১৯৯৬ সালে দখলদার রাশিয়া এবং এর দালাল শাসকদের হটিয়ে আফগানিস্তানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ইসলামি ইমারত। কিন্তু সেসময় মাত্র ৩টি মুসলিম দেশ ব্যতীত আর কেউই এটির স্বীকৃতি দেয়নি। বরং আফগানিস্তানে সন্ত্রাসী আমেরিকা বিশ্বের সকল পরাশক্তি তাবেদারদের নিয়ে আগ্রাসন চালায় আফগান মুসলিমদের ওপর। মসজিদ-মাদ্রাসা, বাড়িঘর, জনসমাগমের স্থান যেমন: বিয়ে, জানাযা, বাজার সর্বত্র চলে তাদের বোমাবর্ষণ।
২০ বছরব্যাপী আমেরিকান দখলদারিত্ব এবং জুলুমের বিরুদ্ধে আফগান মুসলিমদের জিহাদ এবং বহু ত্যাগের পর ২০২১ সালের ১৫ আগষ্ট গোটা আফগানিস্তানে আবারো ইসলামি ইমারাত বাস্তবায়িত হয়। ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে ইসলামি ইমারত পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর অল্প সময়ের মধ্যেই আফগানিস্থানে শান্তি, নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করে যাচ্ছে তালিবান সরকার। চুরি-ছিনতায়ি, দুর্নীতি, ধর্ষণসহ সকল সামাজিক অপরাধ একদম শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে আলহামদুলিল্লাহ্। বিশ্ববাসী যখন আফগানে শরিয়াহ ভিত্তিক শাসন ব্যাবস্থার সুফলের সাক্ষী হচ্ছে, ঠিক সেসময় তথাকথিত নারী অধিকার ও মানবাধিকারের অজুহাতে ইমারতে ইসলামিকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে পশ্চিমা ক্রুসেডার ও তাদের অনুগত দালাল শাসকগোষ্ঠী।
অন্যদিকে বরাবরের মতোই কথিত জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং পশ্চিমা রাষ্ট্রসমুহ এর বিরোধিতা করে যাচ্ছে। কোনো রাষ্ট্রই আফগানিস্তানে ইসলামি ইমারাতকে স্বীকৃতি দিচ্ছে না। বরং অপপ্রচার আর মিথ্যা প্রোপাগাণ্ডার আশ্রয় নিয়ে বিরোধিতা করে যাচ্ছে।
যে মার্কিনী ও ন্যাটো বাহিনী হাজার হাজার মুসলিম নারীর সম্ভ্রমহানী করেছে, যারা প্রতিদিন গড়ে ৫ জন আফগান শিশুকে বোমা মেরে হত্যা করেছে, তারাই এখন কথিত নারী অধিকার ও শিশু অধিকারের দোহাই তুলে আফগান ইসলামি ইমারতকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপের মুখে রেখেছে। আবার, আফগান জনগনের বিলিয়ন ডলার অর্থ আটকে রেখে ও আত্মসাৎ করে সেই নারী-শিশুদেরকেই তারা ক্ষুধার্ত রাখছে, দুরভিক্ষের মুখে ঠেলে দিয়েছে। অপরদিকে না তারা নিজেরা ইসলামি ইমারতকে স্বীকৃতি দিচ্ছে, আর না অন্য দেশগুলোকে স্বীকৃতি দিতে দিচ্ছে। মুসলিম ভূখণ্ডের দালাল শাসকগোষ্ঠীও তাদের প্রভু ক্রুসেডারদের অনুসরণ করে নিশ্চুপ রয়েছে।
ইমারাতে ইসলামিয়া আফগানিস্তানের স্বীকৃতির ব্যাপারে পশ্চিমা সন্ত্রাসী রাষ্ট্রসমুহের অবস্থান:
১। যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অফ স্টেট অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিল যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমন কোনও সরকারকে স্বীকৃতি দেবে না যারা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে আশ্রয় দেয় বা কথিত মৌলিক মানবাধিকার সমুন্ত রাখে না।
২। অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রী মারিস পেনের মতে, ‘তালেবানের নেতৃত্বাধীন আফগান প্রশাসনের সাথে জড়িত থাকার জন্য আমরা কোনো প্রতিশ্রুতি দিই না।’ অস্ট্রেলিয়া তার জনগণ, তার অঞ্চল এবং গোটা বিশ্বের প্রতি তার দায়িত্ব পালনের জন্য তালেবান এবং ভবিষ্যতের যেকোনো আফগান প্রশাসনের উপর চাপ বজায় রাখার আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টাকে সমর্থন করবে।
