আসামে উচ্ছেদ অভিযানের নামে গোটা মুসলিম গ্রাম ধূলিসাৎ : মুসলিম উচ্ছেদের ভবিষ্যৎ প্রভাব কি?

2
1205

কিছুদিন পর পরই হিন্দুত্ববাদী আসাম সরকার মুসলিম বাসিন্দাদের আবাস স্থলে বিভিন্ন অযুহাতে উচ্ছেদ অভিযান চালায়।  আসাম জুড়ে মাদ্রাসায় বুলডোজার চালানোর মাঝেই এবার গরিব মুসলিমদের ঘরবাড়িতে বুলডোজার চালিয়েছে আসামের হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার।

গত ০৩ সেপ্টেম্বর শনিবার শোনিতপুর জেলার বড়সলা বিধানসভা এলাকার চিতলমারী গ্রামের অন্তত ৩০০টি বাড়ি বুলডোজার দিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছে জেলা প্রশাসন। গত বছর দরং জেলার গোরুখুঁটিতে বিরাট সংখ্যক পরিবার উচ্ছেদের পর গত শনিবার বড়গলাতে বহু মুসলিম পরিবারকে উচ্ছেদ করেছে হিন্দুত্ববাদী রাজ্য সরকার।

ব্রহ্মপুত্র নদীর উত্তর তীরে, বর্তমানে বিজেপি বিধায়ক হিন্দুত্ববাদী গণেশ কুমার লিম্বুর প্রতিনিধিত্বে বারচাল্লা বিধানসভা কেন্দ্রের ৩ নং চিতলমারি মুসলিম এলাকায় এই অভিযান চালানো হয়েছে। পুলিশ দিয়ে গ্রামবাসিকে ঘিরে রেখে প্রায় ৫০টি এক্সিবেটর দিয়ে মুসলিমদের বাড়িঘর এবং অন্যান্য স্থাপনা ভেঙে ফেলা হয়েছে।

সরকার বরাবরের মতো এবারও উচ্ছেদ করা পরিবারগুলিকে বেদখলকারী আখ্যা দিয়েছে। উচ্ছেদ হওয়া মানুষদের অভিযোগ, চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর ধরে তাঁরা এই গ্রামে বসবাস করছেন। তাঁরা মোটেই সরকারি খাস জমি দখল করেননি। অনেকের হাতে জমির দলিল কাগজপত্র সবই আছে। বেশ কিছু পরিবার সরকারি আবাস, বিদ্যুৎ ইত্যাদি পেয়েছে।

দক্ষিণ শিশুগুড়ি পঞ্চায়েতের চিতলমারী গ্রামে উচ্ছেদ অভিযান নিয়ে অনেকদিন ধরেই কানাঘুষা চলছে। উচ্ছেদের ভয় দেখিয়ে বিজেপি ভোটও আদায় করেছে। অনেক আশায় বোকা মুসলিমরা বিজেপি বিধায়ক হিন্দুত্ববাদী গণেশ কুমার লিম্বুকে ভোট দিয়েছে। উচ্ছেদ হওয়া এক বাসিন্দা বলেন, ‘বিজেপি’কে ভোট দিলে উচ্ছেদ করা হবে না বলে গত বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বিজেপি নেতারা। তা বিশ্বাস করে গ্রামের মানুষ বিজেপি’কেই ভোট দিয়েছেন। বিজেপি প্রার্থী গণেশ লিম্বু এখানে জয়ীও হয়েছে। কিন্তু ভোটে জিতে বিজেপি কথা রাখল না।’

গ্রামের মানুষরা বলেন, “সাত মাস আগে উচ্ছেদের নোটিস ধরিয়ে দেয় জেলা প্রশাসন। নোটিস পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় বিজেপি বিধায়ক গণেশ লিম্বুর কাছে আমরা ছুটে যাই। সেদিন বিধায়ক লিম্বু আবারো প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছিল এই নোটিস ভুলবশত দেওয়া হয়েছে। গ্রামের মানুষ নিশ্চিত্তে থাকতে পারেন। এখানে উচ্ছেদ হবে না।” বিধায়কের আশ্বাসে গ্রামবাসীরা নিশ্চিন্তেই ছিলেন।

কিন্তু চারদিন আগে ৩১ আগস্ট প্রশাসন থেকে গ্রামে মাইকিং করে বলা হয় তিন দিনের মধ্যে বাড়ি ছাড়তে হবে। এই ঘোষণার পরের দিন এখানে পুলিশ আসতে শুরু করে। শুক্রবার প্রায় এক হাজার পুলিশ দিয়ে পুরো গ্রাম ঘিরে ফেলা হয়। একইসঙ্গে পৌঁছে যায় বুলডোজার, ট্যাক্টর ইত্যাদি। থমথমে যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি করা হয় সেখানে। শনিবার ভোর ছ’টা থেকে বুলডোজার দিয়ে একের পর এক বাড়ি ধ্বংস করা শুরু হয়। ভেঙে ফেলা হয় সবকিছু।

