“لصوت القعقاع في الجيش خيرٌ من ألف رجل.”
“সেনাদলে কা’কার এক হুঙ্কার অন্য এক হাজার লোকের চেয়েও শক্তিশালী”! [আবু বকর সিদ্দীক( রাঃ)]
অষ্টম হিজরীর রমাজান মাস। পবিত্র মক্কা নগরীতে ইসলামের বিজয় কেতন উড্ডীন হয়। মক্কা বিজয়ের পর আরবের বিভিন্ন গোত্র দলে দলে আসতে থাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে। যাঁর কথা এবং যাঁর আনীত দ্বীনের কথা তারা এতদিন পর্যন্ত লোকমুখে শুনে আসছিল, এখন সময় এসেছে সেই মহামানবের সান্নিধ্যে এসে তাঁর আনীত দ্বীনের অনুসারী হওয়ার। যারা ইসলামের যথার্থতা অনুধাবন করা সত্ত্বেও মক্কার মুশরিকদের ভয়ে বা ইসলামের দুর্বলতাকে অজুহাত বানিয়ে তা গ্রহণ করা থেকে বিরত ছিল, তারাও এখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইসলাম গ্রহণ করছে। নবম হিজরিতে এত অধিক পরিমাণ “ওয়াফদ“ রাসূল সাল্লাল্লাহুয়ালাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দরবারে এসে ইসলাম গ্রহণ করে যে, সীরাতের গ্রন্থগুলোতে এই বছরকে “ওয়াফদের বছর“ নামে অভিহিত করা হয়।
হযরত কা’কা (قَعْقَاعْ) ইবনে আমর আত তামিমি ছিলেন বনু তামিম গোত্রের শাখা গোত্র, বনু উসাইদের বাসিন্দা। হিজরী নবম বছরে অন্যান্য গোত্রের মত বনু তামিম গোত্র থেকেও একটি ওয়াফদ এসে ইসলাম গ্রহণ করে। এই মহা নেয়ামত থেকে বঞ্চিত হননি হযরত কা’কা ইবনে আমর (রাঃ)ও। যেহেতু তিনি নবম হিজরিতে, তাবুক যুদ্ধের পর ইসলামের দৌলত লাভ করেছিলেন তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে যুদ্ধ করার সুযোগ তাঁর হয়নি৷ কিন্তু খোলাফায়ে রাশেদার শাসনামলে তিনি বীরত্বের যে ইতিহাস রচনা করেছেন তা আজও তাঁকে স্মরণীয় করে রেখেছে। আজও ইতিহাস তাঁকে স্মরণ করে একজন শ্রেষ্ঠ বীর হিসেবে।
যুদ্ধের ময়দানে পদার্পণ :
______________
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওয়াফাতের পর হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) ইসলামের প্রথম খলীফা নির্বাচিত হন। আরবের বিভিন্ন গোত্রে তখন রিদ্দার মারাত্মক ফেতনা ছড়িয়ে পড়ছে। বিচক্ষণ খলীফা হযরত আবু বকর (রাঃ) তরবারির পথ বেছে নেন। যেখানেই ফেৎনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চায়, সেখানেই তাঁর বাহিনী পৌঁছে যায়। ইসলামের নেয়ামত পাওয়ার পর, তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার একমাত্র শাস্তি হলো মৃত্যুদণ্ড। তাঁর এই দৃঢ়তার ফলে অল্পদিনেই আরব শান্ত হয়ে যায়। রিদ্দাহর এই যুদ্ধগুলোতে কা’কা ইবনে আমর (রাঃ) স্বতঃস্ফূর্ত শরীক ছিলেন। তাঁর বীরত্বে খলীফা আবু বকর সন্তুষ্ট ছিলেন।