৩। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেছে, ‘কানাডা ইমারাতে ইসলামিয়্যাকে আফগানিস্তানের বৈধ সরকার হিসেবে স্বীকৃতি দেবে না এবং তালেবান কানাডায় একটি নিষিদ্ধ সংগঠন হিসেবে থাকবে।’
৪। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ইমারাতে ইসলামিয়্যাকে আফগানিস্তানের বৈধ সরকার হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়ার জন্য অন্য দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব ডমিনিক রাব বলেছেন যে যুক্তরাজ্য ‘কাবুলের নতুন সরকার হিসাবে তালেবানকে স্বীকৃতি দেবে না।’
৫। স্পেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রী জোসে ম্যানুয়েল আলবারেস ঘোষণা করেছে, ‘দেশটি শক্তি দ্বারা চাপিয়ে দেওয়া তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেবে না।’
৬। রাশিয়া বলেছে, ‘তারা তালেবানদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলার আশা করছে, এটাও বলেছে যে তাদেরকে দেশের শাসক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার কোনো তাড়া নেই।’
৭। চেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যাকব কুলহানেক বলেছে, ‘চেক প্রজাতন্ত্র কোন অবস্থাতেই তালেবানকে স্বীকৃতি দেবে না।’
৮। ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জিন-ইভেস লে ড্রিয়ান বলেছে, ‘ফ্রান্স এই সরকারের সাথে কোনো ধরনের সম্পর্ককে স্বীকৃতি দিতে বা রাখতে চাই না।’
অপরদিকে ১৯৪৮ সালের ১৪ মে যেদিন ফিলিস্তিনের উপর দখলদার ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের মেয়াদ শেষ হয়, সেদিনই ব্রিটিশদের সহায়তায় জায়নবাদী ইহুদিরা আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ও স্বাধীনতা ঘোষণা করে। স্বাধীনতা ঘোষণার মাত্র এগারো মিনিট পর সন্ত্রাসবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়। আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান স্বীকৃতি প্রদান করে। এর তিন দিন পর তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়। এবং ইসরাইলকে ১৯৪৯ সালের ১১ মে কথিত জাতিসংঘ এর ৫৯তম সদস্য হিসাবে ইসরাইলকে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া হয়। এছাড়াও, জাতিসংঘের ১৯৩ টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে অন্তত ১৬৭ টি রাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে দখলদার সন্ত্রাসী ইসরাইলকে স্বীকৃতি প্রদান করে।
১৪ মে ১৯৪৮ সালে ইসরাইল প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ১৯৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মাত্র আট মাসে যেসব রাষ্ট্র দখলদার ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়, সেগুলো হলো:
যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, নিকারাগুয়া, চেক প্রজাতন্ত্র, স্লোভাকিয়া, সার্বিয়া, পোল্যান্ড, উরুগুয়ে, হাঙ্গেরি, দক্ষিন আফ্রিকা, রোমানিয়া, কোস্টারিকা, ফিনল্যান্ড, পানামা, প্যারাগুয়ে, হন্ডুরাস, বুলগেরিয়া ও ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্র।