বেশিরভাগ মানুষই শিশু-বৃদ্ধদের নিয়ে সড়কের ধারে আশ্রয় নিয়েছেন। চোখের সামনে সারা জীবনের অর্জন, দিন শেষে মাথা গোজার আশ্রয়স্থল নিজের বাড়ি ভেঙে ফেলার দৃশ্য দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন সকলেই। ভিটেবাড়ি থেকে উচ্ছেদ হয়ে দুশ্চিন্তায় কয়েকজন মহিলা জ্ঞান হারিয়েছেন, অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। পিটিআই নিউজ এজেন্সিকে একজন মহিলা বলেছেন, “আমরা এখানে কয়েক দশক ধরে বাস করছি। আমাদের এখন কোন কাজ নেই এবং আমরা এখানে মাঠের বাইরে থাকি। আমরা কোথায় যাব জানি না।”

জেলা প্রশাসন থেকে বলা হয়েছে, চিতলমারী গ্রামের ৮৬৪ বিঘা জমি দখলমুক্ত করা হয়েছে। গ্রামের মানুষকে উচ্ছেদ করে এখানে একশো মেগাওয়াটের সোলার পাওয়ার প্রজেক্ট বসাবে রাজ্য সরকার। হিন্দুত্ববাদী পুলিশের বিশেষ মহাপরিচালক জ্ঞানেন্দ্র প্রতাপ সিং বলেছে, রাজ্য সরকার ওই স্থানে একটি সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা করছে। তাই তাদের উচ্ছেদ করা হয়েছে।

কিন্তু দূঃখজনক হল হিন্দুত্ববাদী প্রশাসন ক্ষতিগ্রস্থ মুসলিমদের কোন ক্ষতিপূরণ কিংবা অন্য জায়গায় আবাসনের ব্যাবস্থা করেনি। তাই উচ্ছেদ হয়ে নিরুপায় হয়ে পড়েছেন তারা। এখন তারা কোথায় যাবেন কিছুই জানেন না।

ক্ষমতায় এসে গরিব মুসলিমদের উপর বুলডোজার চালানোকে প্রধান কর্মসূচি বানিয়েছে মুসলিম বিদ্বেষী আসামের বিজেপি সরকার। গত সাড়ে ছয় বছরে নানা অজুহাতে লক্ষাধিক মুসলিমকে ভিটেমাটি ছাড়া করেছে হিন্দুত্ববাদীরা। প্রবল মুসলিম বিদ্বেষের কারণে তাদের কথিত হাইকোর্টের নিষেধ অমান্য করে অভিযান চালিয়েছেে উগ্রবদী হেমন্ত বিশ্ব শর্মা সরকার। এমনকি পুনর্বাসন ছাড়া উচ্ছেদ করা যাবে না বলে হাইকোর্টের স্পষ্ট নির্দেশ থাকলেও, মুসলমানদের বেলায় তা গ্রাহ্যই করছে না তারা।

২০২১ সালের অক্টোবরে উচ্ছেদ চলাকালীন আসাম পুলিশ উচ্ছেদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী গ্রামবাসীদের উপর গুলি চালিয়েছিল। দারাং জেলার সিপাঝার এলাকায় হিন্দুত্ববাদী কর্তৃপক্ষের হাতে একজন নাবালক ছেলেসহ দুই মুসলমান খুন হয়েছিল। পুলিশের উপস্থিতিতেই তখন সাংবাদিক পরিচয়ের এক উগ্র হিন্দুকে নিহত মুসলিমের লাশের উপর তাণ্ডবনৃত্য চালাতে দেখা যায়।

হেমন্ত বিশ্ব শর্মার নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার কথিত দখলের সরকারি জমির প্লটগুলি সাফ করতে যাদেরকে উচ্ছেদ করেছে, তাদের মধ্যে অধিকাংশই দরিদ্র, বাংলাভাষী এবং এমন মুসলিম- যারা আগে বন্যা ও ভাঙনে জমি হারিয়েছে।

মুসলিম নিধনে আসাম কেন পছন্দ হিন্দুত্ববাদীদের?