রিদ্দাহর যুদ্ধ থেকে অবসর হয়ে তিনি দৃষ্টি দেন তৎকালীন বিশ্বের সুপার পাওয়ার রোম ও পারস্যের দিকে৷ পথপ্রদর্শনকারী কিতাব এবং তা প্রতিষ্ঠাকারী তরবারি নিয়ে সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) ছড়িয়ে পড়েন পৃথিবীর আনাচে কানাচে। ইতিহাসের পাতায় বীরত্বের নব অধ্যায়ের রচয়িতা, হযরত খালিদ ইবনুল ওয়ালিদের দক্ষ নেতৃত্বে প্রতিটি রণাঙ্গনেই কাফেররা লজ্জাজনক পরাজয় বরণ করতে থাকে। দ্রুতগামী দূতের মাধ্যমে মদীনায় বসে বসে রণাঙ্গনের সব খবরাখবর পেতে থাকেন খলীফা আবু বকর (রাঃ) ।
১২ হিজরী মোতাবেক ৬৩৩ খ্রিস্টাব্দে, হযরত খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ (রাঃ) ইরাকের প্রসিদ্ধ শহর হীরা (যা পারস্য সাম্রাজ্যের অধিভুক্ত ছিলো) অবরোধ করেন। এবং সার্বিক পরিস্থিতি খলীফাকে জানিয়ে সাহায্যের আবেদন করেন। হযরত আবু বকর (রাঃ) খালিদকে সাহায্য করার জন্য হযরত কা’কা (রাঃ)কে প্রেরণ করেন। উপস্থিত লোকদের মনোভাব বুঝতে পেরে তাদেরকে এই বলে আশ্বস্ত করেন, “সেই বাহিনী কখনোই পরাজিত হতে পারে না, যেখানে কা’কার মত বীর আছে।“
বাস্তবেই হযরত আবু বকর (রাঃ) এর এই উক্তি অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হয়েছিল। দ্বীনের এই অকুতোভয় সৈনিক রোম ও পারস্যের প্রতিটি রণাঙ্গন চষে বেড়িয়েছেন। ফাতহে শাম, ফাতহে দিমাশক্ব, ফাতহে মিশর, ইয়ারমুকের যুদ্ধ, কাদিসিয়া ও জালুলার যুদ্ধসহ এক রণাঙ্গন থেকে অপর রণাঙ্গনে ছুটে চলেছেন প্রতিনিয়ত। আল্লাহর অশেষ রহমতে সবগুলো যুদ্ধেই মুসলিমরা বিজয়ী হয়েছেন।
দিমাশকের রণাঙ্গনে কা’কা ইবনে আমর (রাঃ) :
______________________________
হযরত আবু উবাইদাহ ইবনুল জাররাহ ও খালিদ ইবনুল ওয়ালিদের নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী দিমাশক অবরোধ করেন। প্রায় ৭০ দিন (১) পর্যন্ত স্থায়ী হয় এই অবরোধ। একদিনের ঘটনা। শহরের ভেতর এক রোমক কমাণ্ডারের সন্তান জন্মলাভকে কেন্দ্র করে খানাপিনার আয়োজন করা হয়। ফলে শহরবাসী আনন্দ উদযাপনে ব্যস্ত। বিচক্ষণ কমাণ্ডার হযরত খালিদ ইবনুল ওয়ালিদের কাছে পৌঁছে যায় এই সংবাদ। তিনি কতগুলো রশি নেন। কা’কা ইবনে আমর ও মাযউর ইবনে আদীর সহযোগিতায় রশিগুলো শহরের প্রাচীরের দিকে ছুঁড়ে মারেন। প্রাচীরের মজবুত গ্রীলে দুটি রশি আটকে যায়। বাকি রশিগুলোর এক মাথা হাতে নিয়ে কা’কা ইবনে আমর আর মাযউর ইবনে আদী রশি বেয়ে উঠে যান প্রাচীরের উপর। সবগুলো রশি আটকে দেন প্রাচীরের গ্রীলে। এবার মুসলিম সৈন্যরা রশি বেয়ে বেয়ে প্রাচীরে উঠতে থাকেন। বাধা দিতে আসা রোমকদের হত্যা করতে করতে তারা পৌঁছে যান প্রধান ফটকের কাছে। ফটক খুলে দেওয়ার সাথে সাথে মুসলিমরা ঢুকে পড়েন শহরের ভেতর৷ এভাবেই রোমকদের শক্তিশালী এ দুর্গটির পতন ঘটে।(২)
কাদিসিয়ার রণাঙ্গনে হযরত কা’কা ইবনে আমর (রাঃ) :
