেন। বিশেষ করে দাউদ আলাইহিস সালামের সুন্নাহ অনুযায়ী অর্থাৎ একদিন সিয়াম পালন করতেন আরেকদিন বিরত থাকতেন। এভাবে তিনি সারা বছর সিয়াম পালন করতেন। সোমবার ও বৃহস্পতিবার তিনি সিয়াম পালন করতেন এবং অন্যদেরও এ দু’দিন সিয়াম পালন করতে উৎসাহিত করতেন।
এদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পরাজয়ের সাথে শেষ হওয়া আফগানিস্তানের যুদ্ধে প্রধান ভূমিকা পালনকারী শাইখ আযযামকে এই যুদ্ধের মাধ্যমে সারা বিশ্ব বৈশ্বিক জিহাদী আন্দোলনের জনক হিসাবে দেখা শুরু করেছিল। আফগানিস্তানে আসা বিদেশী যোদ্ধাদের এই সংগঠনটি পরে আল-কায়েদা নামে পরিচিত হয়েছে এবং আজ অবধি বিশ্বব্যাপী নির্যাতিত মুসলিমদের পাশে দাড়িয়ে জালিমদের পতিহত করার পরিবেশের ভিত্তি তৈরি করছে। এদিকে, শাইখ আযযাম তখনও বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে, বিশেষ করে ফিলিস্তিনের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিলেন। তিনি ফিলিস্তিনে হামাস প্রতিষ্ঠার সময় এবং পরে এই আন্দোলনকে সহায়তাও করেছিলেন। যদিও পরবর্তিতে এই আন্দোলনটিও ভুল পথে হাটতে শুরু করেছে।
১৫ ফেব্রুয়ারী, ১৯৮৯ সালে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের সেনা প্রত্যাহার একটি চিহ্ন ছিল যে ১০ বছরের যুদ্ধ একটি নতুন যুগে বিকশিত হতে যাচ্ছে। “মুজাহিদিন” গোষ্ঠীগুলি মাঠে আধিপত্য বিস্তার করেছিল, দেশটি মূলত তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন পরাজিত হয়েছিল। এর অর্থ হল, শাইখ আযযামের স্বপ্ন বাস্তবায়নে বিদেশী যোদ্ধাদের জন্য একটি নতুন পথ এবং বেশিরভাগ আরবদের জন্য একটি নতুন দিগন্ত আঁকা। কিন্তু ইসলামের শত্রুরা এটা কখনোই হতে দিবে না, তাই তারা ষড়যন্ত্র শুরু করল।
ষড়যন্ত্র, আবদুল্লাহ ইউসুফ আজমের শাহাদাত :
সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান থেকে যখন পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে দেশ ছাড়ছিল, তখন “মুজাহিদিন” গ্রুপগুলোর মধ্যে বিভাজন শেষ করার জন্য কাজ করছিলেন শাইখ আযযাম, যা প্রায় শেষ দিকে ছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ান ও ইসলামের অন্যান্য শত্রুরা এটা কখনোই চায়নি। কেননা শাইখ আযযাম এই কাজে সফল হওয়া মানে ফিলিস্তিন সহ বিশ্বের অন্যান্য পরাধীন মুসলিম ভূমিগুলো মুক্ত করার আন্দোলন দুর্বার গতিতে ছড়িয়ে পড়বে। ফলে কাফেররা শাইখকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। এই লক্ষ্যে তারা শাইখের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মিসন চালায়।
২৪ নভেম্বর, ১৯৮৯ তারিখে, পেশোয়ারের পশ্চিমে একটি মসজিদে খুতবা দিতে যাচ্ছিলেন শাইখ আবদুল্লাহ আযযাম। এসময় পথেই তার গাড়িটি একটি বিস্ফোরক ডিভাইস দিয়ে লক্ষ্যবস্তু করা হয়। আর তাতেই শাইখ আবদুল্লাহ ইউসুফ আযযাম এবং তার দুই ছেলে শাহাদাত বরণ করেন। পরে শহীদ শাইখ আযযাম ও তাঁর ছেলেদের পেশোয়ারে দাফন করা হয়।
শহিদ শাইখ আযযামের (রহ.) হত্যার পর, আফগানিস্তানে স্থানীয় গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে পূণরায় বিভাজন আরও গভীর হয়, যা দেশটি গৃহযুদ্ধের দিকে টেনে নিয়ে যায়।
শাইখের শাহাদাতের পর ক্রুসেডার মার্কিন, দখলদার ইসরায়েলি ইহুদী এবং জর্ডানের গোয়েন্দাদের অনেক কারণেই এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী করা হয়েছিল। বিশেষ করে এই কারণে যে, আবদুল্লাহ আযযাম রহিমাহুল্লাহ্ আফগানিস্তানের পর ফিলিস্তিনকে নিজের লক্ষ্য হিসাবে দেখেছিলেন।
আজকের এই দিনেই উম্মাহর এই মহান বীর শত্রুদের হামলার লক্ষবস্তুতে পরিণত হয়েছিল। আধুনিক বৈশ্বিক জিহাদ ও উম্মাহর মুক্তির জন্য জীবন উৎসর্গকারী এই মহান মুজাহিদ ও আলেমকে উম্মাহ সবসময় গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে।
আমি মনে করি তিনিই ছিলেন এই শতাব্দীর মুজাদ্দিদ দ্বয়ের মধ্য থেকে একজন, যাঁর খেদমত সারা বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত ছিল, এবং উম্মাহর জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে তিনিই সর্বপ্রথম আবির্ভূত হয়েছিলেন।