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মুসলিমমুক্ত করার মিশনে বিজেপি কাশ্মীরের পরেই আসামকে কেন বেছে নিয়েছে? যদিও সারা ভারতই তাদের মুসলিম-নিধনযজ্ঞ বাস্তবায়ন প্রকল্পের আওতাধীন; তবে আসামের মুসলিম নিধন বাস্তবায়ন প্রকল্প শুরুর দিকে চালু করার বিশেষ কিছু দিক রয়েছে।

ইংরেজ আমলের অনেক আগে থেকেই আসামে বাংলা ভাষাভাষী মুসলিমরা অভিবাসিত হয়েছেন, সেখানে গড়ে তুলেছেন স্থায়ী বসতি। আর এখান থেকে মুসলিমদেরকে যেকোন অজুহাতে বিতাড়িত করতে পারলে আসাম-পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশসহ গোটা অঞ্চলে একটি অরাজক পরিস্থিতি তৈরি হবে; আমরা তখন বাংলাদেশমুখী আসামের মুসলিমদের ঢল দেখতে পারি হয়তো। আর সেই সাথে হিন্দুত্ববাদীদের পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী ‘সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা’র নাটকও মঞ্চস্ত হতে দেখা যেতে পারে। তখন কিন্তু যেকোন দেশের যেকোন স্থানে সেনা মোতায়েন করার সুযোগ পেয়ে যাবে ভারত, আর হিন্দুত্ববাদীদের অখণ্ড ভারত মিশন বাস্তবায়ন করাটাও সহজ হয়ে যাবে। মূলত এই প্রেক্ষাপটটাই তৈরি করতে চাইছে উগ্র হিন্দুত্ববাদী ভারত।

ইতিপূর্বে আসামে এনআরসি ঘোষণা করে প্রায় ১৯ লাখ লোকের নাম বাদ দেয় হিন্দুত্ববাদীরা। পরে সেখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হিন্দুর নাম চলে আসায় আবার সিএএ বিল ঘোষণা করে অমুসলিমদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করা হয়। অর্থাৎ উচ্ছেদ করা হবে শুধু মুসলিমদেরকে, হচ্ছেও তাই। উগ্র হিন্দু নেতারা আসাম ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে মুসলিমদের উচ্ছেদ করে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার ঘোষণা দিচ্ছে, আর বাংলাদেশের মাথামোটা দালাল রাজনীতিকরা বলছে যে, এটা নাকি ভারতের ‘অভ্যন্তরীণ’ বিষয়। অথচ তারা নিজেরাই সাক্ষী যে মিয়ানমারের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ এই অঞ্চলে কি ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। আর আসাম-পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি একবার ঘোলাটে হলে তা হবে আরও ভয়াবহ।

তাই বলা যায়, কাশ্মীর ও আসামে হিন্দুত্ববাদের নিরঙ্কুশ প্রতিষ্ঠা মানেই গোটা উপমহাদেশে হিন্দুত্ববাদের কালো বিজয়, যা থেকে রেহাই পাবে না বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মুসলিমরাও। বিপরিতদিকে, কাশ্মীর ও আসামে উগ্র হিন্দুত্ববাদের এই অভ্যুত্থানকে রুখে দিতে পারলে, গোটা উপমহাদেশকেই হিন্দুত্ববাদের কালো থাবা থেকে মুক্ত করা যাবে ইনশাআল্লাহ্‌। ইসলামি চিন্তাবিদগণ তাই মুসলিমদেরকে এই বিষয়টি মাথায় রেখে পরিস্থিতি অনুধাবন করতে এবং সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি নিতে বলেছেন; কারণ অনিবার্য এই সংঘাত এখন খুবই নিকটবর্তী।



লেখক : উসামা মাহমুদ



 

তথ্যসূত্র :

1. Assam: Massive eviction drive underway to clear encroached land in Sonitpur after madrassa demolition
https://tinyurl.com/2c9erfw8
2. Assam: Massive eviction drive underway in Sonitpur, Bengali Muslims at the receiving end (Maktoob Media)
https://tinyurl.com/yatk3jxw
3. VIDEO LINK:
https://tinyurl.com/yatk3jxw
4. Massive Eviction Drive Underway Amid Tight Security In Assam, 299 Families Vacate 330 Acres Of Land
https://tinyurl.com/3fayadbm

2 মন্তব্যসমূহ

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধসমাপ্তির পথে যুদ্ধবিরতি: টিটিপি’র হামলায় হতাহত ১৯, ব্যাপক যুদ্ধের দামামা
পরবর্তী নিবন্ধউত্তর বুরকিনা ফাঁসোতে আল-কায়েদার হামলা : হতাহত ২৮ এর বেশি শত্রুসৈন্য