________________________________
১৪ হিজরির মুহাররাম মাস। ইসলামী খিলাফতের গুরুদায়িত্ব হযরত উমর ফারুক (রাঃ) এর কাঁধে ন্যস্ত। ইরাকের মাটিতে পারসিকদের বিরুদ্ধে মুসলিমদের যুদ্ধ শুরু হয়েছে হযরত আবু বকর (রাঃ) এর খিলাফত-কালেই। হযরত উমর ফারুক (রাঃ) পারসিকদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত যুদ্ধের সিন্ধান্ত নিলেন। তাই হযরত সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রাঃ) এর নেতৃত্বে মুজাহিদদের একটি বাহিনী প্রেরণ করলেন ইরাক অভিমুখে। পূর্ব থেকেই ইরাকের মাটিতে মুসান্না ইবনে হারেসার(রাঃ) নেতৃত্বে ৮ হাজার মুজাহিদ ছিল। যুদ্ধের দ্বিতীয় দিন শাম থেকে হাশেম ইবনে উতবার নেতৃত্বে ৬ হাজার মুজাহিদ এসে মিলিত হলে সর্বসাকুল্যে মুসলিম বাহিনীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৪০ হাজারের কাছাকাছি। পারস্যের শাসনক্ষমতা তখন ইয়াযদগিরদের হাতে। মুসলিম উম্মাহর পারস্য দখলের সাধ চিরতরে মিটিয়ে দিতে খ্যাতিমান কমাণ্ডার রুস্তম ও বাহমানের যৌথ নেতৃত্বে প্রায় ২ লাখের এক বিশাল বাহিনী কাদিসিয়া অভিমুখে যাত্রা করে ইয়াযদগিরদের নির্দেশে। উভয় বাহিনী মিলিত হয় কাদিসিয়ার প্রান্তরে। টানা চারদিন চলে রক্তক্ষয়ী এ যুদ্ধ।
খলীফা উমরের নির্দেশে আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ (রাঃ) শাম থেকে হাশেম ইবনে উতবার নেতৃত্বে ইরাকী বাহিনীকে (৩) ফেরৎ পাঠান। যুদ্ধের দ্বিতীয় দিন তারা কাদিসিয়ার রণাঙ্গনে পৌঁছেন। এই বাহিনীর মুকাদ্দামাতুল জাইশের (৪) নেতৃত্ব ছিলো কা’কা ইবনে আমরের হাতে। তাঁকে দেখে হযরত সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রাঃ) যারপরনাই আনন্দিত হন। বাহিনীর প্রত্যেকেই তাঁকে পেয়ে আনন্দিত হয়। কারণ তাঁর বীরত্ব কারো অজানা ছিল না।
কা’কা ইবনে আমর (রাঃ) হযরত সা’দ (রাঃ) এর থেকে অনুমতি নিয়ে ময়দানে নামেন এবং দ্বন্দ্ব যুদ্ধের জন্য আহ্বান করেন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে শত্রুদল থেকে বাহমান বেরিয়ে আসে। মুহূর্তের মধ্যেই তাকে জাহান্নামের দুয়ারে পৌঁছে দেন কা’কা ইবনে আমর। পরপর আরো কয়েকজন বাহাদুর বেরিয়ে আসলে তিনি তাদেরকেও জাহান্নামের টিকেট ধরিয়ে দেন। মুসলিমদের তাকবীর ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে কাদিসিয়ার প্রান্তর। এরপর শুরু হয় মূল যুদ্ধ।
দ্বিতীয় দিনের এই যুদ্ধে এক হাজার মুসলিম শাহাদাত বরণ করেন। বিপরীতে কাফেরদের নিহত হয় দশ হাজার যোদ্ধা। এই দিন হযরত কা’কা (রাঃ) কাফেরদের বড় বড় সর্দার এবং প্রসিদ্ধ বীর-বাহাদুরদের খুঁজে খুঁজে হত্যা করেন। যুদ্ধের দ্বিতীয় দিনে কা’কার একটি কৌশল কাফেরদের অন্তরে ভয় ধরিয়ে দেয়। তিনি তাঁর বাহিনীকে ছোট ছোট দলে বিভক্ত করে দূরের একটি টিলার আড়ালে লুকিয়ে রাখেন এবং কিছুক্ষণ পর পর এক একটি দলকে ময়দানে আসতে নির্দেশ দিয়ে রাখেন। এর ফলে কাফেররা মনে করে, একটু পর পর মদীনা থেকে মুসলিমদের জন্য বড় ধরনের সাহায্য আসছে৷ ফলে তারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে৷
