কাশ্মীর, বিশ্বের সবাচাইতে বিরোধপূর্ণ একটি অঞ্চল, সবচেয়ে বেশি সামরিকায়িত অঞ্চলও এটি। ১৯৪৭-এর দেশ ভাগের সময় থেকে নিয়ে আজও এখানে গোলযোগপূর্ণ পরিস্থিতি বিরাজমান। কাশ্মীরি মুসলিমদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তখনকার রাজা হরি সিং কাশ্মীরকে যুক্ত করে দেয় ভারতের সাথে। হিন্দুত্ববাদীরা তখন থেকেই একের পর এক বিশ্বাসঘাতকতা শুরু করে কাশ্মীরিদের সাথে। কখনও গণভোট তো কখনও শিমলা চুক্তি- একের পর এক বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে কাশ্মীরি মুসলিমদের উপর তারা চালাতে থাকে দমন-নিপীড়ন। সবশেষে ১৯৮৮ সাল থেকে কাশ্মীরিরা শুরু করে তাদের স্বাধীনতা আন্দোলন। সেই সময় থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত কাশ্মীরি মুসলিমদের উপর খুন, ধর্ষণ, লুটপাট, ভাংচুর, বিচার বহির্ভূত খুন, অঙ্গ অপসারণ, মানবপাচার, গণধর্ষণ ইত্যাদি নানা ধরণের অপরাধ কর্মকাণ্ড চালায় হিন্দুত্ববাদীরা। এই সকল অপরাধ কর্মকাণ্ডের মধ্যে তেমনই একটি হলো “চিকিৎসা সেবায় ঘটতি” সৃষ্টি।
কাশ্মীরে “চিকিৎসা সেবায় ঘটতি” সৃষ্টিকে দখলদার হিন্দুত্ববাদীরা মুসলিমদের বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধের একটি কৌশল হিসেবে ব্যবহার করে। তারা মনে করে যে, কাশ্মীরি মুসলিমরা হয়তো চিকিৎসা না পেয়ে হিন্দুত্ববাদীদের কাছে গিয়ে আবেদন করবে। কিন্তু কাশ্মীরি মুসলিমরা এত সহজেই হারার পাত্র নয়। তারা উল্টো আজীবন হিন্দুত্ববাদীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাবার শপথ নেয়।
কাশ্মীরে হিন্দুত্ববাদীরা ওষুধের অভাব এতটাই প্রকট করে তুলেছে যে, সেখানের অনেক মুসলিম বাসিন্দারাই স্থানীয় ফার্মেসিগুলোর বাইরে দীর্ঘক্ষণ ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেও ওষুধ কিনতে পারে না। ১৯৯০ সালের আগে সেখানকার জনসংখ্যার প্রায় ৭৫ ভাগ মুসলিম কোনরকম আশেপাশের ফার্মেসিগুলো থেকে তাদের প্রয়োজনীয় ওষুধ সংগ্রহ করতে পারলেও ‘৯০’ পরবর্তীতে চিত্রটি একদমই ভিন্ন। বর্তমানে সেই সংখ্যাটা এখন কমে এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১০ থেকে ১৫ ভাগে।
হিন্দুত্ববাদী ভারত সরকার ওষুধ এবং ফার্মাসিউটিক্যালস সহ চিকিৎসা সরবরাহের সমস্ত নিয়মিত চালান বন্ধ করে দিয়েছে। ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানীর বেশ কয়েকজন প্রতিনিধিরা বলেন যে, ‘ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনস’ (যা কাশ্মীরের ভিতরে ও বাইরে যাওয়ার একমাত্র বিমান সংস্থা) শ্রীনগরের জন্য লেবেলযুক্ত কোন প্রকার চালান এখন আর গ্রহণ করে না। কিছু কিছু ডাক্তাররা জানান যে, মুসলিমদের বিরুদ্ধে এটি তাদের একটি যুদ্ধ কৌশল ছাড়া আর কিছুই নয়।