১৯৪৯ সালে জানুয়ারি-মে মাত্র ৫ মাসে ৩৩টি দেশ স্বীকৃতি দেয়, সেগুলো হলো:
সুইডেন, ফ্রান্স, বলিভিয়া, সুইজারল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, হাইতি,অস্ট্রেলিয়া, চীন, নিউজিল্যান্ড, গ্রীস, কলম্বিয়া, অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, তুরস্ক, ইকুয়েডর, আলবেনিয়া, নরওয়ে, কানাডা, চিলি, ইউক্রেন, বেলারুশ, ইতালি, উরুগুয়ে, পেরু, নেদারল্যান্ডস, আইসল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ, লাইবেরিয়া, ফিলিপাইন, আয়ারল্যান্ড, মেক্সিকো ও আর্জেন্টিনা।
১১ মে ১৯৪৯ থেকে – ২০২২ পর্যন্ত ৯৭ টি দেশের স্বীকৃতি:
বেলজিয়াম, সিঙ্গাপু্র, এস্তোনিয়া, ফিজি, আর্মেনিয়া, শ্রীলংকা, বাহামাস, আজারবাইজান, ভারত, গ্রেনাডা, অ্যাঙ্গোলা, থাইল্যান্ড, সুরিনাম, ইরিত্রিয়া, জাপান, পর্তুগাল, ভিয়েতনাম, মায়ানমার, টোঙ্গা, মোজাম্বিক, লাওস, সামোয়া, মরিশাস, সেনেগাল, ডমিনিকা গ্যাবন নাইজেরিয়া, তুর্কমেনিস্তান, নেপাল, মিশর, সাও টোমে, ডিআরসি,সেন্ট ভিনসেন্ট, কলম্বিয়া ,অ্যান্টিগুয়া ও বারবুডা,ক্যামেরুন, সেন্ট কিটস ও নেভিস, নামিবিয়া, কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, কিরিবাতি, গিনি-বিসাউ, টুভালু, এন্ডোরা, সাইপ্রাস, বেলিজ, কেপ, ভার্দে, আইভরি কোস্ট, স্পেন, মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ, বুর্কিনা ফাসো, পোলাও, ইথিওপিয়া, মঙ্গোলিয়া, বেনিন, লিচেনস্টাইন, জর্ডান, জ্যামাইকা, লাটভিয়া, নাউরু, ত্রিনিদাদ, লিথুয়ানিয়া, সান মারিনো, দক্ষিণ কোরিয়া, উজবেকিস্তান, কেনিয়া, কিরগিজস্তান, মোনাকো, ক্রোয়েশিয়া, মালাউই, হার্জ, মালটা, স্লোভেনিয়া, জর্জিয়া, তৈমুর, বার্বাডোজ, মলদোভা, মন্টিনিগ্রো, সোয়াজিল্যান্ড, সেশেলস, দক্ষিণ সুদান, মেসিডোনিয়া, সংযুক্ত আরব-আমিরাত, বাহরাইন, ভুটান ও কসোভা।
দখলদার ইসরাইলি ইহুদিরা প্রতিনিয়ত ফিলিস্তিনি মুসলিমদের হত্যা, উচ্ছেদ অভিযান, গ্রেফতারের মতো মানবতাবিরোধী সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ইসরাইল রাষ্ট্রটিই প্রতিষ্ঠা হয়েছে অন্য একটি মুসলিম দেশের ভূমি জোরপূর্বকদখল করার মাধ্যমে। কিন্তু এরপরও স্বীকৃতি, নিরাপত্তা এবং পৃষ্ঠপোষকতায় পশ্চিমারা সবাই একজোট হয়ে ইসরাইলের জঘন্য সব অপরাধকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। বিপরীতে ইমারতে ইসলামিয়া নিজ দেশকে দখলদার মুক্ত করে শান্তি স্থাপন করার পরও স্বীকৃতি না পাওয়াটা মুসলিম উম্মাহকে আরও একবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে, পশ্চিমাদের শত্রুতা শুধুমাত্র ইসলাম, মুসলিম ও শরীয়াহ আইনের বিরুদ্ধে। তাদের নিজেদের মধ্যে যতোই শত্রুতা আর বিদ্বেষ থাকুক না কেন, ইসলামের বিরুদ্ধে এরা সবাই এক।
লিখেছেন : ইউসুফ আল-হাসান
তথ্যসূত্র :
——–
1. Recognition of the Islamic Emirate of Afghanistan-
– https://tinyurl.com/5n8n9n3v
2. International recognition of Israel
– https://tinyurl.com/yc2fwtey
আল্লাহ এসব কুখ্যাত জালিমদেরকে ধবংস করুন! ও এই ধবংস কারি কাফেলায় আমাদেরকে শামিল করুন!.
আমীন