কা’কা ইবনে আমরের অভিনব কৌশল :
_______________________
যুদ্ধের তৃতীয় দিন। সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রাঃ) গোয়ান্দাদের সূত্রে আগেই জানতে পেরেছিলেন যে, আগামীকাল পারসিকরা ময়দানে বিশালাকৃতির হাতি ব্যবহার করবে। যুদ্ধের প্রথম দিনেও তারা হাতি ব্যবহার করেছিল। যার ফলে প্রথম দিনের যুদ্ধে মুসলিমদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। কারণ, আরবের যোদ্ধাদের ইতিপূর্বে কোনো ময়দানেই হাতির মুখোমুখি হতে হয়নি এবং আরবের ঘোড়াগুলোও কখনো হাতি দেখেনি। ফলে হাতির মোকাবিলা করার কৌশল কারো জানা ছিল না। অপরদিকে হাতি দেখলেই আরবের ঘোড়াগুলো সামনে যেতে চাইতো না। তাছাড়া হাতিগুলো পদাতিক যোদ্ধাদের জন্য সবচেয়ে বেশি বিপদজনক ছিল। প্রথম দিনের যুদ্ধে হাতির পায়ের নিচে পড়েই শহীদ হয়েছিলেন অনেক মুসলিম সেনা। সেই হিসেবে যুদ্ধের তৃতীয় দিন ময়দানে হাতি থাকবে-এই তথ্য মুসলিমদের জন্য কোনো ভালো সংবাদ ছিল না। আগ-পিছ চিন্তা করে কা’কা ইবনে আমর একটি কৌশল বের করলেন, যা সকলকে খুব মুগ্ধ করল। তিনি বললেন, আমরা আমাদের উটগুলোর উপর কালো কাপড় পেঁচিয়ে হাতির বিপরীতে ময়দানে নামাতে পারি। তাই করা হল। উটের উপরে কালো কাপড় দিয়ে উঁচু হাওদা তৈরী করা হল। তা এত উঁচু ছিল যে, দেখতে হাতির চেয়ে বড় কোনো প্রাণী মনে হচ্ছিল। উটের পুরা দেহ কালো কাপড়ে ঢাকা ছিল। যুদ্ধের তৃতীয় দিনে পারসিকদের হাতির মোকাবিলায় এই উটগুলোকে ময়দানে নামানো হল। ফলে পারসিকদের ঘোড়াগুলো ভয়ে পিছু হটতে আরম্ভ করল। অনেক ঘোড়া আরোহীদের ফেলে দিয়ে দিগ্বিদিক ছুটাছুটি শুরু করল।
কা’কা ইবনে আমরের হাতির মোকাবিলা :
________________________
মুসলিমদের উটের কারণে পারসিক-ঘোড়াগুলোর যে অবস্থা ছিল, তাদের হাতিগুলোর কারণে মুসলিম-ঘোড়াগুলোর অবস্থা কোনোদিক থেকে ব্যতিক্রম ছিল না। ঘোড়াগুলো সামনে বাড়ছিল না। হাতিগুলো পদাতিক যোদ্ধাদের পিষে মারছিল বা শুঁড় দিয়ে আছড়ে মারছিল। ফলে মুসলিমদের সারিগুলো তছনছ হয়ে যাচ্ছিল। অবস্থা বেগতিক দেখে কা’কা ইবনে আমর তাঁর বাহিনী নিয়ে এগিয়ে আসলেন। সবাইকে হাতির চোখে তীর মারার নির্দেশ দিয়ে তিনি ঘোড়া থেকে নেমে এগিয়ে গেলেন। তার সাথে আছেন তাঁর সহোদর হযরত আসেম ইবনে আমর (রাঃ)। এই দুই সহোদর তরবারি ও বর্শা নিয়ে হাতিগুলোর সর্দার সবচেয়ে বড় ও সাদা হাতিটির উপর বীরবিক্রমে ঝাপিয়ে পড়েন। অত্যন্ত সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে তাঁরা হাতিটিকে হত্যা করেন। এবার কাফেরদের হাতির কৌশল ভেস্তে গেল। একদিকে হাতিগুলোর চোখ তীর বিদ্ধ, অপরদিকে সর্দার হাতিটির করুণ অবস্থা, সব মিলিয়ে ওদের হাতিগুলো উর্ধশ্বাসে পেছনের দিকে ছুটে। অবস্থা এই হয় যে, হাতিগুলো খোদ পারসিকদেরকেই পিষে মারছিল। আপন-পরের তারতম্য তারা হারিয়ে ফেলেছিল। এভাবে তাদের হাতিগুলো তাদের জন্যই বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং মুসলিমদের জন্য যুদ্ধের ময়দান সম্পূর্ণরূপে হাতি মুক্ত হয়ে যায়। এই যুদ্ধের মাধ্যমেই পারসিকদের দম্ভ মিটে যায় এবং মাদায়েন শহর ইসলামী সালতানাতের অধীন হয়।
যুদ্ধের পরে একবার হযরত উমর (রাঃ) সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, কাদিসিয়ার যুদ্ধে কোন অশ্বারোহী সবচেয়ে বেশি বীরত্ব প্রদর্শন করেছে?
উত্তরে সা’দ লিখেছিলেন, “আমি কা’কা ইবনে আমরের মত আর কাউকেই দেখিনি, সে একদিনে শত্রুর উপর ৩০ বারও আক্রমণ করেছে এবং প্রত্যেক আক্রমণেই পারসিকদের কোনো না কোনো সেনাপতিকে হত্যা করে এসেছে।”
ইসলামের মহান এই বীর তাঁর গোটা জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন জিহাদের ময়দানে। স্বস্তির সাথে নিঃশ্বাস নেওয়ার সুযোগ পাননি কখনো। ইরাক থেকে ইয়ারমুক, ইয়ারমুক থেকে শাম, শাম থেকে কাদিসিয়া, কাদিসিয়া থেকে মাদায়েন, সেখান থেকে জালুলা-এভাবে প্রতিটি রণাঙ্গন দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। হযরত আলী ও মু’আবিয়া (রাঃ) এর মাঝে খিলাফত নিয়ে দ্বন্দ্ব হলে তিনি আলী (রাঃ) এর পক্ষ নিয়ে যুদ্ধ করেন। জঙ্গে জামালের পূর্বে আলী (রাঃ) তাঁকে কুফায় পাঠিয়েছিলেন আম্মাজান আয়েশা এবং তালহা ও যুবাইর (রাঃ) কে বোঝানোর জন্য৷ তিনি তাঁদের সঙ্গে হিকমতপূর্ণ কথা বলেছিলেন। ফলে কুফা শান্ত হয়ে যায়। কিন্তু খারেজিদের ষড়যন্ত্রে তা স্থায়ী হয়নি।
ইসলামের এই সাহসী সৈনিক হযরত মু’আবিয়া (রাঃ) খিলাফতকালে কুফা নগরীতে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে জান্নাতের অধিবাসী হন। রাযিয়াল্লাহু আনহু!
প্রাপ্ত নাসীহা
এক.
ফাতহে মক্কা এবং পরবর্তী ইসলামের সাড়ে ১৪ শত বছরের ইতিহাস এটা প্রমাণ করে যে, বিজয়ের পরেই মানুষ অধিক হারে ইসলাম গ্রহণ করে থাকে। নাইন এলিভেনের বরকতময় হামলার পর সমগ্র বিশ্বে বিপুল পরিমাণ মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ছাড়া একটি জাতির শিক্ষা-দীক্ষা, সভ্যতা-সংস্কৃতি কীভাবে প্রকাশিত হতে পারে? অনেকেই দুনিয়া বিরাগীতার দোহাই দিয়ে বলতে চান, আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সৃষ্টি করেননি। আমরা তাদের সাথে একমত হতে পারছি না।
দুই.