তারা আরও জানান, দখলদাররা আশা করে যে, কাশ্মীরিরা যখন চিকিৎসা পাবে না তখন হয়তো হতাশ হয়ে পড়বে এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে দোষারোপ করবে। এরপর গিয়ে দখলদার কর্তৃপক্ষের কাছে সাহায্যের আবেদন করবে। কিন্তু তাদের এই ধারণা ভুল। উল্টো কাশ্মীরি মুসলিমরা দখলদারদের উপরই তাদের ক্ষোভ ও ঘৃণা প্রকাশ করে। সেই সাথে তাঁরা এও অঙ্গীকার করে যে, দখলদারদের বিরুদ্ধে তাঁরা সংগ্রাম চালিয়ে যাবে আজীবন।
কাশ্মিরের সমস্ত হাসপাতাল অপারেট করে প্রয়োজনীয় মৌলিক সরঞ্জামাদি ছাড়াই। অক্সিজেন, এক্স-রে মেশিন, মনিটর, অ্যানেস্থেটিক্সের [১] জন্য প্রয়োজনীয় নাইট্রাস অক্সাইড- কোন কিছুই নেই সেই হাসপাতালগুলোতে। এমনকি প্রসূতি হাসপাতালেও নেই কোন শ্বাসযন্ত্র। হাসপাতালগুলোতে অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে ইন্ট্রাভেনাস অ্যাড্রেনালিন [২] এবং স্টেরয়েডগুলো [৩]। “সৌর মেডিক্যাল ইনস্টিটিউটের” সিএটি (CAT) স্ক্যান [৪] ভেঙে পড়ে আছে গত তিন বছর ধরে। মৌলিক ইলেক্ট্রোলাইটস [৫] এবং সিরাম রসায়ন [৬] পরিমাপের জন্য ব্যবহৃত রসায়ন পরীক্ষাগারের একমাত্র যন্ত্রটি অকেজো হয়ে পড়ে আছে প্রায় দুই বছর ধরে। শ্রীনগর মেডিকেল কলেজের ছয়টি এক্স-রে মেশিনের মধ্যে কাজ করে মাত্র দুটি।
এভাবেই চলছে কাশ্মীরি মুসলিমদের জীবন। তারা খোলা আকাশের নিচে আছে ঠিকই, কিন্তু এই খোলা আকাশের নিচেই তারা আজ বন্দী। তারা সেখানে নিঃশ্বাস নিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তাদের হিসেব দিতে হচ্ছে তাদের প্রতিটি নিঃশ্বাসের। মৌলিক অধিকার বলতে কাশ্মীরে আজ নেই কিছুই। তাইতো দখলদার হিন্দুত্ববাদীদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাকামী কাশ্মীরি মুসলিমরা আজ লড়াই করছে তাদের মুক্তির জন্য, তাদের স্বাধীনতার জন্য, তাদের শরীয়তের জন্য, এবং তাদের ভূখণ্ডের সার্বভৌমত্বের জন্য।
টীকাঃ
[১] অনুভূতিনাশকের জন্য ব্যবহৃত এক ধরণের ইনজেকশন
[২] প্রসূতি নারীদের জন্য ব্যবহৃত এক ধরণের মেশিন
[৩] চিকিৎসা বিদ্যায় ব্যবহৃত পরিভাষা
[৪] রোগীদের সারা শরীর পরীক্ষার জন্য এক ধরণের মেশিন
[৫], [৬] চিকিৎসা বিদ্যায় ব্যবহৃত পরিভাষা
মূল লেখক : উইলিয়াম ডব্লিও বেকার (William W. Baker)
অনুবাদক : আবু-উবায়দা
তথ্যসূত্র :
বইঃ কাশ্মীর হ্যাপি ভ্যালী, ভ্যালী ওফ ডেথ (Kashmir Happy Valley, Valley of Death) [Page: 58-59];
প্রকাশনীঃ ডিফেন্ডার্স পাবলিকেশন্স আইএনসি (Defenders Publications, INC.)
প্রথম প্রকাশিতঃ ১৯৯৪
ভাইজান আমার একটা চ্যানেল আছে আমি কি আপনার এই পোস্ট গুলো ভিডিও আকারে ডাবিং করতে পারবো? দয়া করে জানাবেন