যারা শুধু যাকাত দিতে অস্বীকার করেছিল তাদের বিরুদ্ধে আবু বকর (রাঃ) এর জিহাদ পরিচালনা এটা প্রমাণ করে যে, বর্তমান যুগের মুরতাদ শাসকদের বিরুদ্ধে জিহাদের পথ অবলম্বন করার কোনো বিকল্প হতে পারে না। তারা তো শুধু বাইতুল মালে যাকাত দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল, আর এরা তো আল্লাহর দ্বীনকেই পরিবর্তন করে ফেলেছে। আল্লাহর আইনের বিপরীতে নতুন নতুন আইন প্রণয়ন করে সে অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। এদের বিরুদ্ধে হযরত আবু বকর (রাঃ) কতটা কঠোর হতেন-চিন্তা করা যায়?
সাহাবায়ে কেরামের কর্মপন্থা পরিহার করে এই উম্মাহ কখনোই সফল হতে পারবে না!
তিন.
জিহাদের ময়দানে শত্রুর অন্তরে ভয় ধরানোর মাধ্যমে বিজয় ত্বরান্বিত হয়। কাদিসিয়ার ময়দানে হযরত কা’কা ইবনে আমর (রাঃ) আমাদের জন্য সে শিক্ষাই রেখে গেছেন।
চার.
দ্বীনের পথের মুজাহিদ যিনি হবেন তার কোনো বিশ্রাম নেই। এক ময়দান থেকে তিনি ছুটে যাবেন অপর ময়দানে। ঈমান ও কুফরের সঙ্ঘাত চলবে আর মুজাহিদ ঘরে বসে থাকবে-এটা হতেই পারে না। কা’কা ইবনে আমর (রাঃ) এর জীবনীতে আমাদের জন্য এই শিক্ষাই রয়েছে।
পাঁচ.
বিচক্ষণ সেনাপতি যারা হন, তারা শত্রুর উদাসীনতা থেকে ফায়েদা লুটে নেন। যেমনটি করেছিলেন হযরত খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ (রাঃ)।
ছয়.
কৌশলে শত্রুর অন্তরে ভীতি সৃষ্টি করা, তাদের মনোবল ভেঙে দেওয়া যুদ্ধ-জয়ের একটি অন্যতম উপায়।
নোট
(১) কারো মতে এই অবরোধ ছয় মাস স্থায়ী হয়েছিল।
(২) এটি আল কামিল ফিত তারিখের বর্ণনা। কোনো কোনো কিতাবের বর্ণনা থেকে বোঝা যায়, খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ সন্ধির মাধ্যমে দিমাশক জয় করেছিলেন।
(৩) এই বাহিনীকে ইরাকি বাহিনী বলা হয়-কারণ, মদীনা থেকে এই বাহিনীকে ইরাকেই প্রেরণ করা হয়েছিল। ইয়ারমুকের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য তাদেরকে সাময়িকভাবে শামে পাঠানো হয়েছিল।
(৪) মূল বাহিনীর অগ্রগামী বাহিনীকে মুকাদ্দামাতুল জাইশ বলে। মূল বাহিনীর জন্য রাস্তাকে শত্রু মুক্ত করা তাদের দায়িত্ব। কা’কার সাথে আসা মুকাদ্দামাতুল জাইশে এক হাজার সেনা ছিল।
লেখক ও সংকলক : মুফতি আব্দুল্লাহ মুনতাসির
তথ্যসূত্র
(১) আল ইসাবাহ ফী তাময়ীযিস সাহাবাহ।
(২) উসদুল গাবাহ।
(৩) আল ইসতিয়াব ফী মা’রিফাতিল আসহাব।
(৪) আল কামিল ফিত তারিখ।
(৫) তারিখে ইসলাম।